ভারতের নির্বাচন: বিশ্বের গণতন্ত্রকামীরা নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পেল
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের যে ফল জানা গেছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি এককভাবে সরকার গঠন করতে পারছে না এবং সব ধরনের পূর্বাভাসকে ভুল প্রমাণ করে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট আশাতীতভাবে ভালো ফল করেছে। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ২৭২ আসন ক্ষমতাসীন এনডিএ জোটের আছে। ফলে নাটকীয় ঘটনা না ঘটলে মোদি ক্ষমতায় থাকছেন। তবে এক দশক ধরে ক্ষমতায় একটি দলের যে একচ্ছত্র প্রাধান্য ছিল, তার অবসান ঘটল। এ সবই ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারতের নির্বাচনের এই ফলাফলের একটি বৈশ্বিক গুরুত্ব আছে, বৈশ্বিক রাজনীতিতে এর প্রতিক্রিয়া পড়বে, এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়।
প্রায় দেড় দশক ধরে সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের বিপরীত স্রোত বইছে। গণতন্ত্রের অবনয়ন ঘটেছে এবং দেশে দেশে স্বৈরাচারী শাসকদের উত্থান ঘটেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের হিসাব অনুযায়ী, এই উল্টো স্রোতের যাত্রা শুরু হয়েছে ২০০৬ সালে। এর পর থেকে সামগ্রিকভাবে অবস্থার অবনতিই ঘটছে।
লন্ডনভিত্তিক ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) তাদের হিসাবে দেখিয়েছে, সারা বিশ্বের গণতন্ত্রের গড় স্কোর গত এক দশকে ৫ দশমিক ৫৫ থেকে নেমে এসেছে ৫ দশমিক ৫৩-এ। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালকে বলা হয়েছে গণতন্ত্রের পরীক্ষার বছর। এর কারণ হচ্ছে এই বছর সারা দুনিয়ায় যত নির্বাচন হবে, আগে কখনোই এক বছরে এত নির্বাচন হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিশ্বের ৬৪টি দেশে এ বছর নির্বাচন হওয়ার কথা, ইতিমধ্যে অনেক দেশে নির্বাচন হয়েছে।
নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম উপাদান হলেও নির্বাচনই যে গণতন্ত্র নয়, সেটা এখন সবাই জানেন। যে কারণে সারা বিশ্বের এই নির্বাচনগুলো নিয়ে প্রশ্ন ছিল, গণতন্ত্র রক্ষায় এগুলো ভূমিকা রাখবে নাকি ঘটবে উল্টোটা? (এ কে এম জাকারিয়া, ‘নির্বাচনগুলো কি গণতন্ত্র বাঁচাবে, নাকি আরও ডোবাবে’, প্রথম আলো, ৬ মে ২০২৪) কিন্তু এতগুলো নির্বাচনের মধ্যে যেসব দেশের দিকে সবার নজর ছিল এবং আছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্র। এর কারণ হচ্ছে আকারে এই দেশগুলো বড়, তার মধ্যে ভারতেই সর্বাধিক ভোটার।
"এগুলো শুধু ভারতের নাগরিকেরা দেখবেন তা নয়, বিশ্বে যাঁরাই গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন, যাঁরা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়ছেন, তাঁরাও দেখবেন। ভারতে নির্বাচনের ফল বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রকামীদের সামান্য নিশ্বাস ফেলার সুযোগ তৈরি করেছে। কিন্তু অবস্থার বদল ঘটবে কি না, সেটা নির্ভর করে ভারতের নাগরিক সমাজ এবং বিরোধী রাজনীতিবিদেরা তাঁদের প্রতিরোধ অব্যাহত রাখছেন কি না, তার ওপর। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নির্বাচন ভূমিকা রাখে, কিন্তু গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম প্রতিদিনের।"
কেবল ভোটারের সংখ্যাই ভারতের দিকে নজর দেওয়ার কারণ নয়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ভারতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটির গণতন্ত্রের ক্রমাগত পেছনের দিকে যাত্রা। ফ্রিডম হাউসের হিসাবে দেখা যায়, ২০১৪ সালে ভারতকে বিবেচনা করা হতো মুক্ত বা ফ্রি দেশ হিসেবে। যার অর্থ হচ্ছে ভারতে গণতন্ত্রের চর্চা ছিল অবাধ, নাগরিকের অধিকার ছিল শক্তিশালী। ২০২৪ সালে ভারতকে বলা হচ্ছে আংশিক মুক্ত বা পার্টলি ফ্রি। ইআইইউর হিসাবে ভারত হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র বা ফ্লড ডেমোক্রেসি।
সুইডেনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ভ্যারাইটিস অব ডেমোক্রেসি (ভি-ডেম) ইনস্টিটিউট ২০১৮ সালে ভারতকে ‘ইলেকটোরাল অটোক্রেসি’ বা নির্বাচনের মধ্যে জেঁকে বসা স্বৈরতন্ত্র বলে চিহ্নিত করে। এর আগপর্যন্ত ভারতকে নির্বাচিত গণতন্ত্র বা ইলেকটোরাল ডেমোক্রেসি বলেই বিবেচনা করা হতো। অবস্থার ক্রমাবনতির প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে ভি-ডেম ভারতকে বলেছে, ‘সবচেয়ে খারাপ স্বৈরাচারকরণকারী’ (ওয়ার্স্ট অটোক্রেটাইজার) দেশগুলোর একটা।
ভারতে গণতন্ত্রে নাগরিকদের অবস্থা ২০২৩ সালে কী ছিল, তা বোঝাতে ভি-ডেম তার প্রতিবেদনে বলেছিল, অবস্থা এখন ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা জরুরি অবস্থার সময়ের মতো। স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০১৪ সালের আগপর্যন্ত এটাই বলা হতো যে ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা হচ্ছে ভারতের অব্যাহত গণতন্ত্রচর্চার ইতিহাসে একটি কালিমা। ভি-ডেমের প্রতিবেদনে মোদির তৃতীয় দফা শাসনের সম্ভাবনা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল যে অবস্থা আরও খারাপ হবে।
এ রকম আশঙ্কার মুখেই নরেন্দ্র মোদি আবার ক্ষমতায় ফিরেছেন। কিন্তু আশার বিষয় হচ্ছে, ভারতের ভোটাররা তাঁর একচ্ছত্র শাসন অব্যাহত না রাখার পক্ষেই রায় দিয়েছেন এই অর্থে যে তাঁরা বিজেপিকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেননি। শুধু তা–ই নয়, বিজেপির প্রচারণা অনুযায়ী এই নির্বাচন ছিল ‘মোদির গ্যারান্টি’র নির্বাচন। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার বলেছেন তাঁর এই গ্যারান্টিতে আস্থা রাখছেন না। বিরোধী ইন্ডিয়া জোট যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনগণকে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে বহুদলীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য তাদের সক্রিয়তা দরকার, সেটা সারা বিশ্বের জন্য স্বস্তির বিষয়।
এটা ঠিক যে ক্ষমতায় যেহেতু বদল ঘটছে না, সেহেতু রাতারাতি ভারত গণতন্ত্রের পথেই ফিরেছে—এমন বলা যাবে না। তবে ভারতের নির্বাচনের এই ফল যে দেশগুলো স্বৈরাচারীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, সেখানকার গণতন্ত্রকামীদের মধ্যে আশাবাদ তৈরি করবে। এটি হচ্ছে ভারতের নির্বাচনের একটি বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ার দিক।
আরেকটি দিক হচ্ছে গত এক দশকে বিশ্বের যেসব দেশ ভারতের ‘নির্বাচিত মোদি সরকারকে’ সমর্থন ও সাহায্য করেছে কিন্তু গণতন্ত্রের ক্রমাগত অবনয়নকে গুরুত্ব দেয়নি, তাদের জন্যও এখানে একটা বার্তা আছে। মানবাধিকারের ব্যাপক লঙ্ঘন, নাগরিকদের অধিকার সংকুচিত হওয়া, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস পাওয়া এবং সেগুলোকে ক্ষমতাসীনদের কাছের মানুষদের কবজায় নেওয়ার পরও ভারতের নাগরিকেরা তাঁদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত করেছেন।
আন্তর্জাতিক সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে মোদি সরকারকে তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং এই সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রে মনে রাখা। এ ধরনের আচরণ এমন দেশের কাছ থেকে আশা করা যাবে না, যে দেশে গণতন্ত্রই অনুপস্থিত, কিন্তু যেসব দেশ গণতন্ত্রের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের কথা বলে, তাদের ওপর এই দায়িত্ব বর্তায়।
প্রশ্ন হচ্ছে মোদি সরকার এই ফলকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে। গত ১০ বছরে বিরোধীদের দমন-পীড়ন এবং দেশের রাজনীতিতে ও শাসনব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের পর আরও অনেক সংস্কারের কথাই বলেছিল বিজেপি। এসব ছিল নির্বাচনের পর তারা কী করবে, তার প্রতিশ্রুতি। এখন মোদি তাঁর জোটসঙ্গীদের নিয়ে আগের ধারায় বুলডোজার চালানোর মতো করেই তাঁর অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করবেন নাকি বিরোধীদের বিবেচনায় নেবেন, সেটি প্রশ্ন। পার্লামেন্টে বড় আকারের বিরোধী দলের উপস্থিতির অর্থ হচ্ছে মোদি সরকারকে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে। বিরোধীরা সরকারের কাছ থেকে তা কীভাবে আদায় করবে, এর ওপর নির্ভর করবে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে কি না।
এগুলো শুধু ভারতের নাগরিকেরা দেখবেন তা নয়, বিশ্বে যাঁরাই গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন, যাঁরা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়ছেন, তাঁরাও দেখবেন। ভারতে নির্বাচনের ফল বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রকামীদের সামান্য নিশ্বাস ফেলার সুযোগ তৈরি করেছে। কিন্তু অবস্থার বদল ঘটবে কি না, সেটা নির্ভর করে ভারতের নাগরিক সমাজ এবং বিরোধী রাজনীতিবিদেরা তাঁদের প্রতিরোধ অব্যাহত রাখছেন কি না, তার ওপর। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নির্বাচন ভূমিকা রাখে, কিন্তু গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম প্রতিদিনের।
আলী রীয়াজ ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি
News Courtesy: