একই প্রক্রিয়ায় ভিন্ন ফল আশা করে লাভ নেই
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো। রাজনীতি ও ধর্ম বিষয়ে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও ধর্মবাদী রাজনৈতিক তৎপরতা নিয়ে গবেষণার জন্য এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বহুল আলোচিত। বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন এ সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইমতিয়ার শামীম
সমকাল: রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থানকে কীভাবে দেখছেন? এই অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আনতে পারে কি?
আলী রীয়াজ: বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য তিনটি দেশ- ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতোই। তবে সেই তুলনায় নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপের অবস্থান ভিন্ন। এইসব দেশের নীতিগত অবস্থানটাই ভিন্ন। বাংলাদেশের যে নীতিগত অবস্থান বা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভোটদানে বিরত থাকার বিষয়টি আমি মনে করি, সঠিক নয়। কেননা এই প্রস্তাবের প্রধান বিষয় ছিল ক্ষুদ্র দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। বাংলাদেশের উচিত ছিল এই প্রশ্নে নীতিগত অবস্থান নেওয়া। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনাই প্রাধান্য পেয়েছে; বাংলাদেশ যে অবস্থান নিয়েছে, তার বিবেচনাটা রাজনৈতিক। কারণ সে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককেই গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশের এই অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে, এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে ভবিষ্যতে বা আর কয়েকদিনের মধ্যে ভারত যদি তার অবস্থান পরিবর্তন করে, বাংলাদেশ কী অবস্থান নেবে, সেটি বিবেচনার বিষয়। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় না। যা ইঙ্গিত দেয় তা হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও রাশিয়ার প্রভাব বেড়েছে।
সমকাল: বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার আপনার মূল্যায়নকে ধরেই বলা চলে, দেশে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনকাল চলছে, এরকম অভিমতও খুব প্রবল। সেই নিরিখে বিশ্বরাজনীতিতে ও দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে সংঘটিত সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো, যেমন- ইউরোপে যুদ্ধাবস্থাজনিত অবস্থা, চতুর্ভুজীয় সুরক্ষা সংলাপ বা কোয়াড ইস্যু, দেশে র্যাবের ক্ষেত্রে মার্কিন প্রশাসনের কিছু নিষেধাজ্ঞা, রাশিয়ার সঙ্গে চলমান বাণিজ্যিক সম্পর্কের মতো বিষয়গুলো- এই কর্তৃত্ববাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে কি কোনো ভূমিকা রাখতে পারে?
আলী রীয়াজ: বাংলাদেশের এখনকার যে শাসন ব্যবস্থা, আমি বলি কর্তৃত্ববাদী শাসন, নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদী শাসন- ইলেকটোরাল অথরিটারিয়ানিজম। আপনি যেগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর একটা প্রভাব তো অবশ্যই থাকবে। একটা প্রধান দিক হচ্ছে, অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হবে। এরই মধ্যে ইউক্রেনের যুদ্ধাবস্থা বাংলাদেশের ওপর এক ধরনের অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করেছে। বিজিএমইকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে যে, তারা রাশিয়ার সঙ্গে এখন কোনো রকমের ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত থাকবে কিনা। কিংবা ধরুন, রূপপুর আণবিক প্রকল্প কীভাবে অব্যাহত রাখা যাবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তেলের দাম বেড়েছে। তার প্রভাব পড়ছে দ্রব্যমূল্যের ওপরে। এরই মধ্যে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি কী দাঁড়িয়েছে- আপনি আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবেন। এর পাশাপাশি আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার, একটা রাজনৈতিক দিক তো অবশ্যই আছে, অর্থনৈতিক দিকও আছে। এগুলো অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করবে। সাধারণ মানুষের জন্যে যে অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার ওপর প্রভাব ফেলবে; তদুপরি আপনি যে ভূ-রাজনৈতিক চাপের কথা বলছেন, সেটা তো বাড়বেই। ইতিমধ্যেই বেড়েছে এবং বাড়তে থাকবেই। ধরুন, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে যখন র্যাব এবং র্যাবের কয়েকজন অফিসারের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, তার পরে এবং তার আগেও বাংলাদেশের ওপর এক ধরনের চাপ ছিল এবং সেটা বেড়েছে। এখন এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের এই অবস্থান যেহেতু সুস্পষ্টভাবে অন্য দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, সেহেতু ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব থেকে শুরু করে কূটনৈতিক চাপ বাড়বে এবং তা অব্যাহত থাকবে।
এখন কথা হলো, কর্তৃত্ববাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে কীভাবে সেটা ভূমিকা রাখবে? কর্তৃত্ববাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের কাজ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ। এখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আগামী দিনগুলোতে বৈশ্বিক অবস্থা আরও জটিল হবে। তার প্রভাব পড়বে। কিন্তু আমি মনে করি, সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে- সাধারণ মানুষের ওপর যে চাপ তৈরি হচ্ছে, এটা তারা কীভাবে নেবে। মানুষের মতপ্রকাশের জায়গাগুলো খুব সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দল আসলে সক্রিয় নয়। প্রধান বিরোধী দল সক্রিয় নয়। বিভিন্ন কারণে সক্রিয় নয়। চাপের কারণে নয়, অভ্যন্তরীণ কারণে নয়, সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে নয়। ফলে অভ্যন্তরীণ, বৈশ্বিক দুইয়েরই প্রভাব পড়বে। যে কোনো ছোট দেশের ওপরই এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে এবং এই প্রভাব পড়ার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান।
সমকাল: এরকম একটা ধারণা আছে যে, র্যাবের বিরুদ্ধে বাইডেন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার পেছনে মানবাধিকার ইস্যু বড় ভূমিকা রেখেছে। আবার এরকম কথাবার্তাও রয়েছে, দৃশ্যমান পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, এ ক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু অন্যতম কারণ। আপনার কী মনে হয়?
আলী রীয়াজ: বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত। পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। গত বছরগুলোতে, প্রকৃতপক্ষে গত এক দশকে, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, এগুলো অত্যন্ত উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে এবং এগুলোর মধ্য দিয়ে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে। চাপ তৈরি করা হয়েছে। কেননা সরকারের লক্ষ্যই হচ্ছে, এই ধরনের চাপ এবং ভীতি তৈরি করে জনগণের মধ্যে এমন এক ধরনের রাজনৈতিক নিষ্ফ্ক্রিয়তা তৈরি করা, যেগুলো তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকতে সাহায্য করবে। ফলে মানবাধিকার পরিস্থিতির জায়গা থেকে যদি আপনি দেখেন, এই উদ্বেগটা স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্র বলা বা না বলায় কিছু আসে যায় না। আপনি একজন সাংবাদিক হিসেবে যেমন, বাংলাদেশের রাজনীতির একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে আমিও তেমনই বুঝতে পারি, পরিস্থিতি ভালো নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পেছনে যে দৃশ্যত এবং কার্যত মানবাধিকার একটি বড় বিষয়, সে বিষয়ে সংশয়ের কোনো কারণ নেই। আবার, কোনো রাষ্ট্র যখন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সে কি কেবলমাত্র একটি বিষয় বিবেচনা করে? অবশ্যই না। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন যে, এই নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের দেওয়া বক্তব্যে বলা হয়েছে, তারা মনে করছে যে, বাংলাদেশের এইরকম বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুম এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে হুমকি।
