আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য না হলে দেশে কার্যকর বহুদলীয় ব্যবস্থা থাকবে না

আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য না হলে দেশে কার্যকর বহুদলীয় ব্যবস্থা থাকবে না

ড. আলী রীয়াজ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক-গবেষক। তিনি ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের একজন ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। তার গবেষণা ও প্রকাশনার ক্ষেত্র হচ্ছে গণতন্ত্র, সহিংস উগ্রবাদ, ধর্ম ও রাজনীতি এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি। ড. রীয়াজ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। এই বছরের শুরুতে তিনি সুইডেনের ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি (ভি-ডেম) ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং স্কলার হিসেবে কর্মরত ছিলেন, ২০১৩ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলার্স-এ পাবলিক পলিসি বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন, রাজনীতি, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সাম্প্রতিক ভূমিকা, ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা।

কালবেলা: বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে কী কারণ রয়েছে?

আলী রীয়াজ: বাংলাদেশের রাজনীতি বিশেষ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গ আন্তর্জাতিক আলোচনার বিষয়ে পরিণত হওয়ার তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথম এবং প্রধান কারণটি হচ্ছে বাংলাদেশের অধঃপতিত গণতান্ত্রিক পরিবেশ। গত এক দশক ধরে ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। গণতন্ত্রের উল্টোমুখী যাত্রা খুব স্পষ্ট। সারা বিশ্বজুড়েই গণতন্ত্রের এক ধরনের ক্ষয় আমরা লক্ষ্য করছি, যেটাকে আমরা বলছি ডেমেক্রেটিক ব্যাকস্লাইডিং।

এক ধরনের অথোরেটারিয়ান বা কর্তৃত্ববাদী সরকার বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই ধারার মধ্যে বাংলাদেশকে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশেষ করে যে বিষয়টা ঘটেছে তা হলো—বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পরিস্থিতির খুব দ্রুত অবনতি হয়েছে। এক ধরনের কর্তৃতবাদী বা স্বৈরতান্ত্রিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তার বিভিন্ন রকম প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। গত কয়েক বছর ধরে মানবাধিকার পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতি ঘটেছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের আওতায় নানা ধরনের নিপীড়ন ও দমনমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এগুলোই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদেশ এবং তাদের সহযোগী অন্যান্য দেশগুলোও বারবার বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের তাগিদ দিয়ে আসছে।

দ্বিতীয় যে বিষয়টা বিবেচনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো ভূ-রাজনৈতিক। বাংলাদেশ অবস্থানগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ সময় রাজনৈতিক এবং অর্থনীতির ভরকেন্দ্র এশিয়া বা প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে চলে এসেছে এবং এখানে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূত্রপাত দীর্ঘদিন ধরে হলেও এখন চীন আগ্রাসী ভূমিকা নিতে চেষ্টা করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র তা মোকাবিলা করতে চাচ্ছে।

শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় ভারতও এর অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা যায়। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে যার সূত্র ধরেই কোয়াডের সৃষ্টি হয়েছে। যার সঙ্গে যুক্ত আছে জাপানও। আদর্শিকভাবে বিবেচনা করলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে জাপান ও অস্ট্রেলিয়া যুক্ত হয়ে আছে, যদিও ভৌগোলিকভাবে তারা পশ্চিমাদেশের অধিভুক্ত নয়। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কারণ হলো বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান। দেশটি দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে। এ ছাড়া এর একটা বড় দিক হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগর এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত না যদি না চীন বঙ্গোপসাগর ব্যবহারের চেষ্টা করত। বঙ্গোপসাগর যেহেতু ভারত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত সেহেতু এটি গুরুত্বপূর্ণ। চীন চাইছে বঙ্গোপসাগরের ওপর তার এক ধরনের কর্তৃত্ব না হলেও বড় ধরনের উপস্থিতি বজায় রাখতে এবং এখানে যেন অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকে। চীন চায় তার প্রয়োজনীয় জ্বালানি যেন কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই দেশটিতে পৌঁছতে পারে। এক্ষেত্রে মিয়ানমারও যুক্ত হয়ে পড়েছে। আমরা রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টা জানি। এর মধ্যে মানবাধিকারের প্রশ্ন আছে। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটের একটা বড় বিষয় হলো ওই অঞ্চলে অর্থাৎ আরাকানে চীনাদের একটা বন্দর তৈরি করা। এখানে চীনের উদ্যোগে একটা বন্দর তৈরি করা হয়েছে, সেখান থেকে পাইপ লাইন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং সেটা দিয়ে চীনের তেল সরবরাহ করার একটা পথ উন্মুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের যে অতি ঘনিষ্ঠতা ছিল, তা আরও বেড়েছে। এরই একটা ধাক্কা বাংলাদেশের উপরে এসে পড়েছে। বিপুল সংখ্যাক রোহিঙ্গা বিতারিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের পরিস্থিতিও ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

তৃতীয় কারণ হলো, বাংলাদেশ গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এক ধরনের পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করে এসেছে, যাকে আমরা ‘হেজিং’ পলিসি বলতে পারি। অর্থাৎ এক ধরনের অনুমানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয়েছে। সবার সঙ্গে এক ধরনের ভারসাম্য রক্ষা করার যে কথা বলা হয়েছে কার্যত সেটা অনুসরণ করা হয়নি।

আমরা লক্ষ্য করেছি আগের দুটি নির্বাচন (২০১৪ ও ২০১৮) সঠিক ছিল না। কোনো অর্থেই এগুলোকে সঠিক, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে না। ফলে আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পথরেখাটা নির্ধারিত হবে। যে কারণে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব, আমেরিকা, ভারত বা চীন সবারই এক ধরনের উৎসাহ তৈরি হয়েছে।

কালবেলা: বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার উৎসাহ এবার একটু বেশিই লক্ষ্য করা যাচ্ছে কী?

আলী রীয়াজ: এক্ষেত্রে একাধিক কারণ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে এমনকি ভারতের কাছেও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছিল। তারা বারবার বলেছিল যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটা সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। এখানে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অন্যান্য পশ্চিমা বিশ্ব এমনকি জাতিসংঘও সংশ্লিষ্ট ছিল। সে সময় জাতিসঙ্ঘের দূত অস্কার ফার্নান্ডেজ তারানকো তিনবার বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসে তিনি আসার ঠিক আগেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ২০১৩ সালের গ্রীষ্ম থেকে নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত চেষ্টা চালানো হয়েছিল। কিন্তু সেটি ফলপ্রসূ হয়নি। বিভিন্ন কারণের মধ্যে একটা বিষয় ছিল যুক্তরাষ্ট্র তখন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়াকে দেখার ক্ষেত্রে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছে এখানে চীনের কোনো প্রভাব থাকলে সেটা ভারত রুখতে পারবে। তখন ধারণা ছিল বাংলাদেশে সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তারা আদর্শিকভাবে সেটাকে মোকাবিলা করবে। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপরে নির্ভর করেছে।

এখন যদি প্রশ্ন করা হয় ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র কেন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এর উত্তর হলো তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে শুধু এই অঞ্চল বলে নয়; বিশ্বের কোনো অঞ্চল এমনকি কোনো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের কোন ভূমিকা ছিল না। ফলে বাংলাদেশের বিষয়টি সেসময় অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। এসব কারণে আমরা ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালে নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দৃষ্টি রেখেছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপরেও যে তারা দৃষ্টি রেখেছে এটা মানবাধিকারবিষয়ক রিপোর্টগুলো পড়লেই দেখা যাবে। ২০১৮ সালের পর থেকে প্রতিটি মানবাধিকার রিপোর্টে বারবার বাংলাদেশে মানবধিকার লঙ্ঘনের কথা বলা হয়েছে।

আরও একটা বিষয় এখানে বিবেচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তার সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আশা করা হয়েছিল এই সম্পর্ক বজায় থাকবে, যা বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের জন্য ইতিবাচক হবে।

সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থানের কারণ কি? সেটা হলো আদর্শিক অবস্থান। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই বারবার বলে আসছিলেন তিনি গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সমধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেবেন। তার প্রশাসন এটা দিচ্ছেও। সর্বত্রই তারা সফল হচ্ছে, সর্বত্রই সঠিকভাবে দিতে পারছে, সবাইকে সমতার সঙ্গে বিবেচনা করছে বিষয়টা তা নয়। কৌশলগত কিছু বিষয় থাকে। এগুলো মিলেই বাংলাদেশের ২০২৪ সালের নির্বাচনের ইসুটি বিবেচিত হচ্ছে। এখানে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঘটেছে তা হলো দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের অবস্থানগত এবং নীতিগত পরিবর্তন। তারা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে কেবলমাত্র ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে রাজি নয়। বরং তারা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে নিজেরাই যুক্ত হতে চায়। কারণ, এখন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় অনেক বেশি নির্ভর করে।

কালবেলা: অতীত ইতিহাস বলে যখনই কোনো দেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে তার ফল ভালো হয়নি। বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ভালো ফল বয়ে আনবে কী?

আলী রীয়াজ: অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে সেটা একটা প্রশ্ন। ধরুন নেপালের ক্ষেত্রে ভারতের হস্তক্ষেপ এবং বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার অবস্থান দুটি এক বিষয় নয়। এখানে একটা বড় পার্থক্য আছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা এমন একটা ব্যবস্থা দেখতে চায়—যেখানে সরকারের একটা ম্যান্ডেট থাকবে। বাংলাদেশে কোন দল ক্ষমতায় থাকল বা আসল তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু যায় আসে না। তারা চায় এমন এক ধরনের সরকার যার জবাবদিহিতা আছে, এক ধরনের ম্যান্ডেট আছে। ম্যান্ডেট থাকলে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা তৈরি হয়।

দ্বিতীয়ত জনগণের ম্যান্ডেট থাকলে যে কোনো পরিস্থিতিতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে যে কোনো প্রভাব মোকাবিলা করা যায়। সেটা চীনের প্রভাব হোক বা অন্য কোনো দেশের প্রভাব হোক। যুক্তরাষ্ট্র বারবার বলছে, বাংলাদেশে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করুন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখুন, সবাইকে কথা বলতে দিন। এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ফলে যদি বাংলাদেশের এখনকার শাসক দল আবারও ক্ষমতায় আসে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু যায় আসে না।

ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বা পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থানের সঙ্গে ইরাকে মার্কিন হস্তক্ষেপকে মেলানো যাবে না। ইরাকে আমেরিকার যে সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছিল সেটা অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি। আমাদের মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক পরিবর্তন ঘটেছে এবং নীতিগত অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে চাচ্ছে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই তার জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করতে চাচ্ছে।

এখানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানটা ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র বলছে আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মানুষকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে বলছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বাংলাদেশের মানুষই সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশে কোন দল ক্ষমতায় থাকবে।

গত বছরের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বর্তমান সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতার জায়গা প্রসারিত করেছে। যদিও এখানে মানবাধিকারের প্রশ্নে ভিন্নমত ছিল। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকারই ক্ষমতায় আসবে যুক্তরাষ্ট্র তার সঙ্গে কাজ করতে দ্বিধা করবে বলে আমার মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ সেখানেই। সেই কারণে দুটোকে একভাবে দেখা ঠিক নয়। এখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের অবস্থান যেন পাল্টাপাল্টি। একইভাবে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান যেন বিপরীত।

যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত বলেনি, আমরা অমুক দলকে ক্ষমতায় দেখতে চাই। কিন্তু চীনের অবস্থান খুবই স্পষ্ট। ভারত গত দুটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কথা বলেছে এবারও এখন পর্যন্ত এমন কিছু বলেনি যাতে মনে হয় তারা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নেই।

কালবেলা: বাংলাদেশের বর্তমান সরকার চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে বলে অনেকে বলছেন। চীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে। চীনের কেন এ পরিবর্তন?

আলী রীয়াজ: চীন বাংলাদেশে একটা নতুন সম্ভাবনা দেখতে পায়। চীন মনে করে, আদর্শিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তারা একটা গুটি হিসেবে কাজে লাগাতে পারবে। বাংলাদেশে যারা এখন ক্ষমতায় রয়েছেন তাদের আসলে এক ধরনের আদর্শিক এফিনিটি (নৈকট্য) তৈরি হয়েছে, ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে চীনের সঙ্গে। এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্যে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। এটা এখনো পুরোপুরি চীনের মতো হয়নি তারপরেও কার্যকরভাবে বাংলাদেশে আমরা একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন দেখতে পাই। যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের সুযোগ তৈরি হয়নি। তবে বিশ্বব্যাপী এখন আদর্শের যে লড়াই চলছে, একনায়কত্ববাদ এবং প্লুরালিস্টের মধ্যে, যেখানে গণতন্ত্র একটি উপাদান। সেখানে চীন মনে করছে বাংলাদেশকে তাদের পক্ষে অবস্থান নেওয়াতে পারবে।

সত্যিকারার্থে বাংলাদেশে চীনের এতটা বিনিয়োগ নেই যতটা বিনিয়োগের কথা তারা বলেছিল। চীনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু শ্রীলংকার বিপদের সময় চীন পাশে দাঁড়ায়নি। ফলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতার জায়গা বিনিয়োগের কারণেই নয় বরং আদর্শিক। চীন আদর্শিক জায়গা থেকে বাংলাদেশকে কর্তৃত্ববাদী শাসন বলে মনে করে এবং সে কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে।

ক্ষমতাসীন সরকার হয়তো মনে করছে, যদি তারা চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দেখাতে পারে তাহলে ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর কষাকষিতে সুবিধা পাবে। এটা এক ধরনের বাজি ধরার মতো অবস্থা। অনেকে মনে করেন চীন বাংলাদেশে অনেক কিছু করে দিচ্ছে। কিন্তু সেটা সত্য নয়। চীন বাংলাদেশে চীন অনেক প্রজেক্টে কাজ করছে সত্যি, তবে সেটা বাংলাদেশের টাকাতেই হচ্ছে। বাংলাদেশ বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ জোগাড় করছে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের জন্য আর সেই অর্থটা ব্যয় করা হচ্ছে চীনের প্রযুক্তি ব্যবহার বা তাদের ইঞ্জিনিয়ারদের প্রদানে। যেমন : পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানুষের টাকাতেই তৈরি হয়েছে। সেই অর্থের একটা বিশাল অংশ চীনে পৌঁছেছে। কারণ চীনের টেকনিশিয়ানরা এখানে কাজ করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সমস্ত চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কাজ পেয়েছে সেগুলো সঠিক পদ্ধতিতে পেয়েছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

চীন শুধু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষা করছে তা নয়, এখানে চীনের এক ধরনের আগ্রহ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের নীতিতে এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে।

কালবেলা: আপনি কি বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগদানের সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে মনে করেন?

আলী রীয়াজ: যে কোনো দেশের ক্ষেত্রে মাল্টিল্যাটারাল ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হওয়া ভালো। দেশের জন্য যদি সুবিধাজনক হয় তবে সেটা ভালো। তবে ব্রিকসের ক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার ব্রিকসকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে কিনা। অর্থাৎ বাংলাদেশ পশ্চিমা বিশ্বকে বিব্রত করতে ব্রিকসকে ব্যবহার করছে কিনা। বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগদানের সিদ্ধান্তটা যদি আরও দেড় বছর আগে হতো তাহলে বিষয়টাকে একভাবে বিবেচনা করা যেত। তবে আজকের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগদানের সিদ্ধান্তটা অর্থনৈতিক নয় বরং রাজনৈতিক বলেই মনে হয়। ব্রিকসে যোগদান অর্থনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক নয়। অর্থাৎ বাংলাদেশ তার অর্থনীতির উন্নতির জন্য বা বাজারের প্রসারের জন্য ব্রিকসে যোগদান করছে না। নতুন বাজারের সুযোগের জন্য বাংলাদেশের পশ্চিমামুখী হওয়া উচিত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি বা ইউরোপের দিকে নতুন বাজার সৃষ্টির চেষ্টা বাড়ানো উচিত ছিল। তাই আজকের বিবেচনায় বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগদানের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বলেই মনে হয়। এই সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কোনো স্বার্থের অনুকূলে যাবে বলে কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেটা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বাংলাদেশ ব্রিকসের কাছ থেকে পাবে না। বরং ডলার সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রমুখী হতে হবে। বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ সবই পশ্চিমাদেশগুলো পরিচালনা করে। তারাই বরং বাংলাদেশের সংকটে পাশে দাঁড়িয়েছে, ঋণ প্রদান করছে স্বল্পসুদে।

কালবেলা: যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের র‌্যাবের ওপরে স্যাংশন আরোপ করেছে। এরপর ভিসানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। কিছু কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং নির্বাচন নিয়ে দেশটির সরকারকে চিঠি দিয়েছেন। এ বিষয়গুলোকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্যরা এবং তাদের অফিস বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন। শুধু খোঁজখবর রাখাই তাদের উদ্দেশ্য নয় বরং বিভিন্ন সময় এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এবং হোয়াইট হাউসকে জানানোর চেষ্টা করেন। এসব বিষয় ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটিতে আলোচনা হয়, কংগ্রেসেও আলোচনা হয় এবং সেসব ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান নিতে হয়।

সে কারণেই পৃথিবীতে কোথায় কী ঘটছে, সেটা তারা বোঝার চেষ্টা করে। যেসব বিষয় আদর্শিকভাবে এবং মার্কিন জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত সেগুলোকে তারা গুরুত্ব দিয়ে দেখে। সেই গুরুত্ব দিয়ে দেখার বিষয়টাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি যা এই সমস্ত চিঠিপত্রের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে।

আমরা জানি র‍্যাবের ওপর স্যাংশনের বিষয়টি প্রথম আলোচিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে। যখন সিনেটররা বা প্রভাবশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ সিনেট সদস্যরা এ সমস্ত বিষয় সামনে নিয়ে আসেন তখন তা আলাদাভাবে গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশ বিষয়ে চিঠি প্রদানকারী সিনেটররা কেউ কেউ মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনে যুক্ত রয়েছেন। ফলে তাদের এই অনুরোধগুলো ওই পরিপ্রেক্ষিতেই আসে, তারা এ বিষয়গুলো লক্ষ্য করেছেন এবং হোয়াইট হাউসকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাচ্ছেন। এই চিঠিগুলো তখনই সামনে এলো যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং নরেন্দ্র মোদির মধ্যে বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনা হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওই সিনেটররা তাদের অবস্থান জানিয়ে রাখলেন।

কালবেলা: অনেকে বলছেন এই চিঠিগুলো লবিস্টের মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছে…

আলী রীয়াজ: যারা এগুলো বলছেন তারা কি যথেষ্ট পরিমাণে প্রমাণ সামনে আনতে পেরেছেন? পারেননি। সুতরাং এটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই।

কালবেলা: যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির প্রভাব বাংলাদেশের ওপরে কতটা পড়বে?

আলী রীয়াজ: ভিসানীতির প্রভাবটা ইতোমধ্যেই আমরা লক্ষ্য করেছি। বাংলাদেশের পলিটিক্যাল ক্লাস যারা—রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক ধরনের স্বার্থ রয়েছে। ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে, ব্যক্তিগত স্বার্থ রয়েছে এবং পারিবারিক স্বার্থও রয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির কারণে এক ধরনের অস্বস্তিতে পড়েছেন। কেননা, বাংলাদেশের গত দুটি নির্বাচন বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচন বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে এই শ্রেণির একটি বড় ভূমিকা ছিল। সেদিক থেকে তার একটা প্রভাব দেখা যাচ্ছে। তবে এটিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্র এই ভিসানীতির মাধ্যমে যে বার্তাটা দিতে চেষ্টা করছে সেটা আমাদের বুঝতে হবে। সেটা হচ্ছে এতদিন ধরে যেভাবে বলা হয়েছে, নির্বাচনের একটা অনুকূল পরিবেশ আছে; প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে একেবারে সর্বনিম্ন পর্যায়ে স্থানীয় কর্মী পর্যন্ত বারবার আমাদের বলেছেন সে কথা। তারা বলেছেন, নির্বাচনের সমস্ত পরিস্থিতি ঠিক আছে, সংবিধানের মধ্যে সমস্ত ব্যবস্থা আছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেটা গ্রহণ করছে না। সেটা তারা খুব স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে। তারা যদি কনভিন্সড হতেন, তাহলে তারা এই প্রশ্নই তুলতেন না। তারা কনভিন্সড না, এটা স্পষ্ট।

দ্বিতীয়ত এর ধারাবাহিকতা খেয়াল করতে হবে। সেটা হচ্ছে শুধু ভিসানীতি ঘোষণা করা হয়েছে তা নয়। তার আগেও কিছু ঘটনা ঘটেছে। একটি হচ্ছে র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, উপুর্যুপুরি বিষয়গুলো বলা। মিস্টার ব্লিঙ্কেন সবার অবগতির জন্যই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মোমেনকে বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশের দিকে সবাই তাকিয়ে আছেন। যখন দুপক্ষের মধ্যে ওয়াশিংটনে ডায়লগ হচ্ছে, সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি করা হচ্ছে। ফলে এগুলোর একটা ধারাবাহিকতা আছে। তবে ধারাবাহিকতার শেষ এখানে হবে না। এটা (ভিসানীতি) করা হয়েছে নির্বাচনের চার থেকে আট মাস আগে। তার মানে এখন থেকে ওই পর্যন্ত আপনি ধরেই নিতে পারেন স্বাভাবিকভাবে এজন্য যথেষ্ট পরিমাণে যোগাযোগ ও তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আছে। এক ধরনের ধারাবাহিকতা আগামী সাত মাস থাকবে।

কালবেলা: সরকার এসব চিঠিকে আমলে নিতে চাইছে না...

