‘রাষ্ট্রধর্ম রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় রাখা হয়েছে'

ডয়চে ভেলে: আপনি তো বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের কথা বলেছেন। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে বহুত্ববাদীতা এই সংবিধান কীভাবে ধারণ করবে?
আলী রীয়াজ: আন্দোলনটা ছিল বহুত্ববাদী। সেকারণেই রাষ্ট্রের যে মূলনীতি, সেখানে আমরা বহুত্ববাদের কথা বলেছি। আমি মনে করি, এর মধ্য দিয়ে যেটা হবে, সেটা হলো, সমাজে যত ধরনের মানুষ আছে, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে যারা ভিন্ন, ধর্ম পরিচয়ে যারা ভিন্ন, সামাজিক পরিচয়ে যারা ভিন্নতা ধারণ করেন, তাদের সবাইকে রাষ্ট্র সমান মার্যাদা নিশ্চিত করতে পারবে। সেক্ষেত্রে আপনি বলেছেন, রাষ্ট্রধর্ম কেন থাকবে? রাষ্ট্রধর্ম থাকার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত হয় ১৯৮৮ সালে। তারপর সব রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে। ৮টি বা ৯টি সংবিধানের সংশোধন হয়েছে। কিন্তু কেউ এটা বদলাননি। বদলাননি, এর কারণ হচ্ছে- রাজনৈতিক বাস্তবতা নিশ্চয়ই আছে। সেই কারণে বদলাননি। রাষ্ট্রধর্মের ব্যাপারে পরিপূর্ণ ঐকমত্য ছিল না। তারপরও আমরা রেখেছি, কারণ, আমরা যে অংশীজনদের সঙ্গে কথা বলেছি, তার মধ্যে বিপুল সংখ্যক বলেছেন এটা (রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম) রাখার জন্য। পিউ রিসার্চের একটা গবেষণার কথা উল্লেখ করতে পারি। তারা দেখেছে, ১৯৯ টি দেশের মধ্যে ৪২ শতাংশ দেশে হয় রাষ্ট্রধর্ম আছে অথবা একটি নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের ‘ফেবারিটিজম' আছে। তাহলে বৈশ্বিকভাবে এটা আছে। রাষ্ট্রধর্মের ক্ষেত্রে এই বিবেচনাটা আমরা রেখেছি যে, এটার আইনি কোনো প্রতিক্রিয়া হয় কিনা। ১৯৮৮ সাল থেকে আমরা যেটা দেখেছি, এটা আসলে অংশত সিম্বলিক হয়ে পড়েছে। বৃটেনেও কিন্তু একটি বিশেষ নির্দেশিত ধর্মের প্রতি পক্ষপাত আছে। আবার ইরানেও রাষ্ট্রধর্ম আছে। আসলে নির্ভর করছে কীভাবে রাষ্ট্রধর্ম ব্যবহার হচ্ছে। এইসব কিছু আমরা বিবেচনা করেছি। কিন্তু এটা বহুত্ববাদিতার বিপরীতে নয়।
আদর্শিক অবস্থাটা কী হওয়া উচিত? ধর্মনিরপেক্ষতা, না রাষ্ট্রধর্ম? বিতর্কটা কোথায়?
আপনি বাংলায় যেটাকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলছেন, ইংরেজিতে সেটা সেক্যুলারিজম হিসাবে ব্যবহার করে, যদিও অনুবাদটা সঠিক নয়। খ্রিস্টধর্মের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যে সংঘাত, তারই পটভূমিকায় ইউরোপে সেক্যুলারিজম তৈরি হয়েছে। এই সেক্যুলারিজম প্রশ্নে গত তিন দশকে অ্যাকাডেমিক জগতে বড় ধরনের বিতর্ক আছে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা আছে৷ ধর্মনিরপেক্ষতার যে ধারণাটা অ-পশ্চিমি সমাজে প্রযুক্ত হচ্ছে, সেটা এই সমাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিনা? তার মানে হলো, আমাদের চেষ্টা করতে হবে এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করার, যেখানে কেবল ধর্মের বিবেচনা না, ধর্ম এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে সকলের সমান মর্যাদা তৈরি করা- সেটার জন্য আমরা গণতন্ত্রের কথা বলছি, সাম্যের কথা বলছি, মানবিক মর্যাদার কথা বলছি।
কোনো ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করা কি অন্য ধর্মকে সাপ্রেস করে?
এটা যদি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে করে, তাহলে বলবো যে, না, রাষ্ট্রধর্ম থাকার প্রয়োজন নাই। মানে, রাষ্ট্রধর্ম যদি আইনি প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যে আইনগুলো আছে, সেগুলো কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম দিয়ে প্রভাবিত হয়নি, ধর্ম দিয়ে প্রভাবিত হয়নি। এখানে পার্সোনাল ল'গুলো ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। তা রাষ্ট্রধর্ম হওয়ার আগেই। এগুলোর বিরোধিতা আছে, সমালোচনা আছে- আবার সমর্থনও আছে। রাষ্ট্রধর্ম থাকার ব্যাপারে আপনি যদি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে প্রশ্ন করেন, তাহলে এটার প্রতি আমার তেমন পক্ষপাত নাই। তবে এই ক্ষেত্রে যেটা বিবেচনা করতে হয়েছে, সেটা হচ্ছে, রাজনৈতিক বাস্তবতা। এটা সিম্বলিক, না সাবষ্ট্যানটিভ ? অমরা এটাকে সিম্বলিক হিসাবে বিবেচনা করছি।
রাষ্ট্রধর্মের ভিত্তিতে যদি আইন প্রণয়ন করা হয়, তা নিবৃত্ত করার প্রটেকশন কি সংবিধানে আছে?
রাষ্ট্রধর্মের ভিত্তিতেই শুধু নয়, কোনো ধরনের এই প্রণয়নের প্রশ্নে, সেটা যদি মৌলিক মানবাধিকারের বিরুদ্ধে হয়, তাহলে অবশ্যই সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সেখানে আমরা বলছি, মানবাধিকার লঙ্ঘন করে এরকম কোনো আইন যদি নিম্নকক্ষ পাশ করে, তাহলে সেটা উচ্চকক্ষে গিয়ে বাতিল হতে পারে। আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলেছি। যদি কোনো আইন রাষ্ট্রে অসাম্য তৈরি করে, তাহলে সেটা আদালতের প্রটেক্ট করার কথা।
আপনারা মোটামুটি সাত ধরনের বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন, যার মধ্যে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য অন্যতম। আপানারা ন্যাশনাল কনস্টিটিউশন কাউন্সিল (এনসিসি) কথা বলেছেন। এখন আপনারা যে অন্তর্বর্তী সরকারের কথা বলেছেন (তিন মাস মেয়াদ), সেটার গঠন নিয়ে জটিলতা হলে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি তার প্রধান হবেন। তাহলে তিনি হবেন রাষ্ট্রপতি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান, এনসিসি প্রধান। আবার এনসিসিতে তার মানোনীত দুই প্রতিনিধি ধাকবেন। তাহলে ওই পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি ভীষণ ক্ষমতাবান হয়ে যাবেন না? বিষয়টা কি ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করবে?
হ্যাঁ করবে। যদি আপনি শেষ পর্যন্ত মোস্ট আনপ্যালেটেবল অটশনটিতে যান। এর আগে অনেকগুলো অপশন আছে। সেইসব অপশন ব্যর্থ হলে ওই পর্যায়ে যেতে হবে। আমরা আশা করি সেই পর্যায়ে যেতে হবে না।
হ্যাঁ, আমাদের উদাহরণ আছে। তখন কিন্তু কে সিদ্ধান্ত নেবে, সেই ব্যবস্থা ছিল না। ছিল রাষ্ট্রপতি একক সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা যে ন্যাশনাল কনস্টিটিউশন কাউন্সিলের প্রস্তাব করেছি, সেখানে কিন্তু সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা থাকছেন, বিরোধী দল থেকে আসাসহ দুইজন ডেপুটি স্পিাকার থাকবে। প্রধান বিচারপতি থাকবেন। ফলে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে কেউ কিছু করছে না। সেকারণে এটাকে আমরা একেবারে শেষ জায়গায় রেখেছি। যদি কোনো সমাধান না পাওয়া যায়, তাহলেও নির্বাচন তো করতে হবে। সেজন্য এটা শেষ ব্যবস্থা।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরির প্রস্তাব করেছেন। মেয়াদও কমিয়ে চার বছর করার কথা বলেছেন। বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে। প্রধান বিচারপিতর ক্ষমতা কমছে না। তাহলে জুডিশিয়াল ক্যুর আশঙ্কা তৈরি করবে কিনা...
না, আশঙ্কা তৈরি হবে না। কারণ, আমরা যে শুধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করেছি, তা নয। রাষ্ট্রপতিকে সব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেতে হবে না। আমরা প্রতিষ্ঠানও তৈরি করেছি। আমরা এনসিসি তৈরি করেছি। ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করার কথা বলেছি। কারণ, অন্যথায় প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের কোনো পদ্ধতি নাই। এর ফলে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহিতা তার দলের সংসদ সদস্যদের কাছেই চলে যাবে। আমরা সংসদীয় কমিটিগুলোর প্রধান বিরোধী দল থেকে করার কথা বলেছি। প্রধানমন্ত্রী ডিফেন্স ফোর্সেস-এর তিন প্রধানকে নিয়োগ দিতে পারবেন না। তার মানে, বহুভাবে আমরা ক্ষমতা ভাগ করে দিচ্ছি।
৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল হলে ফ্লোর ক্রস করা যাবে। সেটা আবার সরকারের পতন ঘটাতে এমপি কেনা-বেচার নতুন আরেক ধরনের আশঙ্কা তৈরি করবে?
স্পিরিটটা হলো প্রধানমন্ত্রীকে নিজ দলের কাছে জবাবদিাহিতার আওতায় আনা। ২০২২ সালে বৃটেনে ছয় মাসের মধ্যে তিনজন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু কনজারভেটিব পার্টি ক্ষমতা খেকে সরে যায়নি। এখানে হর্স ট্রেডিং হওয়ার আশঙ্কা নাই। যদি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দলের এমপিদের আস্থা না থাকে, তাহলে রাষ্ট্রপতি দেখবেন ওই দলের অন্য কারুর প্রতি আস্থা আছে কি না। সেক্ষেত্রে বিরোধী দলের কাছে যেতে হবে, তা কিন্তু নয়।
দুই কক্ষের সংসদের কথা বলেছেন। কিন্তু উচ্চ কক্ষ তো কোনো আইন প্রণয়ন আটকাতে পারবে না। তাহলে উচ্চ কক্ষ কি অলংকারিক হয়ে গেল না? তাহলে উচ্চ কক্ষের রোলটা কী হবে?
যে-কোনো ধরনের আইন যখন প্রণয়ন হবে, তখন যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়, তখন উচ্চ কক্ষ ইন্টারভেন করতে পারবে৷ যদি তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়, তাহলে তারা ফেরত পাঠাতে পারবে। তাহলে কী হবে? ওই একই আইন একই অধিবেশনে পাশ করা যাবে না। তাহলে জনগণ জানবে। তারা চাপ প্রয়োগ করবে। আলোচনা- সমালোচনা হবে। একটা রাজনৈতিক দলের পক্ষে কি সেটা অগ্রাহ্য করা সম্ভব? ফলে উচ্চ কক্ষ অর্নামেন্টাল নয়। ডেমোক্র্যাটিক প্রেশার তৈরি করবে।
প্রিঅ্যাম্বেলে পরিবর্তন এনেছেন। মুক্তিযুদ্ধ আছে, ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান আছে। তাহলে ৯০-এর গণভ্যুত্থান থাকবে না কেন?
আমরা ধারবাহিক বর্ণনা করছি না। আমরা দেখছি, চেতনার দিক থেকে। আমরা ধারাবাহিকতার কথা বলছি। ১৯৭১ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে আরো অনেক গণতান্ত্রিক সংগ্রাম আছে। তালিকা নয় যে, কতবার বাংলাদেশের মানুষ চেষ্টা করেছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছি, কারণ, মুক্তিযুদ্ধকে বাদ দিয়ে তো বাংলাদেশ নয়। বাংলাদেশের আদর্শের কথা যা বলছি, যেটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে আছে, যেটা আসলে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান। তার পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের যে গণতন্ত্রের আকাঙ্খা, আমরা সেটার কথা বলছি। তার সঙ্গে আমরা বলছি বহুত্ববাদীতা। ২০২৪-এর যে গণঅভ্যুত্থান, এটা অভূতপূর্ব। এরকম আগে আমরা কখনো দেখিনি। এটাকে আমরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে গণতন্ত্রের আকাঙ্খার একটা ব্রিজ হিসেবে দেখছি।
আমাদের এখানে যারা ল'মেকার তারা স্থানীয় উন্নয়নে খুব অংশ নেন, যেটা তাদের মূল কাজ না। তার ফলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বিকশিত হতে পারে না। এখনো সেটাই যদি থাকে, তাহলে তো একই অবস্থা হবে। টাকা খরচ করে নির্বাচনে পাশ করে এমপি সহেব এলাকার জন্য কিছু করলো না। তাহলে ডিফারেনশিয়েট কীভাবে করা হলো?
আমরা সেটা করেছি। আমরা কিন্তু স্পষ্ট করে বলেছি, স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এমপিদের কোনো ভূমিকা থাকবে না। আমরা মনে করি, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী না হলে আপনি গণতন্ত্র তৃণমূলে নিয়ে যাচ্ছেন না। আরেকটা হচ্ছে, আমরা আমলাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে দেখতে পাই। এই দুইটিকেই আমরা ‘না' বলেছি। আমরা স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত করেছি। প্রেসিডেন্টের যে ইলেক্টোরাল কলেজের কথা আমরা বলছি। সেখানে কিন্তু তাদের একটা ভূমিকা থাকবে। বাংলাদেশের আদালতে মামলা হয়েছিল, এমপিদের যে থোক বরাদ্দ দেয়া হয়, সেটা বেআইনি। প্রাথমিক রায় কিন্তু এমপিদের থোক বরাদ্দের বিরুদ্ধেই গিয়েছিল। কিন্তু পরে আর আদালতে মামলাটি এগোয়নি। এখনো আদালতেই আছে।
আপনারা যে ন্যাশনাল কন্সটিটিউশন কাউন্সিল(এনসিসি)-র প্রস্তাব করেছেন, তা রাষ্ট্রের চারিত্রিক পরিবর্তন কতটা করতে পারবে?
এটা হবে একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ একসঙ্গে বসবে, কথা বলবে, সিদ্ধান্ত নেবে, আলোচনা করবে। পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে নয়, সংসদে আমরা কী দেখি ট্রেজারি বেঞ্চ এবং বিরোধী দল মুখোমুখি।এটাই গণতন্ত্র। কিন্তু এখানে(এনসিসি) রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইনসভা একসঙ্গে বসবে। এটা সহযোগিতা এবং গর্ভনেন্সের দিক থেকে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।
এটা কি তেমন কোনো পরিবর্তন আনে, যদি বলা হয়, জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ? আমাদের নাগরিকত্ব তো বাংলাদেশি হয়েই আছে। বাঙালি জাতীয়তা বা কোনো জাতীয়তা কী ভূখণ্ড দিয়ে সব সময় নির্ধারণ করা যায়? আর চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির তিনটিই বাদ কেন?