প্রশ্ন হলো, ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনা কি গুরুত্ব পেয়েছে? অবশ্যই পেয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থানের কারণেই পেয়েছে। কারণ ভূ-রাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়াসহ গোটা এশিয়ার দেশগুলো যে ভূমিকা গ্রহণ করছে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থানটা এখন কী? দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অবস্থানে ক্রমাগত চীনের দিকে হেলে পড়ার লক্ষণ আছে। যেটা, অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক নয়। ফলে একেবারে ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু ভূমিকা রাখেনি, এটা যারা বলছেন, তাদের সঙ্গে একমত নই কোথাও। তবে প্রধান বিষয় কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি এবং এর সঙ্গে আরও যুক্ত আছে নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন, রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্ন। সব কিছু মিলিয়েই আসলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই চাপটা তৈরি করা হয়েছে। সেটা যে ডিসেম্বর মাসে হঠাৎ স্পষ্ট হয়েছে, তা নয়। বাইডেন প্রশাসন যখন ক্ষমতায় আসে, যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের নির্বাচনের পরপরই কিন্তু এই আলোচনা ছিল যে, নতুন প্রশাসন এসব ইস্যুকে গুরুত্ব দেবে। এখন সেটাই করছে। এক ধরনের আদর্শিক অবস্থান থেকে করছে, কৌশলগত অবস্থান থেকে করছে, পররাষ্ট্রনীতির কারণে করছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করা এবেং অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগটা কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের ছিল। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, বাংলাদেশ সেই সুযোগটা ব্যবহার করেনি। কিন্তু এখনও সময় আছে। সময় আছে এই অর্থে যে, এগুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ এবং কার্যকর সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। র্যাবের প্রশ্ন উঠেছে, মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রশ্ন উঠেছে। এগুলোর মীমাংসা কেবলমাত্র এড়িয়ে গিয়ে হবে না, অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে হবে না। গুম হয়ে যাওয়া পরিবারের ওপর চাপ তৈরি করে হবে না। লবিস্ট নিয়োগ করে হবে না। কিংবা ধরুন, যুক্তরাষ্ট্রে ওই যে আইনজীবী প্রতিষ্ঠান নিয়োগের কথা বলা হচ্ছে তা দিয়েও হবে না। অভ্যন্তরীণভাবেই কিছু কিছু সংস্কার করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় যেতে হবে। মনে রাখা দরকার, অর্থনৈতিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একটা বড় বাজার এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতা আছে। এবং সেটা যে কেবল কূটনৈতিক ক্ষেত্রে, তা নয়; নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটা গভীর সহযোগিতা আছে। এগুলো যেন কোনোভাবেই বিপর্যস্ত না হয় সেটা বিবেচনা করেই বাংলাদেশের উচিত হবে আলোচনা করা, সংস্কার করা, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করা।
সমকাল: আপনি কি বলতে চাইছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজনীয়তা ছিল...
আলী রীয়াজ: আমি বুঝিয়েছি যে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের বিষয়ে মনোযোগ দেওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তাদের তা-ই করার কথা। নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন ছিল, এভাবে বলার চেয়েও আমি বলতে চাচ্ছি যে, নিষেধাজ্ঞার যে কারণ, সে কারণগুলো উপস্থিত ছিল এবং সরকারের উচিত ছিল সেগুলো মোকাবিলা করা। দীর্ঘ এক দশক ধরে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে। গুম কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যা- এগুলো তো যুক্তরাষ্ট্র বলায় না-বলায় কিছু যায় আসে না। এগুলো তো বাস্তব। তাই না? ফলে এটা অস্বাভাবিক নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। আসলে দেশের নাগরিক সমাজ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো আগে থেকেই এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল। সরকার কোন কারণে অস্বীকার করেছে; কিন্তু অস্বীকার করলেই তো আর বাস্তবতা উধাও হয়ে যায় না।
সমকাল: আপনার কি মনে হয় যে, বাংলাদেশের ঘোষিত কূটনৈতিক নীতি যা-ই হোক না কেন, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক সম্পর্ক পশ্চিমা বিশ্ব ও এশিয়ার আঞ্চলিক ক্ষেত্রে একটি নীরব স্নায়ুযুদ্ধ সৃষ্টি করতে চলেছে?
