সরকারের ভঙ্গুরতা ও বিচ্ছিন্নতা দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে
বাংলাদেশ এখন যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, এর মর্মবস্তুকে এককথায় গণঅভ্যুত্থান বলেই চিহ্নিত করা যায়। এ পর্যন্ত ২১১ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। আহতের সংখ্যা হাজার হাজার। গত এক সপ্তাহে গ্রেপ্তারের সংখ্যাও ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিরাপত্তা হেফাজতে রেখে তাদের মুখ দিয়ে অনেক কথাই বলানো হচ্ছে। তবুও আন্দোলনকে নিরস্ত করা যাচ্ছে না।
ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ যে মাত্রায় প্রতিবাদ-বিক্ষোভে যুক্ত হয়েছেন, তা আগে দেখা যায়নি। রাষ্ট্রও যেমন সর্বশক্তি দিয়ে গণবিক্ষোভ দমনে নেমেছে, সেটাও অভূতপূর্ব। গণঅভ্যুত্থানকে কেবল বিক্ষোভের আকার বিবেচনায় পরিমাপ করা যায় না। এর মধ্যে জনগণের আকাঙ্ক্ষা জোরালোভাবে প্রকাশ পাচ্ছে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। সারাদেশে এবং গ্রাম ও শহরে জনমানুষের অংশগ্রহণের যে চিত্র সকলে দেখছি, তার মধ্যে মানুষের ক্ষোভ ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। বৃহত্তর তরুণ সমাজের রাগ-হতাশা ও তৎপরতার মধ্যে সর্বাত্মক বিরোধিতা চলে এসেছে। এই তরুণরা এখন জাতির মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে। তাদের ঘিরে এক ধরনের জাতীয় ঐক্যও ফুটে উঠছে।
এই গণঅভ্যুত্থান সফল হবে কিনা কিংবা কী ধরনের সাফল্য অর্জন করবে, সেটা সামনের দিনগুলোতে স্পষ্ট হবে। তবে যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল অঙ্গকে এবং বল প্রয়োগের যত রকম মেকানিজম বা ব্যবস্থা আছে, তার সবই প্রয়োগ করা শুরু করেছেন।
আন্দোলন দমনে যে ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের অস্ত্র। এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সরকার একে অস্তিত্বের সংকট হিসেবে দেখছে। বিশ্বের অন্যত্রও আমরা দেখেছি যে, এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা জনগণের মধ্য থেকে আসা চ্যালেঞ্জকে অস্তিত্বের সংকট হিসেবেই বিবেচনা করে। বলপ্রয়োগের চূড়ান্ত রূপই হচ্ছে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ, যা আমরা সারাদেশে দেখতে পেয়েছি। এ ধরনের বলপ্রয়োগের প্রয়োজন তখনই দেখা দেয়, যখন কেবল নৈতিক বৈধতার সংকটই নয়, ক্ষমতাসীনদের আর সব ধরনের বৈধতারও অবসান ঘটে। এটি জনগণের সঙ্গে তাদের দূরত্বের প্রমাণ। তারা এমনকি তরুণদের সীমিত দাবির মর্মও বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই বিচ্ছিন্নতা এখন অনতিক্রম্য বলেই স্পষ্ট হচ্ছে। কারণ, সরকার জনগণকেই প্রতিপক্ষ মনে করা শুরু করেছে এবং জনগণও সেটা বুঝে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এমনকি সরকার তাদের সব রকমের মিত্রবাহিনী ব্যবহার করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। জনগণের বৃহত্তর অংশ শাসকদের কোনো পদক্ষেপকে সমর্থন করতে তো পারছেই না, বরং যে যেভাবে পারে তার বিরোধিতা করছে। এ রকম পরিস্থিতিকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গণঅভ্যুত্থান বলা হয়। তবে গণঅভ্যুত্থান কখনও পরিকল্পনা করে কিংবা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ঘটানো যায় না।
যদি কারফিউ কিংবা অন্য ধরনের বলপ্রয়োগ দিয়ে দেশ চালাতে হয়, তাহলে বুঝতে হবে, প্রকৃতপক্ষে সরকারের পক্ষে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আর শাসন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে, জনগণও আগের কায়দায় আর শাসিত হতে রাজি না। সুতরাং এই সরকারকে ক্ষমতায় রেখে কোনোভাবেই এসব দাবি পূরণের সম্ভাবনা নেই। সেদিক থেকে সরকার নিজেই গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি তৈরি করেছে।
এটা ঠিক যে, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি-দাওয়ার মধ্যে সরকারের অপসারণের বিষয়টাকে সরাসরি সামনে আনেননি। কিন্তু তারা ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশদাতাদের, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের এবং যেসব সংগঠন ও পুলিশ কর্মকর্তা মানুষ হত্যাসহ দমনপীড়নে জড়িত, যেসব উপাচার্য ছাত্রদের বিপক্ষে সক্রিয়; তাদের সবার অপসারণ ও বিচার দাবি করেছেন। শিক্ষার্থীদের এসব দাবির ভেতরকার বার্তা হলো, তাদের ওপর নিপীড়ন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই করা হয়েছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে এই বিচার ও অপসারণের সুস্পষ্ট প্রকাশও দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারছে না বলেই মনে হচ্ছে। অথচ সংঘাতমূলক এই সংকট থেকে সমাধানের দিকে যেতে হলে রাজনৈতিক শক্তি এবং রাজপথে গড়ে ওঠা ছাত্রশক্তির সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের একটা বোঝাপড়ার জায়গায় আসতে হবে। সরকার যদি রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতার উদীয়মান শক্তির দাবি বুঝতে না পারে এবং সেই মতে অগ্রসর না হয়, তাহলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটার আশঙ্কা আছে। সেটা কখন, কীভাবে হবে– তা আগাম বলা যায় না। অনমনীয়তা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।
রাজপথ থেকে সামাজিক মাধ্যম– সর্বত্র আলোচনার বিষয় আর কোটা সংস্কারের মধ্যে সীমিত নেই। একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়বিচারমূলক সরকারের দাবি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে প্রধান যে বিষয়গুলো উঠে আসছে, তা হলো: দেশবিনাশী দুর্নীতির প্রতিকার, ভোটাধিকারের মাধ্যমে জনগণ যেমন প্রতিনিধি চান তার নিশ্চয়তা, অংশীদারির রাজনীতি এবং সংবিধান অনুযায়ী নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা। এই বিষয়গুলোর মীমাংসা ছাড়া এ অচলাবস্থার অবসান হবে না। একে বড়জোর সাময়িকভাবে দমন করা যেতে পারে। আর সেই মীমাংসার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দল এবং ছাত্রশক্তির অংশগ্রহণ জরুরি।
জাতীয় সংকট মোকাবিলায় যারাই বিভিন্ন সময়ে আগুয়ান হয়ে এসেছেন, এই বিষয়গুলো তাদের সামনে জ্বলন্ত প্রশ্ন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। তাদেরও এসব বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে হবে। এগুলো এড়িয়ে গিয়ে বাংলাদেশকে আর এগিয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ দেখা যাচ্ছে না।
এই অচলাবস্থার সঙ্গে আন্তর্জাতিক টানাপোড়েনও গভীরভাবে জড়িত। এ সরকার এতদিন গণতন্ত্রহীনতার বিনিময়ে স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছিল। পশ্চিমা দেশগুলোও কার্যত স্থিতিশীলতার শর্তে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে নমনীয় অবস্থানে ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত বছরগুলোতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে সোচ্চার ছিল; কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগে আগে সেই কঠোরতা থেকে সরে আসে। তাদের এই পরিবর্তনের পেছনে যে কথিত স্থিতিশীলতার বিষয়টি ভূমিকা রেখেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক মিত্র ভারত সেভাবেই একে উপস্থাপন করেছে, সেটা অনুমান করা যায়। কিন্তু তাদের এই বিবেচনার অসারতাও এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকটিত হয়েছে। ইতোমধ্যে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের তদন্তে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্টতার দাবি উঠেছে। সামনে আরও অন্য কারণেও জাতিসংঘের দ্বারস্থ হওয়ার বিষয় উঠতে পারে। তারই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে জাতিসংঘের মহাসচিব, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের উপপ্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলের বিবৃতিতে।
সরকারের দুই নিকটতম মিত্র ভারত ও চীন সুস্পষ্ট ভূরাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে সরকারের ধারাবাহিকতার পক্ষেই ছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতা– সবকিছুই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে। এখন আর আগের কায়দায় সব সম্পর্ক জারি রাখার সুযোগ সরকারের বৈদেশিক মিত্রদের সামনেও তিরোহিত হয়ে গেছে।
এই বাস্তবতা যদি এতদিন তারা না-ও বোঝেন, এখন বুঝতে হবে। কেননা যারা দেশকে স্থিতিশীলতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তাদের ভেতরে এক ধরনের ভঙ্গুরতা উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এই ভঙ্গুরতা ও নাজুকতা রাষ্ট্রের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী ও মিত্ররা যদি এটি উপলব্ধি না করেন, তাহলে পরিস্থিতি কেবল আরও ভঙ্গুরতার দিকেই চলে যাবে তা নয়, সংকট আরও গভীর রূপ নেবে।
আলী রীয়াজ : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো।
News Courtesy: