জঙ্গি আর সন্ত্রাসী হামলার পার্থক্য জানাচ্ছেন আলী রীয়াজ
একই ধরনের হামলা, অথচ কোনো দেশে বলা হচ্ছে সন্ত্রাসী হামলা, আর কোনো দেশে জঙ্গি হামলা৷ কেন এই পার্থক্য?
এই প্রশ্নসহ নানান বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী রীয়াজ৷
ডয়চে ভেলে: সন্ত্রাসী হামলা কী, আর জঙ্গি হামলা কী?
অধ্যাপক আলী রীয়াজ: এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য আসলে অনেক সময় শব্দগতভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে৷ কিন্তু এখানে মৌলিক পার্থক্য আছে৷ জঙ্গি শব্দটা আপনি একাধিক ধরনের লোকজনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারেন৷ কী অর্থে, কাদের আমরা জঙ্গি বলব? যারা এক ধরনের আগ্রাসী মনোভাব বা আচরণ করে৷ এই আগ্রাসী মনোভাব সহিংস নাও হতে পারে৷ অর্থাৎ সে সহিংস ঘটনা নাও ঘটাতে পারে৷ আর সন্ত্রাসী তাদের বলব যাদের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে৷ তারা নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে এবং সহিংসতাকে তারা রাজনৈতিক একটা হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে৷ যেমন ধরেন বিদ্রোহী গোষ্ঠী৷ তাদের কি আমরা সন্ত্রাসী বলব? অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিন্তু তারা সন্ত্রাসী নয়৷ আবার জঙ্গি বলতে আমরা বিদ্রোহী বা সন্ত্রাসী দুই ধরনের লোককেই বোঝাব৷ সন্ত্রাসী হলো সুনির্দিষ্টভাবে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যদি আমরা দেখি বেসামরিক লোকজনের উপর হামলা করা হচ্ছে, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনৈতিক৷ অনেক সময় এই দুটো আমরা গুলিয়ে ফেলি৷
কোন হামলাকে সন্ত্রাসী হামলা বলবো? আর কোন হামলাকে জঙ্গি হামলা বলবো?
এই পার্থক্য করা একটু দুরূহ হয়, এই কারণে যে, যে হামলাটা পরিচালিত হলো এর পেছনে রাজনৈতিক সংগঠন বা উদ্দেশ্য আছে কিনা৷ কোনো ব্যক্তি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যদি সহিংস হামলা চালায়, তিনি যদি আদর্শিকভাবে কোনো সংগঠন দ্বারা পরিচালিত হন তাহলে সাধারণত সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করা হয়৷ এখন কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে আমরা যদি সংগঠনের বিষয়টি নিশ্চিত হতে না পারি তাহলে জঙ্গি শব্দটা ব্যবহার করা হয়৷ বাংলায় যখন জঙ্গি শব্দটা ব্যবহার করা হয় তখন ব্যাপকভাবে সন্ত্রাসীদের এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ সাধারণ লোকজনের বোঝার সুবিধার জন্য৷
সন্ত্রাস এবং জঙ্গি এই শব্দ দু'টির উৎপত্তি কোথা থেকে?
সন্ত্রাস বা সন্ত্রাসী এই শব্দটা আসলে ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু হয়েছে৷ আর জঙ্গি কথাটা জাং বা যুদ্ধ থেকে এসেছে৷ যারা যুদ্ধে লিপ্ত তাদের জঙ্গি বলা হতো৷ সময়ের ব্যবধানে এর অর্থেরও পরিবর্তন হয়ে যায়৷ আগে তো কোনো ঘটনা ঘটলেই তাদের সন্ত্রাসী বলা হতো৷ একজন মু্ক্তিযোদ্ধাও কারো দৃষ্টিতে সন্ত্রাসী৷ আসলে রাজনৈতিক বিষয়টা আলাদা করা হয়েছে৷ জাতীয় মুক্তির যে আন্দোলন সেটাকে তো আমরা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বলে চিহ্নিত করব না৷ এখন কেউ কেউ করবে৷ কারণ তার একটা রাজনৈতিক অবস্থান আছে৷ সবকিছুই পরিবর্তন হচ্ছে৷ এখন দেখেন আমরা সহিংস উগ্রবাদের কথা বলছি৷
এগুলো কি কেবলই ধর্মের ভিত্তিতে নির্ধারণ হয়ে থাকে?
