বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরপর কী হবে?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরপর কী হবে?

চলতি বছরের জুলাই থেকে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সারা দেশে সমাবেশ করছে। অতীতে দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিয়মিত সাধারণ ধর্মঘট প্রত্যক্ষ করা গেছে, কিন্তু ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একচেটিয়াভাবে নিজেরাই রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করেছে এবং বিরোধী দলগুলোর প্রকাশ্য বিক্ষোভ দমন করেছে। সরকার বিরোধীদের রাস্তায় উপস্থিতি -হাজার হাজার মানুষের সমাবেশে যোগদান- দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যে পরিবর্তনের বার্তা দিচ্ছে। বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ নাগরিকদের বিক্ষোভে যোগদান থেকে বিরত রাখতে পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে, সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের উপর হামলা করেছে এবং তথ্য প্রবাহে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। 
সরকারবিরোধী বিক্ষোভের এই আকস্মিক তীব্রতার নেপথ্যে কী রয়েছে এবং দেশের মঙ্গলে তার কেমন প্রভাব পড়বে? বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট ক্রমবর্ধমান এই রাজনৈতিক অসন্তোষে অবদান রাখলেও, জনবিক্ষোভের এই মাত্রা বৃদ্ধি আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার প্রতি বর্ধিত ক্ষোভ এবং ২০২৩ সালের শেষের দিকে বা ২০২৪ সালের শুরুর দিকে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচন তারা কীভাবে পরিচালনা করতে পারে সে সম্পর্কে (জনমনে) ভীতিরই প্রতিফলন। সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে আসছে মাসগুলোতে ক্রমবর্ধমান সহিংসতায় সরকার সমালোচকদের উপর নিপীড়ন আরও বাড়তে পারে, পরিস্থিতির উপর ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতাও দেখা দিতে পারে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট অসন্তুষ্ট নাগরিকদের একটি বড় ‘গ্রুপের’ জন্ম দিতে পারে যারা তাদের অভিযোগ দাখিলের উপায় খুঁজবে, আর ক্ষমতাসীন দল সম্ভাব্য সব উপায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করবে। 

ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দুর্দশা: বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন, যা রাজনৈতিক মতবিরোধকে আরও জটিল করে তুলেছে। সরকার আগস্টে তেল ও জ্বালানি খাতে দাম বৃদ্ধি ঘোষণা করলে রাতারাতি জ্বালানির দাম ৫০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পায়, ফলে সাম্প্রতিক বিক্ষোভের শুরু। ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনা মহামারি শুরুর পর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ার পর (জ্বালানির দাম) অভূতপূর্ব এই বৃদ্ধির ঘোষণা আসে। দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকট নেই, আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এবং স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের বারবার এমন আশ্বাস সত্ত্বেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন, রেমিট্যান্সের নিম্নগামী প্রবণতা এবং বাণিজ্য ঘাটতি সামনে কঠিন সময়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছেছে।

রোলিং ব্ল্যাকআউট (বিদ্যুৎ সরবারহে বিঘœ) অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। সরকারি অফিস, ব্যাংক এমনকি স্কুলগুলোকেও এখন আরও ঘন ঘন বন্ধ রাখতে হবে এবং বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে কর্মঘণ্টা কমাতে হবে। অক্টোবরের শুরুতে জাতীয় গ্রিড ব্যর্থতার পর বিদ্যুৎ বিভ্রাট বেড়েছে, ওই ঘটনায় দেশের ৪০ শতাংশ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অন্ধকারে ছিল। জ্বালানির ঘাটতি বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে অকার্যকর করে তোলে, ফলে মারাত্মক লোডশেডিংয়ে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি পায়, মজুরি হ্রাস পায়। সরকার একদিকে পরিস্থিতি নিরসনের সময়সীমা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে দাবি করছে দৃশ্যমান কোনো সমাধান নেই। এতে প্রমাণ হয় যে, সংকটের কাঠামোগত কারণগুলো: (ক্ষমতায় থাকার জন্য বছরের পর বছর ধরে) অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, ঘনিষ্ঠদের অন্যায্য সুযোগ দান, টেকসই নয় এমন অবকাঠামোগত উন্নয়ন মোকাবিলার কোনো ইচ্ছা আওয়ামী লীগ সরকারের নেই। 

বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ: ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ প্রশাসন ও রাজনীতির উপর আওয়ামী লীগের দৃশ্যমান নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করে, যা গত এক দশক ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং পর্যবেক্ষকরা অত্যন্ত কারচুপির বলে অভিহিত করেছেন যেগুলো শেখ হাসিনার অভূতপূর্ব বিজয় নিশ্চিত করেছে। তিনি ২০০৯ সাল থেকে একটানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো তার আমলে (২০০৯ সাল থেকে) মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্রমবর্ধমান ঘটনাসমূহ নথিভুক্ত করেছে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুম। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের বিদায়ী প্রধান মিশেল ব্যাচেলেট চলতি বছরের আগস্টে বাংলাদেশ সফরের সময় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। গত বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এই বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক সাত অফিসারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব উদ্বেগের জবাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে রয়েছে: ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারকে হয়রানি করা, প্রবাসী সমালোচকদের পরিবারকে টার্গেট করা, মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে চুপ করানো এবং উল্লেখিত মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের পুরস্কৃত করা। 