আলী রীয়াজ: প্রকৃতপক্ষে ইতিমধ্যেই এ ধরনের পরিস্থিতির সূচনা হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের এই সম্পর্ক তো শুধু বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক নয়, এর একটা রাজনৈতিক দিকও তো আছে, তাই না? আপনি যে নীরব স্নায়ুযুদ্ধের কথা বলছেন, তার হিসাব থেকে ভারতকে বাদ দিয়েছেন। আপনি উল্লেখ করেছেন রাশিয়া ও চীনের কথা। ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে গত প্রায় এক দশক ধরে একটা বড় রকমের ভূমিকা পালন করে আসছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রকৃতপক্ষে ভারতের এখন সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তেমন ইতিবাচক নয়। ফলে আপনি যে স্নায়ুযুদ্ধের কথা বলেছেন, তা এরই মধ্যে উপস্থিত এবং সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঘোষিত কূটনৈতিক অবস্থানের চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, জাতীয় স্বার্থে এই রাষ্ট্র কী ভূমিকা পালন করছে। এবং না করে থাকলে কী বিবেচনায় করা হচ্ছে না। দীর্ঘদিন যাবৎ যুক্তরাষ্ট্র এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় তেমন একটা মনোযোগ দিচ্ছিল না। যদিও ওবামা প্রশাসনের সময় এশিয়া প্যাসিফিকের কথা বলা হয়েছিল এবং ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। ট্রাম্পের সময় সেগুলো বাদ দেওয়া হয়। এখন সেগুলো আবারও গুরুত্ব পাচ্ছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র এখানে যুক্ত হওয়ায় এই যে নতুন সমীকরণ, সেখানে রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত- সকলে মিলেই এক ধরনের টানাপোড়েনে আছে। সেই টানাপোড়েনের মধ্যেই পড়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে তার জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।
সমকাল: বিশ্ব রাজনীতির নতুন এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পক্ষে বর্তমানে রোহিঙ্গা সংকট থেকে উত্তরণের গতি ত্বরান্বিত করা কতটুকু সম্ভব?
আলী রীয়াজ: সম্ভাবনা কম। প্রায় নাই-ই, বলতে পারেন। বরং সংকট অব্যাহত থাকবে। রোহিঙ্গা সংকট আসলে ইস্যু হিসেবে এখন অনেক পেছনে চলে গেছে, এই ইউক্রেন সংকটের কারণে। কিংবা ধরুন, রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের টানাপোড়েনের কারণে। চীন এখন মনোনিবেশ করবে অন্যত্র। একইভাবে, মিয়ানমারের গণতন্ত্রের প্রশ্নও কিন্তু এখন পেছনের দিকে চলে গেছে। তাই না? অথচ এই কিছুদিন আগেও সেটা বেশ গুরুত্ব পাচ্ছিল। ফলে আমি বরং এখন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের সম্ভাবনা আরও কম দেখতে পাই। এমনিতেই তা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছিল, এখন সার্বিকভাবে বৈশ্বিক ক্ষেত্রে ইউক্রেন সংকট ও ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা বিশ্বের মনোযোগও সেইদিকে। চীনের মনোযোগও ওইদিকেই থাকবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন কোনো অবস্থায়ই আসলে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেনি। বাংলাদেশ আসলে চীনের ওপর এমন কোনো চাপ তৈরি করতে পারেনি, যাতে চীন ভিন্ন ভূমিকা নেবে। ফলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে কোনো রকম অগ্রগতি আগামীতে আশা করি না। দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু এটাই বাস্তবতা।
সমকাল: রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের ভেতর কোন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে চলেছে?
আলী রীয়াজ: বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণে দেশে এক ধরনের অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হচ্ছে- এই সংকট সাধারণ নাগরিকদের জন্য। তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি ভবিষ্যতে একটা বড় ধরনের সংকট হিসেবেই উপস্থিত হতে পারে। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটের যে সমাধান, সেই সমাধান তো আসলে বাংলাদেশের হাতে ছিল। বাংলাদেশের গোড়াতেই উচিত ছিল, যেসব বন্ধু আছে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। চীনের সঙ্গে এক ধরনের দরকষাকষি করা দরকার ছিল, বাংলাদেশ তা করতে পারত। চীনের যে অভাবনীয় প্রভাব আছে মিয়ানমারের ওপর, সেটা বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারেনি। বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করেছে বটে; কিন্তু চীনের কাছ থেকে যে খুব বেশি আদায় করতে পেরেছে, তা নয়। ফলে ভবিষ্যতে এগুলো এক রকমের কাঁটা হিসেবেই থাকবে। বাংলাদেশের ভেতরে সমস্যা তৈরিতে রোহিঙ্গা শরণার্থী ডিটারমাইনিং ফ্যাক্টর নয়। রোহিঙ্গা সংকট আছে, থাকবে এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে এখন যে পরিস্থিতি, এই স্থিতাবস্থাকেই রক্ষার জন্য চেষ্টা করতে হবে বা সরকার সেটাই করছে। এর কোনো বিকল্প আমি দেখতে পাচ্ছি না।
সমকাল: চীনের সঙ্গে দরকষাকষির কার্ড হিসেবে কোয়াড কতটুকু কার্যকরী ছিল? কোয়াডে যোগদানই বা বাংলাদেশের পক্ষে কতটুকু কার্যকর হতে পারে?
