যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন

২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে যে একধরনের শীতলতা ও টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়েছে, তা কূটনীতিকেরা ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও সহজেই বোঝা যায়। এ টানাপোড়েনের পেছনে আশু কারণ যেমন আছে, তেমনি আছে ভূরাজনৈতিক বিবেচনা ও বাংলাদেশে বিরাজমান শাসনব্যবস্থা। 

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এটা বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত কিছু পদক্ষেপের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর জন্য রাশিয়ার ওপরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করেছেন (যুগান্তর, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২)। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র​্যাব, র​্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাতজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের একটি গর্হিত কাজ বলে মনে করেন (বিডিনিউজ ২৪, ২৮ মার্চ ২০২২)। 

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আশু সম্ভাবনা নেই। ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের ভাষ্য অনুযায়ী, র​্যাবের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে অভিযোগ রয়েছে, তার সুরাহার জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ও বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নেই (প্রথম আলো, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২)। 

এ টানাপোড়েনের সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান, একটি অংশগ্রহণমূলক অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকারকে তাগিদ দেওয়া। পিটার হাসের বক্তব্যগুলো লক্ষ করলে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ব্যাপক এবং রাজনীতিতে ভিন্নমতের জায়গা সীমিত। এগুলোর সঙ্গে ‘ভয়ভীতি প্রদর্শন ও রাজনৈতিক সহিংসতা’র বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। রাষ্ট্রদূত হাস মনে করেন, ‘রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না’ (যুগান্তর, ২৬ অক্টোবর ২০২২)। 

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের মতপার্থক্য এবং জোয়ার-ভাটার মতো ওঠা-নামা থাকলেও, ২০১৪ সালের পর দুই দেশের মধ্যে এতটা টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়নি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অবাধ নির্বাচনের জন্য আহ্বান জানালেও সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করেনি। এর একাধিক কারণ ছিল। প্রথমত, ওবামা প্রশাসনের দক্ষিণ এশিয়া নীতি, যা আগের প্রশাসনগুলোর মতোই ছিল ভারতকেন্দ্রিক। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ভারতের সঙ্গে অভিন্ন ছিল। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিকভাবে চীনের উত্থানকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করেনি। তৃতীয়ত, এশিয়ার দিকে মনোনিবেশের নীতির অংশ হিসেবে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি (টিপিপি) করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছিল, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান শক্তিশালী করবে, ফলে বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়নি। চতুর্থত, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো আশা করছিল যে দুর্বল গণতন্ত্র অব্যাহত থাকবে এবং পরবর্তী নির্বাচন যত দূর সম্ভব সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে। 

আবার একই সঙ্গে এটাও স্মরণ করা দরকার যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমাত্রিক রূপ নিয়েছে। বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সহযোগিতা এই সম্পর্কের অন্যতম দিক। ২০২১ সালে বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক দেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিদেশি বিনিয়োগকারী। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি পণ্য হচ্ছে তৈরি পোশাক, যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে তৈরি পোশাকের একক বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য। অর্থনৈতিক সম্পর্কের বাইরেও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার নিরাপত্তা সহযোগিতা ১৯৮০-এর দশক থেকেই সূচনা হয়েছে এবং তা ২০০১-এর পর বেড়েছে। ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান ক্যাফেতে সন্ত্রাসী হামলার পর এই সহযোগিতা আরও বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে। 

বাংলাদেশে চীনের উপস্থিতি ও প্রভাব মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে যতটা শক্তিশালী মনে করেছিল, বাস্তবে কাজে দেয়নি। তদুপরি এই অঞ্চলে ভারতের আধিপত্য ইতিবাচক হয়নি এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অস্বস্তিকর হয়েছে। বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই বলে এসেছেন যে তাঁর সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ক্রমশ ক্ষয়সাধন, কর্তৃত্ববাদী শাসনের লক্ষণ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করেছে। এ প্রেক্ষাপটেই ২০২১ সালে গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি এবং র​্যাবের ওপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। 

সম্পর্কের এই শীতলতা সত্ত্বেও বিনা মূল্যে যুক্তরাষ্ট্র সারা পৃথিবীতে যত কোভিডের টিকা বিতরণ করেছে, তার সবচেয়ে বেশি দিয়েছে বাংলাদেশকে। এর একটি কারণ অবশ্যই মানবিক বিবেচনা, কিন্তু আরেকটি কারণ হচ্ছে, এই অঞ্চলে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। এই দুর্যোগের সময়ে বাংলাদেশ যেন আরও বেশি চীনের ওপর নির্ভরশীল না হয়, সেটা নিশ্চিত করা। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) যোগ দিয়েছে এবং চীন বাংলাদেশে বড় বড় প্রকল্পের বিনিয়োগ করছে। 

চীনের এসব পদক্ষেপ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি আইপিএসে যোগদানের অনুরোধ করে আসছে। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণে বাংলাদেশ দ্বিধার পেছনে চীনের প্রভাব রয়েছে বলেই যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন। 

চীনে ও যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিযোগিতা এ অঞ্চলের দেশগুলোর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ এখন এই প্রতিযোগিতার একটি ক্ষেত্র হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি এই প্রতিযোগিতাকে বাংলাদেশ কীভাবে মোকাবিলা করে, কী ভূমিকা নির্ধারণ করে, তার ওপরে অংশত নির্ভর করবে। আর নির্ভর করবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা গড়ে উঠছে কি না, তার ওপর।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর

News Courtesy:

https://www.prothomalo.com/anniversary/y186kt39j3

An unhandled error has occurred. Reload 🗙