সাম্প্রতিক বিক্ষোভের শুরু থেকেই সরকার বিরোধীদলীয় কর্মী এবং সমালোচকদের উপর অত্যাচার তীব্রতর করেছে। উদাহরণস্বরূপ: জুলাই এবং আগস্টে বিরোধী নেতাদের অফিস এবং বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে, বেশ কয়েকজন কর্মী মারা গেছেন এবং হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব সত্ত্বেও, বিক্ষোভের মাত্রা বেড়েছে, যা সাম্প্রতিক সমাবেশগুলোর আকার দেখলেই বোঝা যায়। 

বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি এমন প্রযুক্তি সংগ্রহ করেছে যার মাধ্যমে টেলিগ্রাম নামক জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপের গোপন বার্তাগুলো আটকানো যাবে, অত্যাধুনিক নজরদারি ক্ষমতাকে যুক্ত করা যাবে। সরকার ২৯টি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ক্রিটিক্যাল ইনফরমেশন ইনফ্রাস্ট্রাকচার (সিআইআই) হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) আওতায় এগুলোতে অ্যাক্সেস শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে। ডিএসএ ২০১৮ সালের অক্টোবরে কার্যকর হয়েছিল যা সরকার এবং তার সমর্থকরা ভিন্নমত দমনে ব্যবহার করেছে। সরকার ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত উক্ত আইনে কমপক্ষে ২৮৮৯ জনকে অভিযুক্ত করেছে। 

এরপর: নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে : আগামী নির্বাচন কেমন হবে এবং তাতে বাংলাদেশি নাগরিকদের নির্বিঘেœ ভোট দেয়ার সামর্থ্য নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকা- ইঙ্গিত দিয়েছে যে অবাধ ও অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজনে তাদের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগ করা নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) এখনো ভোটার কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ, গত ১২ই অক্টোবর গাইবান্ধার নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা প্রায় সব ভোটকেন্দ্র দখল করার পর ‘অনিয়মের’ এর কারণে ইসি ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেয়। তবে, নির্লজ্জ কারচুপি বন্ধে ইসি পূর্বসতর্কতা অবলম্বন করেনি, ভোটের দিন ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং স্থানীয় প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করেনি। 

আগামী নির্বাচনের মধ্যেই ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) সম্পূর্ণভাবে পাওয়া যাবে- প্রধানমন্ত্রীর এমন পরামর্শের পর ৩০০ সংসদীয় আসনের অর্ধেকগুলোতে ইসি ইভিএম চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুশীল সমাজ এবং বেশিরভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ইভিএম ব্যবহারের প্রতিবাদ করলেও ইসি তাদের উদ্বেগে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। এর চেয়েও খারাপ বিষয় হলো, ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোতে ইভিএম ব্যবহারে বিরোধী দলগুলোর মতামতকে নিয়ে ইসি মিথ্যাচার করেছে। বিস্ময়করভাবে ইভিএম কেনার জন্য ৮৭১১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যেগুলোতে ভোটার-ভেরিফাইয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল’ সিস্টেম-ভিভিপিএটি (ভোট গ্রহীতার নাম ও প্রতীক সংবলিত কাগজ) নেই৷ 
বিরোধী দলগুলোও জোর দিয়ে বলেছে যে তারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না, কিন্তু আওয়ামী লীগ এই দাবি মানতে নারাজ। বেসামরিক প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নিরপেক্ষতার অনুপস্থিতিতে ২০১৮ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর নাগরিকদের মধ্য থেকে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে। এবারো পরিস্থিতি ভিন্ন নয়, কারণ পুলিশ আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করছে। একজন উচ্চপদস্থ আমলা এবং ৩ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে সরকার কর্তৃক “জোরপূর্বক অবসরে” পাঠানো এই ইঙ্গিতই দিচ্ছে যে, নির্বাচনের আগে প্রশাসন ও পুলিশকে তারা পক্ষে রাখতে চায়। 

‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে সরকার সংস্কার না করলে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই। অর্থনীতি নিয়ে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ এবং স্বৈরাচারী শাসন সম্পর্কে হতাশা নাগরিকদের তীরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সরকার জোরপূর্বক বিরোধীদের মোকাবিলা করতে চায় বলে মনে হচ্ছে। এমন অবস্থা বজায় রাখার অর্থ হলো আসছে মাসগুলোতে বিরোধীদের উপর আরও নিপীড়ন, ভিন্নমতের কণ্ঠগুলোকে আরও দমন। যাই হোক, বিরোধী দলগুলো বিভক্তই রয়ে গেছে এবং এখনো কোনো সাধারণ পদক্ষেপের বিষয়ে একমত হতে পারেনি। সবমিলিয়ে, বাংলাদেশের রাজনীতি অস্থির ভবিষ্যতকেই নির্দেশ করছে যেখানে অর্থনৈতিক দুর্দশা বাড়তে থাকবে এবং সাধারণ মানুষ ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

*যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট আলী রীয়াজের লেখাটি ২৭শে অক্টোবর সাউথ এশিয়ান ভয়েসেস (এসএভি)-এ ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে। এসএভি হলো দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ইস্যুর কৌশলগত বিশ্লেষণের জন্য ‘অনলাইন পলিসি প্ল্যাটফর্ম’ যেটি ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাংক স্টিমসন সেন্টার দ্বারা পরিচালিত।’ 

*অনুবাদ করেছেন তারিক চয়ন

News Courtesy:

https://mzamin.com/news.php?news=27320&fbclid=IwAR2faOz3oXoZRC6pQuzf_DM-3JbW7bwAbb1rzHnNdLq1UozL13lgmu9cr3Y

An unhandled error has occurred. Reload 🗙