আলী রীয়াজ: যে বিষয়টার ‘গুরুত্বই নেই’ তাহলে সেটা নিয়ে সরকার কেন আলোচনা করছে? বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যে বহুমাত্রিকতা রয়েছে সেটাকে সবার আগে স্বীকার করতে হবে। আমি দুটি উদাহরণ দেই। আপনারা সকলেই জানেন, রোহিঙ্গা সংকট মোকিবেলায় সবচেয়ে বেশি অর্থের জোগান দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের যখন কোভিড সংকট তৈরি হয়েছে, যখন অন্যান্য দেশ সামান্য পরিমাণে দান করে অধিকাংশ জিনিস উচ্চমূল্যে বিক্রি করার চেষ্টা করেছে তখন যুক্তরাষ্ট্র বিনামূল্যে কোভিডের টিকা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি টিকা বাংলাদেশকে দিয়েছে এবং তা দিয়েছে বিনামূল্যে। অন্যান্য দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ টিকা দিয়েছে বাংলাদেশকে সেখানে সর্বোচ্চ পরিমাণে টিকা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে। তাহলে আপনি বুঝুন, বহুমাত্রিকতার বিভিন্নতা কতটা বিস্তৃত।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মার্কেট হলো যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ তাদের। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্সপ্রবাহও কম নয়। বিপদে পড়লেই যুক্তরাষ্ট্র পাশে দাঁড়াচ্ছে। অকস্মাৎ এসে দাঁড়াচ্ছে তা নয়। কোভিডের সময়, ২০১৭ সাল থেকে অব্যাহতভাবে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করছে যুক্তরাষ্ট্র। রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধান করতে যত ধরনের আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রয়োজন সেগুলোর সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্র যুক্ত থাকছে। এই ইতিবাচক দিকগুলোকে অস্বীকার করে স্বল্প মেয়াদে কোনো সরকারের ক্ষমতায় থাকা না থাকার বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে যদি কোনো অবস্থান গ্রহণ করেন, এটাকে কি জাতীয় স্বার্থের অনুকূল বলে আপনার মনে হয়? আমার কাছে মনে হয় না। যদি কেউ মনে করেন এটা জাতীয় স্বার্থের জন্য অনুকূল, তাহলে তিনি বলুন, আমরা বোঝার চেষ্টা করব, কীভাবে এটা জাতীয় স্বার্থের অনুকূল হয়?

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় রকমের ভরসার জায়গা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এই যে বাজার, বিনিয়োগ এগুলো আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, আসছে জাপান থেকে। আপনি যদি মনে করেন পশ্চিমা বিশ্ব একটা অবস্থান নেবে এবং আপনি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে এক ধরনের আক্রমণাত্মক সম্পর্কের মধ্যে যাবেন অথচ জাপান ক্রমাগতভাবে বিনিয়োগ করে যেতেই থাকবে—এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। আমি শুরুতেই বলেছি, ভৌগোলিকভাবে জাপান অস্ট্রেলিয়া বা পশ্চিমে অবস্থিত নয়। আদর্শিকভাবে জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া পশ্চিমের সঙ্গে যুক্ত। এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ধারণা জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবের।

কালবেলা: অনেক বছর পর জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হলো। এদিকে আবার ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনও সভা-সমাবেশ বাড়িয়েছে। এটি কী কোনো বার্তা বহন করছে?

আলী রীয়াজ: যে কোনো রাজনৈতিক দলের সমাবেশ করার অধিকার আছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। যে কোনো সময়েই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সমাবেশ করার কথা ছিল। সেটা করতে দেয়া হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকে, তাহলে সেগুলো আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাধানের কথা ছিল। ক্ষমতাশীলরা সেটাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছেন গত ১০ বছর ধরে, এখনো করছেন। ফলে জামায়াতে ইসলামী নিয়ে এখন যে আলোচনা হচ্ছে সেখানে আমার মতামত ভিন্ন। সেটা হচ্ছে, জামায়াত ইসলামকে হঠাৎ করে সভা-সমাবেশ করতে দেওয়ার অধিকার দেওয়ার অর্থ হলো হঠাৎ করে তাদের আলোচনায় নিয়ে আসা। সে সঙ্গে দেশের বাইরে এমন ধারণা তৈরির চেষ্টা করা, যে এখানে যদি উন্মুক্ত রাজনীতির সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে তাদের ভাষায় এসব ‘মৌলবাদী-ইসলামপন্থিদের’ উত্থান ঘটবে। এটাই আসলে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ কারণে ইসলামপন্থি দলগুলোকে—(হেফাজত ইসলাম, জামায়েত ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন) বড় রকমের সমাবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে, এটা কোনো রকম উদারতার উদাহরণ নয়। এটা তাদের নাগরিক অধিকার, যা এতদিন দেয়া হয়নি।

এখন জামায়াতে ইসলামীকে কোনো রকম ঝামেলা ছাড়া সমাবেশ করতে দেওয়া, ইসলামী আন্দোলনের সভা-সমাবেশ মিছিলে হামলা হয় না; কিন্তু গণতন্ত্র মঞ্চের সমাবেশের মিছিলে হামলা ঠিকই হয়। আর বিএনপির কথা বাদই দিয়ে দিলাম। তাদের গত ১০ বছর ধরে তিনজন লোককে একত্রিত হতে দেখলে তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছে। যদিও বিগত কয়েক বছরে বিএনপি কোনো রকম সহিংসতায় যুক্ত হয়নি। আমাদের আলোচনা করার কথা ছিল বাংলাদেশের মানুষ ভোট দিতে পারবে কিনা। একটা অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কিনা। গত দুই নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের স্পষ্ট করে বলার দরকার, এখন যে ব্যবস্থা আছে সেই ব্যবস্থায় সুস্থ অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এজন্য যেটা করা দরকার, সেটা হলো একটা নিরপেক্ষ সরকার তৈরি করা যার অধীনে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা সম্ভব হবে। সেই ব্যবস্থা নিন, সেই আলোচনা করুন। এসব বিষয় থেকে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে, দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে বাংলাদেশ নিয়ে এমন ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যে ক্ষমতাসীনরা যদি এক ধরনের ‘ওপেন’ রাজনীতির পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করেন তাহলে কোনো না কোনো ইসলামপন্থি শক্তির কারণে বাংলাদেশ বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে—এটাই হচ্ছে রাজনীতি।

প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের অধিকার আছে সমাবেশ করার। দশ বছর পরে কেন জামায়াতে ইসলামী সমাবেশ কেন করল সেটা প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হচ্ছে প্রত্যেকটা নাগরিকের সমাবেশ করার অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা যায় না কেন? আগামীতে যাবে তার গ্যারান্টি কী? কিভাবে আপনি সেই ব্যবস্থা তৈরি করবেন?

কালবেলা: সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলছে বিরোধী দলগুলো। সরকারের অবস্থান এর বিপরীতে। এক্ষেত্রে সমাধানে উপনীত হওয়ার কতটা সম্ভাবনা আপনি দেখছেন?

আলী রীয়াজ: পঞ্চদশ সংশোধনীর পরে বিশেষ করে যে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ২০১৮ সালে নির্বাচন করা হয়েছে—তার প্রেক্ষাপটে নির্দলীয় ব্যবস্থা বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাড়া বাংলাদেশে কোনো রকম গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা যাবে না। দুটো বিষয় বলি। আপনি এটাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার বলেন, নির্দলীয় সরকার বলেন সে তা বিবেচ্য নয়। এ বিষয়ে আমার একটা ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যাটা খুব সহজ। এমন একটি মন্ত্রিসভা থাকতে হবে যার কোনো রকম রাজনৈতিক স্টেক নেই। কেউ জিতলেও সে বিপদগ্রস্ত হবে না, কেউ হারলেও সে বিপদগ্রস্ত হবে না। যদি সেটা তৈরি করা যায় তাহলে প্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে। প্রশাসন অতীতে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে।