রাষ্ট্রীয় মূলনীতি যেটা আগে করা হয়েছে, তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিশ্রুতি তার প্রতিফলন নাই। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে প্রতিশ্রুতি, যে অঙ্গীকার এই রাষ্ট্র করেছে, সেটাকে আমরা প্রতিফলিত করতে চাই। সে কারণে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের সঙ্গে অন্যগুলোকে যুক্ত করেছি। আরেকটা কারণে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পরিবর্তনের প্রশ্ন আছে। যে মূলনীতি আমরা দেখি ওটা একটা রাজনৈতিক দলের আদর্শের প্রতিফলন। মূলনীতি পরিবর্তনের আরেকটি কারণ আছে। ১৯৭২ সালে যখন সংবিধান প্রণীত হয় নাই, গণপরিষদে যখন আলোচনা শুরু হয়, তখন ফেব্রুয়ারি মাস থেকে একটি রাজনৈতিক দল চার মূলনীতি যেটা, সেটার কথা বলে। আক্টোবর মাস পর্যন্ত কিন্তু আমরা সংবিধান পাইনি। কিন্তু তার আগেই বলা হয়েছে এগুলো রাষ্ট্রীয় মূল নীতি। একটি রাজনৈতিক দলের আদর্শকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি করা হয়েছে। ওই রাজনৈতিক দলকে বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই মূলনীতিগুলো বাদ দেয়া হয়েছে। আর যে বিষয়গুলো আপনি বললেন, যেমন, নাগরিকতা-এটা কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে আছে যে, নাগরিকরা বাংলাদেশি বলে পরিচিত হবে। কারুর পরিচিতি জাতি হিসাবে বাঙালি। সেটাকে আমরা সংবিধানে না রাখার জন্য বলেছি, কারণ, বাংলাদেশ তো বহু জাতির দেশ। এখানে সকলে বঙালি নয়। অবাঙালি আছে, গারো আছে।
একটি জাতি তো বিভিন্ন দেশে থাকতে পারে। আরব জাতি তো শুধু সৌদি আরবে - তা তো নয়। রাষ্ট্রীয় সীমা দিয়ে কি সব সময় জাতীযতা নির্ধারণ করা যায়?
আমরা তো সেটাই বলছি। এটা সংবিধানে থাকার দরকার নাই। আপনাকে তো কেউ বাঙালি হতে বাধা দিচ্ছে না। আপনি বাংলাদেশের বাঙালি হতে পারেন, পশ্চিম বাংলার বাঙালি হতে পারেন, প্রবাসী বাঙালি হতে পারেন। সংবিধান যখন বলছে, বাংলাদেশের নাগরিকদের সবাইকে বাঙালি হতে হবে, তখন সেটা আমরা বাদ দিয়ে দিয়েছি। আর গণপ্রজাতন্ত্রী মানে হলো প্রজা আছে। প্রজা তো হতে পারে না। প্রজা শব্দটার মধ্যে একটা সামন্ততান্ত্রিক বিষয় আছে। আমরা সবাই তো সমান হতে চাই। একটা রিপাবলিকে তো প্রজা থাকবে না। এটা কিন্তু অনেক আগে থেকেই আলোচনায় আছে। তাই আমরা জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ করেছি।
সংবিধান সংস্কারের এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হবে কীভাবে?
এটার জন্য একটা জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হবে, তার ভিত্তিতে একটা চার্টার তৈরি করা হবে। তারপরে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বের করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোও কিন্তু সংস্কার চায়। এখন যে বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলো গণভোটে দেয়া যায়। তখন একটা বাইন্ডিং তৈরি হবে। আবার রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়ে বলতে পারে, ‘ঠিক আছে, আমরা এগুলো পরে বাস্তবায়ন করবো, আমরা প্রতিশ্রুতি দিলাম। দেশের মানুষ জানলো। এটা সবাই একমত হলে একটা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যেও হতে পারে। এটা মোটেই চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। আমাদের যে জাতীয ঐকমত্য কমিশন হয়েছে, তার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সহসাই এ ব্যাপারে আলোচনা শুরু হবে।
আপনার এই কাজ শেষে আপনি কি আপনার আগের জায়গায় ফিরে যাবেন?
হ্যাঁ। আমি আমার শিক্ষকতায় ফিরে যাবো। আপনি আমার পিছনের দেয়ালে লক্ষ্য করুন। এখানে আবু সাঈদের ছবি। আমি প্রতিদিন যখন আসি, তখন ওই ছবিটার দিকে তাকাই। এরা আমাকে এখানে দায়িত্ব দিয়েছে- যারা প্রাণ দিয়েছে, আহত হয়েছে। প্রফেসর ইউনূস তো তাদের হয়ে আমাকে কাজটা দিয়েছেন। আমি যতটুকু পারি দায়িত্বটা পালন করবো। এই দায়িত্ব পালনের পরে আমি আমার আগের কাজ শিক্ষকতায় ফিরে যাবো
News Courtesy: