বিশ্লেষণ: যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনা বিরল, কিন্তু অভূতপূর্ব নয়
সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রাণনাশের চেষ্টার ঘটনা সবার জন্যই উদ্বেগজনক। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে যাঁরাই গুরুত্বপূর্ণ, সাবেক প্রেসিডেন্ট থেকে বর্তমানে সক্রিয়, তাঁরা অভিন্ন স্বরে এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন।
নির্বাচনের চার মাস এবং রিপাবলিকান পার্টির সম্মেলনের ঠিক তিন দিন আগে এ হামলায় সবাই স্তম্ভিত। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনা বিরল, কিন্তু অভূতপূর্ব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে চারজন প্রেসিডেন্টকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ১৯৬৮ সালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় নিহত হয়েছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী রবার্ট এফ কেনেডি। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় থাকার সময় হত্যাচেষ্টার লক্ষ্যবস্ত হয়েছেন।
ট্রাম্পের ওপর হামলার পর এ দেশের গণমাধ্যমের আলোচনায় এই ইতিহাস স্মরণ করা হচ্ছে। একার্থে এটাই স্মরণ করিয়ে দিতে যে অতীতে এসব হত্যা ও হত্যাচেষ্টা রাজনীতি ও নির্বাচনকে প্রভাবিত করেনি। এগুলোর পেছনে সাধারণত থেকেছে এক ব্যক্তি বা কয়েকজনের ষড়যন্ত্র। নিহত বা আক্রান্ত ব্যক্তির মত ও পথের সঙ্গে আততায়ীর রাজনৈতিক ভিন্নতা থাকলেও সেটা মূলধারার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না। এসব ঘটনাকে বিবেচনা করা হয়েছে অপরাধ হিসেবে এবং এ অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিদের যখন সম্ভব হয়েছে বিচার করা হয়েছে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি এখন এমন এক সময় অতিক্রম করছে যে এই হত্যাচেষ্টার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হবে কি না, সেটা অনেকের মনেই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক বছরে রাজনীতিতে মেরুকরণের ফলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে অনেকের আশঙ্কা, এ ঘটনার রাজনৈতিকীকরণ হতে পারে। উগ্র দক্ষিণপন্থীরা, যাঁরা গত কয়েক বছরে ট্রাম্পের সমর্থক হিসেবে রিপাবলিকান দলে তাঁদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁরা মনে করেন, ক্ষমতার কাঠামোর ভেতরে যাঁরা আছেন, সেই ডিপ স্টেট ট্রাম্পকে পরাস্ত করতে চায়। এই দক্ষিণপন্থীরাই ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে বা কংগ্রেস ভবনে হামলা করে ক্ষমতা হস্তান্তর বন্ধ করতে চেষ্টা করেছে। যুক্তি প্রমাণের বিপরীতে গিয়ে তাঁরা মনে করেন, ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো ষড়যন্ত্রমূলক।
ট্রাম্প নিজেকে এই ব্যবস্থার একজন ‘ভিকটিম’ হিসেবেই উপস্থাপন করতে পছন্দ করেন, যাতে করে তাঁর প্রতি সহানুভূতি বৃদ্ধি পায়। তাঁর বিরুদ্ধে নেওয়া আইনি ব্যবস্থাগুলোর জন্য তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে দায়ী করেছেন, এমনকি যেখানে ফেডারেল সরকারের কোনো ভূমিকাই নেই। এ রকম প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প এবং তাঁর সমর্থকেরা অতীত ইতিহাসের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। হত্যাচেষ্টার অব্যবহিত পরে এমন লক্ষণ দেখা যায়নি।
কিন্তু ট্রাম্পের আচরণ প্রচলিত রাজনীতিবিদদের মতো নয়, তাঁর সমর্থকেরা এর ভিন্ন ব্যাখ্যা করলে তা অভাবনীয় কিছু হবে, তা নয়। নিজেকে ‘প্রায়-শহীদ’ হয়ে যাওয়া একজন বলে হাজির করলে তাতে তাঁর সমর্থকেরা আরও বেশি উজ্জীবিত হবেন, সেটা নিশ্চিত। প্রশ্ন হচ্ছে, দলনিরপেক্ষ নাগরিকেরা তা কীভাবে নেবেন। এ ঘটনার পর যাঁরা ডেমোক্রেটিক পার্টি, বিশেষ করে জো বাইডেনের নির্বাচনের জন্য সমূহ বিপদ দেখতে পাচ্ছেন, তাঁরা সম্ভবত অতি দ্রুত উপসংহারে পৌঁছাচ্ছেন। এই হত্যাচেষ্টাকে কেন্দ্র করে রাজনীতির মেরুকরণ আরও বেশি বিপজ্জনক এবং সহিংস রূপ নেবে কি না, তার ইঙ্গিত মিলবে মঙ্গলবার রিপাবলিকান পার্টির সম্মেলন শুরু হলে।
দ্বিতীয় আশঙ্কা হচ্ছে, এ ঘটনার তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে ট্রাম্প শিবির থেকে প্রশ্ন উঠবে কি না। এ ধরনের অপরাধের তদন্তের দায়িত্ব এফবিআইয়ের। প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রেসিডেন্টদের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সিক্রেট সার্ভিস, পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্য ও বাটলার শহরের পুলিশের সাহায্য নিয়ে এফবিআই ইতিমধ্যে তদন্তের কাজ শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সময় শনিবার রাতেই এফবিআই সন্দেহভাজন আততায়ীয় নাম জানিয়েছে। কিন্তু অতীতে, বিশেষ করে ২০২২ সালের ৮ আগস্ট ট্রাম্পের ফ্লোরিডার মারা-লাগো বাসভবনে তল্লাশি চালানোর পর থেকে ট্রাম্প এবং তাঁর সমর্থকেরা এফবিআইকে ট্রাম্পের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন বলে মনে করেন। ট্রাম্প একাধিকবার এফবিআইয়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করেছেন। এখন ট্রাম্পের শিবির থেকে এ বিষয়ে প্রশ্ন তুললে তা তদন্তের পথে বাধা না হলেও এ নিয়ে বিতর্কের সূচনা হবে, যার ফল ইতিবাচক হবে না।
এসব আশঙ্কা, উদ্বেগ, তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যেই আগামী মাসগুলো অতিবাহিত হবে বলে অনুমান করা যায়। কংগ্রেসে এ নিয়ে তদন্ত হবে যে সিক্রেট সার্ভিসের দায়িত্ব পালনে কোনো ব্যত্যয় ছিল কি না। ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং জো বাইডেনের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে, ট্রাম্প শিবির যদি একে রাজনীতির একটি বিষয়ে পরিণত করে, তাহলে সেটা মোকাবিলা করার যথাযথ কৌশল বের করা। আর যে প্রশ্নটা অচিরেই উঠবে তা হচ্ছে, কয়েক বছর ধরে ট্রাম্প, রিপাবলিকান পার্টি এবং উগ্র দক্ষিণপন্থীরা যে ভাষায় কথা বলেছে, যেভাবে সহিংসতাকে উসকে দিয়েছেন, তার সঙ্গে এ ঘটনার যোগসূত্র কতটা।
আলী রীয়াজ: ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি।
News Courtesy: