জনগণের অর্থে ফুটো চৌবাচ্চা ভরা
বাংলাদেশে যাঁরা ছোটবেলায় বাধ্যতামূলকভাবে পাটিগণিত পাঠ করেছেন, তাঁরা নিশ্চয় ফুটো চৌবাচ্চায় পানি ভরার অঙ্ক করেছেন। ওই অঙ্ক মনে না থাকলে বইপত্র ঘেঁটে আবার তা ঝালিয়ে নিতে পারেন। আর সেই সময় হাতে না থাকলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের খোঁজখবর নিন, দেশে যে ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে, তার খবর নিন, তাতেও হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জনগণের অর্থে ফুটো চৌবাচ্চা ভরার কাজে সরকার কোনো রকম দ্বিধা করছে না। আর তার ফল কেবল ব্যাংকিং খাতে সীমাবদ্ধ তা নয়।
আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে প্রথম আলোয় একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল; শিরোনাম ছিল ‘সাত বছরে আত্মসাৎ ৩০ হাজার কোটি টাকা’। ২৭ মার্চ ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রথম বাক্যগুলো ছিল এই রকম, ‘গত সাত বছরে ঘটেছে ছয়টি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি। এসব কেলেঙ্কারিতে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি চুরি বা আত্মসাৎ করা হয়েছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ ও ডেসটিনির কেলেঙ্কারির কথা ছিল সেই প্রতিবেদনে; এ-ও বলা হয়েছিল যে এগুলো বড় কেলেঙ্কারির হিসাব।
এর বাইরে ‘ছোট’ কেলেঙ্কারিও ছিল, যেমন রূপালী ব্যাংক থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নেওয়া প্রায় হাজার কোটি টাকা, যার ৮০১ কোটি টাকা আদায়ের সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ছিল অগ্রণী ব্যাংক থেকে বহুতল ভবন নির্মাণের মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার ঘটনা। সেই সময় আমরা মাত্র ফারমার্স ব্যাংকের ঘটনা জানতে শুরু করেছি, বলা হচ্ছিল ওই ব্যাংকে ‘অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ’ করা হয়েছে।
তারপর গত দুই বছরে ‘পদ্মায় অনেক জল গড়িয়েছে’ না বলা গেলেও অনেক কিছুই যে ঘটেছে আমরা তা জানি। এই তালিকায় এখন আরও অনেক কিছু যুক্ত হয়েছে। যেমন ধরুন জনতা ব্যাংকের ঘটনা। এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলোর প্রতিবেদন হচ্ছে জনতা ব্যাংক নিয়ে। বলা হয়েছে, ‘ভয়ংকর রকম উদারভাবে ঋণ বিতরণ করেছে জনতা ব্যাংক। এক গ্রাহককেই মাত্র ছয় বছরে তারা দিয়েছে ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা। নিয়মনীতি না মেনে এভাবে ঋণ দেওয়ায় বিপদে ব্যাংক, গ্রাহকও ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। জনতা ব্যাংকের মোট মূলধন ২ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার সুযোগ আছে। অর্থাৎ, এক গ্রাহক ৭৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পেতে পারেন না। দেওয়া হয়েছে মোট মূলধনের প্রায় দ্বিগুণ।’ ফারমার্স ব্যাংক আর জনতা ব্যাংকের হিসাব যুক্ত করলে আত্মসাতের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি পেরিয়ে গেছে। এগুলোর কথা আমরা জানি, না জানা হিসাবের কথা বাদ দিই।