২০০১ ও ২০০৮ সালের ক্ষেত্রেও দেখেছি প্রশাসনকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে। আগের নির্বাচনগুলো না হয় বাদই দিলাম। এ ব্যবস্থা ছাড়া আমি আর কোনো সমাধান দেখতে পারি না। প্রশ্ন হচ্ছে এমন নির্বাচন কী সংবিধানের ভেতরে থেকেই করা যায় কিনা। আলোচনা কখন হবে? আগে জানতে হবে আলোচনার মাধ্যমে আমরা কী অর্জন করতে চাই, সেটা আমাদের আগে জানতে হবে। আপনাকে স্বীকার করতে হবে একটা নিরপেক্ষ সরকার প্রয়োজন, নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য। এটা প্রথমে বলুন এবং এরপর আসুন আমরা আলোচনা করি। আপনাকে স্বীকার করতে হবে ‘একটা নিরপেক্ষ সরকার প্রয়োজন নির্বাচন করার জন্য’ এই একনলেজমেন্ট ছাড়া যে কোনো ধরনের আলোচনা অর্থহীন।

কালবেলা: সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনার কোনো সম্ভাবনা আছে কী?

আলী রীয়াজ: আলোচনার এজেন্ডাটা আগে ঠিক করতে হবে। এ উদ্যোগটা সরকারকে নিতে হবে, ক্ষমতাসীন দলকে নিতে হবে। সরকার যদি বলে, আমরা ‘এই’ কারণে আপনাদের সঙ্গে বসতে চাই। এখানে শুধু বিএনপি নয়, সব দলের সঙ্গেই বসতে চাওয়া উচিত। বাংলাদেশে আরও অনেক রাজনৈতিক শক্তি আছে। সেসব দল আকারে ছোট কিনা, প্রভাবে ছোট কিনা সেটা বিষয় না। আলোচনার এজেন্ডা কী সেটা আগে ঠিক করে তাদের সবার সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। এরপর আমরা দেখি, বিএনপি আলোচনায় যায় নাকি যায় না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের পর থেকে বিএনপি দলগতভাবে নির্বাচনে গেল কী গেল না সেটা আমার ধর্তব্যের বিষয় না। আমার ধর্তব্যের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকে ভোট দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছিল, কী হয়নি। যে অধিকার ছিল সে অধিকার নিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে না যাক কিন্তু মানুষ ভোট দিক। ভোট দেয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করুন।

বাংলাদেশের মানুষের অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করতে হবে। এখন এটা কীভাবে করা হবে, কোন কৌশলে করা হবে, এটা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করবে। বাংলাদেশের এখনকার রাজনীতিতে আগামী সংসদ নির্বাচনকে আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কী কারণে করি? সেটা হচ্ছে ২০২৩-২৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে কার্যকর বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকবে নাকি থাকবে না, সেটার সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। এই নির্বাচন যদি অবাধ সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হয়, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কার্যকর বহুদলীয় ব্যবস্থা টিকে থাকবে বলে আমার আর মনে হয় না। কম্বোডিয়াতে অনেকগুলো দল আছে, কিন্তু কম্বোডিয়াতে কার্যত একদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

কালবেলা: সরকার বলছে, তারা নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করেছে। এখন তারা নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করছে এবং আগামী সংসদ নির্বাচনও করবে…

আলী রীয়াজ: নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার কী পরিমাণ সংকোচন করা হয়েছে সেটা আমরা দেখেছি। তার চেয়ে বড় কথা নির্বাচন কমিশন নিজে সরাসরি নির্বাচনে জড়িত থাকে না। লাখ লাখ লোক মিলে নির্বাচন পরিচালনা করা হয়। নির্বাচন পরিচালিত হয় স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে। গাইবান্ধার ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন বলেছিল, স্থানীয় প্রশাসন তাদের সহযোগিতা করেনি। সেজন্য নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। বাকি ২৯৯টা আসনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে তার নিশ্চয়তা কী? ২০১৪ সালে যারা নির্বাচন করেছিলেন তারা ২০১৩ সালেও স্থানীয় পর্যায়ে ভালো নির্বাচন করেছিলেন। ২০১৮ সালে যারা নির্বাচন করেছিলেন তারাও শুরুতে স্থানীয় পর্যায়ে ভালো নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু সংসদ নির্বাচন ভালো হয়নি। তাই স্থানীয় পর্যায়ে তিনটা ভালো নির্বাচন এই নিশ্চয়তা দেয় না যে সংসদ নির্বাচনও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে না যে তারা জাতীয় পর্যায়ের নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন করতে পারবে। ফলে এসব যুক্তি যারা দেখান, তাদের আমিও পাল্টা উদাহরণ দেখাতে পারব।

News Courtesy:

https://www.kalbela.com/opinion/sub-editorial/4125

An unhandled error has occurred. Reload 🗙