আলী রীয়াজ: প্রশ্নটা কোয়াডে যোগ দেওয়ার প্রশ্ন নয়, বাংলাদেশকে কোয়াডে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কিনা, তাও তো স্পষ্ট নয়। প্রশ্নটা হচ্ছে, বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থ দেখছে কিনা। যুক্তরাষ্ট্র তার ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি বা আইপিএস-এ বাংলাদেশের একটা ভূমিকা আছে বলে মনে করে। বাংলাদেশ বিষয়টি বিবেচনা করবে বলে জানিয়েছিল। কিন্তু তার কোনো উত্তর দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। চীনের সঙ্গে দরকষাকষির অর্থে নয়, বাংলাদেশকে দেখতে হবে যে, এই অঞ্চলে সে নিজে একটা অ্যাক্টর হবে, নাকি আঞ্চলিক দুটি শক্তির এই টানাপোড়েনের মধ্যে থাকবে। বাংলাদেশকে সেইভাবেই বিবেচনা করতে হবে।
সমকাল: সম্প্রতি যে কয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে, অনেকের মতে, তার প্রতিটিই নির্বাচনের প্রতি মানুষকে আস্থাহীন করে তুলেছে। নতুন নির্বাচন কমিশন কি এ ক্ষেত্রে আশার আলো জ্বালতে পারে?
আলী রীয়াজ: তার কোনো সম্ভাবনা দেখি না। সম্ভাবনা দেখি না একাধিক কারণে। এই নির্বাচন কমিশন নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই প্রশ্নবিদ্ধ, অস্বচ্ছ হলো শেষ পর্যন্ত। যারা সার্চ কমিটির কাছে গিয়েছিলেন, বিশেষত সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, সরকারের সুবিধাভোগীদের যেন কমিশনের সদস্য না করা হয়। অথচ দেখুন, এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশনার যাকে করা হয়েছে, তার অতীত কার্যক্রম দেখায় যে, তিনি এই সরকারের বিভিন্ন রকম সুবিধা লাভ করেছেন।
তদুপরি তিনি এমন সব মন্তব্য করেছেন, যেগুলো আসলে কমিশনের ব্যাপারে তেমন কোনো আস্থা তৈরি করে না, যেগুলোতে বরং গত নির্বাচনগুলোর প্রক্রিয়াকে এক ধরনের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। অতীতের নির্বাচন কমিশনের যেসব ভুলভ্রান্তি ছিল, সেগুলো মোকাবিলা করে, সেগুলো চিহ্নিত করে, সেগুলো এড়ানোর ও পুনরাবৃত্তি রোধের চেষ্টা করার কথা ছিল তাদের। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন যে, তিনি অস্ট্রেলিয়ায় থেকে ২০১৮ সালে দেখতে পেয়েছেন যে, দিনে নির্বাচন হয়েছে। এ ধরনের বিতর্কিত মন্তব্য আসলে তাদের ব্যাপারে আস্থার জায়গা তৈরি করে না। ফলে আমি যে শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্যে গঠিত এই নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে আশাবাদী হচ্ছি না, তা নয়- আমি এ-ও মনে করি, যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, তার পক্ষে এককভাবে কোনো অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। তার জন্য দরকার এমন একটা সরকার ব্যবস্থা যেটি আসলে এই ধরনের নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবে। সেই প্রশ্ন মোকাবিলা না করে, নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না করে, কেবল কমিশন গঠনকে খুব আশার বিষয় বিবেচনা করার কোনো কারণ নেই।
সমকাল: তার পরও যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়, সে ক্ষেত্রে কোন কোন ইস্যু সরকারি ও বেসরকারি দলগুলোর ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন?
আলী রীয়াজ: আপনার এ প্রশ্নের মধ্যে কতকগুলো অনুমান আছে ইমতিয়ার শামীম। আপনি ধরে নিচ্ছেন যে, সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচন হবে, ফলে ইস্যুভিত্তিক নির্বাচন হবে। আপনি ধরে নিচ্ছেন যে, এক ধরনের লেভেল প্লেয়িং থাকবে, ফলে ইস্যুর বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে। ধরে নিচ্ছেন নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। কিন্তু এগুলো সম্পর্কে এখন পর্যন্ত আমি নিশ্চিত নই এবং সে রকম কোনো লক্ষণও এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এগুলোর ওপরই নির্ভর করবে আসলে কোন ইস্যুগুলো প্রাধান্য পাবে। ধরুন, নির্বাচন যদি ২০১৮ সালের মতো হয় এবং বিরোধী দলের প্রার্থীদের নেতাকর্মীদের যদি আদালতের বারান্দাতেই সময় কাটাতে হয়, হাজার হাজার লোককে যদি ভূতুড়ে মামলার মোকাবিলা করতে হয়, বিরোধী দল যদি সমাবেশ করতে না পারে তাহলে কী ইস্যু নির্ধারণ করলেন, কী করলেন না, তার চেয়েও অন্য বিষয় ইস্যু হয়ে উঠবে।
এসব যে কোনো ইস্যুর চেয়ে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। গত নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত সফলভাবে যে কাজটা করতে পেরেছেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সেটা হচ্ছে যে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর মানুষের আস্থা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে পেরেছেন। গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের অংশগ্রহণের জন্য, নাগরিক অধিকারের জন্য ভয়াবহ ও দুর্ভাগ্যজনক এই কাজটা তারা করেছেন। এই নির্বাচন কমিশনের প্রথম কাজ সে কারণেই, নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা তৈরি করা।
এখন এই নির্বাচন কমিশন যদি শুধু এই আস্থাটুকু প্রতিষ্ঠা করতে পারে, অন্তত সে রকম ইঙ্গিত যদি দেখা যায়, তাহলেই ইস্যু নিয়ে আমরা আলাপ করতে পারব। তার আগে পারব না। এখন পর্যন্ত তার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। আপনি বলতে পারেন, মাত্র তো নির্বাচন কমিশন হয়েছে... ঠিক আছে, আমরা একটু অপেক্ষা করব। কিন্তু ইতিমধ্যেই গঠন প্রক্রিয়া ইত্যাদির কারণে এ নিয়ে কোনো আশার ইঙ্গিত দেখা যায় না। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কেবলমাত্র কমিশন দিয়ে নির্বাচন করা যাবে, এবং সেই ভোট অংশগ্রহণমূলক, জবাবদিহিমূলক, স্বচ্ছ নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে, তেমন আমি মনে করি না। ফলে ইস্যুর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, নির্বাচন করবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে কি না।
সমকাল: তার মানে আমরা ধরে নিতে পারি, কর্তৃত্ববাদী শাসনকাল আরও প্রলম্বিত হবে?
আলী রীয়াজ: গত দুটো নির্বাচন ক্রমাগত দেশকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে নিয়ে গেছে; এ ধরনের শাসনব্যবস্থা অব্যাহত রেখেছে। আগামী নির্বাচনে যদি এ অবস্থাই অব্যাহত থাকে, একই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হয়, তাহলে এই কর্তৃত্ববাদী শাসন অব্যাহত থাকাটাই স্বাভাবিক। একই প্রক্রিয়ায় ভিন্ন ফল আশা করে লাভ নেই।
News Courtesy:
https://samakal.com/opinion/article/2203100771/%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%87-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%AD%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A8-%E0%A6%AB%E0%A6%B2-%E0%A6%86%E0%A6%B6%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AD-%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%87