জান্তা সরকার নাকি আরাকান আর্মি, কাকে সমর্থন করবে বাংলাদেশ?
মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ নতুন মোড় নিয়েছে গত বছর। দেশটির জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো একজোট হয়েছে। তিনটি বৃহৎ সশস্ত্র সংগঠন- মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (MNDAA), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (TNLA), এবং আরাকান আর্মি (AA) একত্র হয়ে তৈরি করেছে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স। গত বছরের ২৭ অক্টোবর মিয়ানমার সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অপারেশন ১০২৭ শুরু করে এই সম্মিলিত জোট।
মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে গত কয়েক মাস ধরে তীব্র লড়াই চলছে। এই লড়াইয়ের প্রভাব শুধু মিয়ানমারেই অনুভব করা যাচ্ছে তা নয়। ক্রমবর্ধমানভাবে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও প্রভাবসহ একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা সমস্যা হয়ে উঠছে এটি।
রাখাইন, চিন ও শান প্রদেশে প্রায় প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে সেনাবাহিনীর পরাজয়ের খবর। রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। রাজ্যটি কয়েক বছর ধরে অশান্ত এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের আবাসস্থল। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর এখানে গণহত্যা চালায় মিয়ানমার সামরিক বাহিনী। জীবন বাঁচাতে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে চীনের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত হয় দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। অথচ ২০১৭ থেকে ২০২৪, ৬ বছরেও রোহিঙ্গাদেরকে তাদের জন্মভূমিতে ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমার সরকার।
বিদ্রোহী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ শুধু মিয়ানমারের ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে ছড়িয়ে পড়ছে এই লড়াই। মর্টার শেল এবং রাইফেলের গুলি এসে পড়ছে বাংলাদেশের মধ্যেও। মিয়ানমার থেকে আসা মর্টার শেলের আঘাতে দুই বাংলাদেশির মৃত্যুও হয়েছে এবং সীমান্তে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
এ ছাড়া মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত ৩৪০ সদস্য বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) প্রধান সে সময় সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর চেষ্টা করছে মিয়ানমার জান্তা। তবে বাংলাদেশ–মিয়ানমারের মধ্যে যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি আমাদেরকে মিয়ানমার নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে জান্তার পরাজয় ঘটতে যাচ্ছে। বিদ্রোহীরা রাখাইনসহ আরও কিছু রাজ্যে স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে বলে মনে হচ্ছে। বিদ্রোহীরা যদি রাখাইনের স্বাধীনতা ঘোষণা করে তবে তা মিয়ানমারে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।
রাখাইনের জাতিগোষ্ঠীগুলোর সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করছে আরাকান আর্মি (AA)। সংগঠনটি স্থানীয় বৌদ্ধদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। রোহিঙ্গারা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম। মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গারাও আরাকান আর্মিতে যোগ দিচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। রোহিঙ্গা যুবকদের বিশ্বাস, রাখাইন রাজ্য থেকে জান্তা সরকারকে বিতাড়িত করতে পারলে এবং রাখাইনকে স্বাধীন করতে পারলে রোহিঙ্গারা তাদের জন্মভূমিতে ফিরতে পারবে। রোহিঙ্গারা তাদের সম্পত্তি এবং বাড়িঘর ফিরে পাবে।
তবে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে থাকা অনেক রোহিঙ্গা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান। কারণ আরাকান আর্মি (AA) এখনো রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাই আরাকান আর্মি রাখাইনে বিজয়ী হলেও রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে প্রকৃতপক্ষে কি ঘটবে সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। এছাড়া, মিয়ানমারের সংঘাত, বিশেষ করে রাখাইনে, এখানে শুধু জান্তা এবং বিদ্রোহীরা জড়িত নয়। দুটি আঞ্চলিক শক্তির অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থও এখানে জড়িত।
মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক রয়েছে চীনের। এই এলাকায় একটি বড় অংশীদারিত্ব রয়েছে পরাশক্তি দেশটির। বঙ্গোপসাগরে নবনির্মিত কিয়াকফিউ বন্দর এবং বন্দর ও দক্ষিণ চীনের মধ্যে একটি পাইপলাইনসহ পরিকল্পিত সড়ক ও রেল যোগাযোগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এর মধ্যে। চীনের আলোচিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এর-ও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই বন্দর। ফলে ২০২১ সালে অভ্যুত্থানের পর থেকে জান্তাকে সমর্থন অব্যাহত রেখেছে চীন।
অন্যদিকে, ভারতের কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প রয়েছে এখানে। প্রায় অর্ধ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পে রয়েছে সিটওয়েতে একটি বন্দর যা বাংলাদেশকে বাইপাস করে পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন এবং চিন রাজ্যের মধ্য দিয়ে ভারতের ল্যান্ডলকড উত্তর-পূর্বের সাথে কলকাতাকে সংযুক্ত করে। এই প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট চিন রাজ্যের পালেতওয়া টাউনশিপ। জায়গাটি আরাকান আর্মির দখলে রয়েছে। ভারতীয় প্রকল্পটি কেবল অর্থনৈতিক কারণেই নয়, বরং মিয়ানমারে চীনা প্রভাব মোকাবিলা এবং ভারত মহাসাগরের অবিচ্ছেদ্য অংশ বঙ্গোপসাগরে নিজের শক্তিশালী উপস্থিতির জন্যও প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ।
চীন গোপনে আরাকান আর্মি (AA)-কে সমর্থন করছে বলে দাবি করছেন অনেকে। যা ভারতের জন্য উদ্বেগ তৈরি করে।
ভৌগোলিক নৈকট্য এবং সংঘাতের সঙ্গে জড়িত পক্ষগুলো বাংলাদেশকেও সংঘাতের দিকে টেনে নিতে চেষ্টা করবে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া যুদ্ধকে বাংলাদেশের দোরগোড়ায় নিয়ে যাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে সংঘাতের ক্রমাগত বৃদ্ধি এবং AA এর সম্ভাব্য অগ্রগতি বাংলাদেশের জন্য গুরুতর প্রভাব ফেলবে। এর প্রভাব শুধু সীমান্ত এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কও প্রভাবিত হবে। নিঃসন্দেহে, বাংলাদেশের ওপর কড়া নজর রাখবে মিয়ানমার। এছাড়া রাখাইনে চীন ও ভারত পরস্পর নিজেদের স্বার্থ দেখার পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দিকেও নজর রাখবে তারা।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে বিবেচনা করতে হবে, মিয়ানমার সম্পর্কে বিশেষ করে এএ-এর প্রতি বাংলাদেশ তার নীতি পরিবর্তন করবে কিনা। বাংলাদেশের সামনে এখন তিনটি বিকল্প রয়েছে। স্থিতাবস্থা বজায় রাখা, আরাকান আর্মি (AA)-এর সঙ্গে কাজ করা, অথবা AA-এর অগ্রগতিতে সক্রিয় অবস্থান নেওয়া। বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছে এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশের প্রতিবাদ করেছে। রাখাইন এবং আরও কয়েকটি রাজ্য নিয়ন্ত্রণ হারালেও সমগ্র মিয়ানমারে জান্তার পতনের সম্ভাবনা কম। তবে পরিস্থিতির অবনতি হলে রাখাইন থেকে উদ্বাস্তুদের একটি নতুন ঢেউ বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ কোনোভাবেই এটা চায় না। বাংলাদেশ যদি আরাকান আর্মি (AA)-কে উপেক্ষা করে এবং এই গোষ্ঠীর সঙ্গে যদি বাংলাদেশের একটি উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় তবে তা আরও বড় সমস্যার সৃষ্টি করবে।
আরেকটি বিকল্প হলো- আরাকান আর্মি এবং জাতীয় ঐক্য সরকার (NUG) এর সাথে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ স্থাপন করা। একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যতের সম্পর্ক স্থাপন করা। বিদ্রোহীরা যদি একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয় এবং বিশাল একটি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে তবে বাংলাদেশের জন্য তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। অবশ্য ইতিমধ্যেই আরাকান আর্মি এবং এর রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
AA-এর সাথে যুক্ত হলে তা মিয়ানমার সরকারের সাথে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তবে, নিরাপত্তার কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর নন-স্টেট অ্যাক্টরদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা নজিরবিহীন কিছু নয়। যাইহোক, ঢাকাকে তার সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা করতে হবে এবং সক্রিয়ভাবে সেই স্বার্থগুলো অনুসরণ করতে হবে। পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে এবং সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।
আলী রীয়াজ : যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। ভাষান্তর - মুজাহিদুল ইসলাম
News Courtesy:
https://www.kalbela.com/opinion/sub-editorial/70413