ফারমার্স ব্যাংকের ঘটনা যে কত বড় ব্যাপার, সেটা দৈনিক যুগান্তর-এর ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সম্পাদকীয় মন্তব্যে স্পষ্ট, ‘নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংক ঋণ বিতরণে অনিয়ম, জালিয়াতি ও লুটপাটে অতীতের যেকোনো ব্যাংক কেলেঙ্কারি-অনিয়মকে ছাড়িয়ে গেছে।’ অবস্থাটা এখন কী দাঁড়িয়েছে? গত বছর এই ব্যাংকটি ‘৫৩ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। বছর শেষে ব্যাংকটির আমানত কমে হয়েছে ৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকটির ঋণ ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।’ এই ব্যাংকের কাছে পাওনা যে কেবল ব্যক্তিগত আমানতকারীদের বা প্রতিষ্ঠানের তা নয়, সরকারেরও-সহজ ভাষায় বললে রাষ্ট্রের। কেননা, ‘এর মধ্যে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের ৪৯৯ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা জমা আছে ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান, মতিঝিল ও গুলশান সাউথ অ্যাভিনিউ শাখায়। সুদসহ যা ৫১০ কোটিতে পৌঁছেছে।’ (প্রথম আলো, ২৭ মার্চ ২০১৮)। জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের টাকার উৎস কী? ট্রাস্টের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, ‘২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (সিসিটিএফ) গঠন করা হয়।’ তার মানে, এই অর্থের মালিক হচ্ছেন নাগরিকেরা। এই ব্যাংকটি বাঁচানোর জন্য প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা মূলধনের দরকার হবে বলে একবার হিসাব বের হয়েছিল।
কিন্তু এই অবস্থা কেবল যে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের বিষয়, তা কিন্তু নয়। রাষ্ট্রের মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর অবস্থা দেখুন, তাহলে বুঝতে পারবেন। গত তিন মাসে ছয়টি ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি হয়েছে ১ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা। এতে করে সোনালী, জনতা, রূপালী ও বেসিক ব্যাংক এবং বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) মূলধন ঘাটতি এখন ১৭ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা।
এই যে হাজার হাজার কোটি টাকা ‘নাই’ হয়ে যাচ্ছে, সে খবর আসলে নতুন নয়। অনেকের কাছেই তা পুরোনো বিষয়। কিন্তু যা পুরোনো বিষয় নয় তা হচ্ছে এই ব্যাংকগুলো, যাদের এখন অনেকে ‘ফুটো কলসি’ বলতে চান, কেউ কেউ ‘ফুটো চৌবাচ্চা’ বলেন, সেগুলোতে প্রায় প্রায়ই আরও বেশি অর্থ ঢালার ঘটনা ঘটে চলেছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ‘মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ’ খাতে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা আছে এবং জানা যাচ্ছে যে এই টাকা এখন ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কল্যাণে আমাদের জানা আছে যে গত ১০ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে সরকার ১০ হাজার ২৭২ কোটি টাকার ‘পুনর্মূলধনীকরণ সুবিধা’ দিয়েছে। এই তথ্য ফেব্রুয়ারিতে সংসদে দেওয়া। কিন্তু বণিক বার্তা গত বছরের ২ জুন এক হিসাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে সরকার ২০০৯-১০ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত আট বছরে ১৪ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা দিয়েছে বলে দাবি করেছিল। ‘পুনর্মূলধনীকরণ সুবিধা’-এই ভারী শব্দটার অর্থ হচ্ছে, সরকার জনগণের টাকা ব্যাংককে তুলে দিয়েছে। আর তারা সেগুলো ‘হারিয়ে’ ফেলায় এখন তাদের আবার টাকা দিতে হচ্ছে।
ব্যাংকিং খাতের এসব দুর্নীতি যে দেশে শ্রেণি গঠনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, তা বোঝা খুব জরুরি; একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার যে শ্রেণি গঠনের এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রের চরিত্রকে নির্ধারণ করে দিয়েছে। (১৯৭২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ার বিষয়ে আমার বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য, ‘আনফোল্ডিং স্টেট: দ্য ট্রান্সফরমেশন অব বাংলাদেশ’, অন্টারিও: ডিসিটার পাবলিকেশনস, ২০০৫)। এখন যা ঘটছে তা লুটেরা ধনিক শ্রেণির বিকাশের ধারাবাহিকতারই অংশ, তা আনু মুহাম্মদ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন (‘লুম্পেন কোটিপতিদের উত্থানপর্ব’, প্রথম আলো ২৮ মার্চ ২০১৮)।
গত ৪৭ বছরে বাংলাদেশে তিন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে এই লুটেরা শ্রেণি, যাদের আনু মুহাম্মদ ‘লুম্পেন কোটিপতি’ বলে বর্ণনা করেছেন, তাদের উদ্ভব ঘটেছে। ‘প্রথম পর্বে ছিল লাইসেন্স, পারমিট, চোরাচালানি, মজুতদারি, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানা, সম্পদ আত্মসাৎ ইত্যাদি। দ্বিতীয় পর্বে এর সঙ্গে যোগ হয় ব্যাংকঋণ ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মালিকানা লাভ।’ তৃতীয় পর্বে, ‘পুরো ব্যাংক খেয়ে ফেলা,...এমনকি সর্বজনের সব সম্পদই এখন বাংলাদেশে এই শ্রেণির কামনা-বাসনার লক্ষ্যবস্তু’তে পরিণত হয়েছে। আনু মুহাম্মদের এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমতের অবকাশ নেই। এ ব্যবস্থায় একই সঙ্গে বাংলাদেশের যে প্রধান উৎপাদক শ্রেণিগুলো আছে-কৃষক, পোশাক খাতের শ্রমিক এবং স্বল্পমেয়াদি অভিবাসী শ্রমিক-তাঁরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন।
এই শ্রেণির বিকাশ এবং শক্তি সঞ্চয়ের ফলে দেশের রাজনীতিতে তার অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়েছে। আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, স্বাধীন গণমাধ্যম, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় প্রকল্প ও অর্থ বরাদ্দে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, স্বাধীন নির্বাচনব্যবস্থা, স্বাধীন বিদ্যাচর্চা-সংস্কৃতিচর্চা’ এদের কাঙ্ক্ষিত নয়। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার এটাই হচ্ছে অন্যতম কারণ। গত বছরগুলোতে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ‘চুইয়ে পড়া’র মতো করে এই সম্পদের কিছু সমাজে এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটিয়েছে, যারা বিত্তের বিবেচনায় মধ্যবিত্ত বলে বিবেচিত হলেও আচার-আচরণে এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিবেচনায় অতীতে মধ্যবিত্ত যে ধরনের ভূমিকা পালন করত, তা পালনে আগ্রহী নয়। বাংলাদেশে অতীতে মধ্যবিত্তের ভেতরে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা এবং অংশগ্রহণমূলক সমাজের স্বপ্ন ছিল, এখন তা প্রায় অবসিত হতে চলেছে। (দেখুন ‘নতুন মধ্যবিত্ত উদার গণতন্ত্রে আগ্রহী নয়?’ প্রথম আলো, ৯ জানুয়ারি ২০১৮)। উপরন্তু, ক্ষমতাসীনেরা শাসনের পথ হিসেবে বলপ্রয়োগের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
ফলে ফুটো চৌবাচ্চায় পানি ভরার এই প্রক্রিয়ার দিকে সবার মনোযোগ দেওয়া দরকার দুই কারণে-প্রথমত, তা নাগরিকের কষ্টার্জিত অর্থ লুটেরাদের হাতে তুলে দিচ্ছে; দ্বিতীয়ত, তা বাংলাদেশে ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার সম্ভাবনাকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর
News Courtesy:
https://www.prothomalo.com/opinion/column/%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A7%87-%E0%A6%AB%E0%A7%81%E0%A6%9F%E0%A7%8B-%E0%A6%9A%E0%A7%8C%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%BE-%E0%A6%AD%E0%A6%B0%E0%A6%BE?fbclid=IwAR08nJuOM5YbYLE8QcWfpLEwLF-wRD2X8y-g49jsruoI0mgcf2zbdQxSGII