অবশ্যই না৷ কোনো অবস্থাতেই এটা সঠিক নয়৷ কেউ যদি এটা করে থাকেন তাহলে তারা হয় অজ্ঞতা বসত করেন বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করেন৷ কোনো ধর্মই সহিংসতার কারণ নয়৷ একইভাবে সমস্ত ধর্মের মধ্যে বিভিন্ন রকম বক্তব্য আপনি খুঁজে পাবেন৷ সেটাকে আপনি সহিংসতার পথে ব্যবহার করতে পারেন৷ ধর্মকে যখন রাজনৈতিক আদর্শে পরিচালিত করা হয় তখন এটা হতে পারে৷ তখন দেখা যাচ্ছে ওই ধর্মের মৌলিক অবস্থান থেকে সরে গিয়ে হতে পারে বা ধর্মের বিকৃত ব্যবহারের মাধ্যমে হতে পারে৷ সহিংস উগ্রবাদ যেটা সেটা কিন্তু শুধু ধর্মের থেকেই তৈরি হয় না৷ এটা জাতীয়তাবাদ থেকেও হতে পারে, আইডেন্টিটির প্রশ্নে হতে পারে, কখনও কখনও আত্মপরিচয়ের প্রশ্নেও হতে পারে? আসলে যারা মনে করেন ধর্মই সহিংসতার কারণ, তাদের বিষয়ে আমি বলব হয় অজ্ঞতা বসত করেন বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করেন৷
একই ধরনের আদর্শভিত্তিক হামলা, অথচ কোনোটাকে বলা হচ্ছে সন্ত্রাসী হামলা, আবার কোনোটাকে বলা হচ্ছে জঙ্গি হামলা, এটা কেন?
এটা একেক দেশে একেক রকম হতে পারে৷ কারণ নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা, বা পলিসিমেকার যারা তারা সেটাকে কীভাবে দেখছেন? এগুলোর কিন্তু কোনো স্থায়ী সংজ্ঞা নেই৷ যেমন ধরুন জাতিসংঘে কাউন্টার টেররিজম নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা হয়েছে৷ তার কিছু মডেল তৈরি করা হয়েছে৷ কিন্তু টেররিজম প্রশ্নে কেউ সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায় আসতে পারেননি৷
সন্ত্রাসী আর জঙ্গিদের টার্গেটে কী কোনো পার্থক্য আছে?
জঙ্গি হিসেবে আপনি যদি শুধু আগ্রাসী মনোভাবের কথা বলেন তাহলে অবশ্যই পার্থক্য আছে৷ যখন সুনির্দিষ্টভাবে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাধারণ মানুষের উপর হামলা হয় সেটাকে সন্ত্রাসী হামলা বলা হয়৷ কিন্তু জঙ্গিরা কি এটা করেন? করেন৷ বিভিন্নভাবে জঙ্গি তৈরি হতে পারে৷ ফলে টার্গেটে এক ধরনের পার্থক্য আছে৷
সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হামলার বিচারে কি কোনো পার্থক্য আছে?
এটা আসলে ওই দেশের আইনের উপর নির্ভর করবে৷ আসলে কে কীভাবে এটা ব্যাখা করেছে তার উপর সবকিছু নির্ভর করে৷ অনেককে সন্ত্রাসী হিসেবে উল্লেখ করা হয় না, কারণ কোনো ঘটনার পর ওই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি মনে করে তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে উল্লেখ করলে প্রমাণ করা কঠিন হবে, কিন্তু যদি ঘটনাটাকে শুধু হত্যাকাণ্ড বলে চিহ্নিত করা হয় তাহলে অপরাধীর শাস্তি সুনিশ্চিত করা সম্ভব হবে, তাহলে তারা সেটা করতে পারেন৷ ফলে আমরা বাইরে থেকে বলে দিলেই হবে না, তার সন্ত্রাসী হিসেবে বিচার কেন করলেন না, কেন হত্যাকারী হিসেবে বিচার করলেন৷ এই প্রশ্নগুলো অনেক সময় উঠে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশের আইনের উপর সবকিছু নির্ভর করে৷
এই দুই ধরনের হামলার মধ্যে কোনটি বেশি সমাজে প্রভাব ফেলে?
দু'টোই প্রভাব ফেলে৷ আসলে যেটা হয় অনেক সময় ওভারলেপ করে ফেলে, সে কারণে আমাদের শব্দের মধ্যে আটকে না থেকে বুঝতে হবে আইডোলজিক্যালি সে সহিংস উগ্রবাদী কিনা৷ আসলে তার লক্ষ্য কী, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারা? বেসামরিক মানুষ এই ক্ষতির শিকার হচ্ছেন কি, হচ্ছেন না? তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হচ্ছে কিনা? তাদের স্বাভাবিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা? এগুলো বিবেচনার বিষয়৷
সন্ত্রাসবাদ আর জঙ্গিবাদ এই দু'টোকে কেন মিলিয়ে ফেলা হচ্ছে?
মিলিয়ে ফেলার একটা কারণ হলো একেক দেশে একেকভাবে বর্ণণা করা হয় তো তার থেকে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিলিয়ে ফেরার কারণ পার্থক্য করার জন্য খুব বেশি তথ্য হয়ত হাতে নেই৷ কাঠামোগত দিকগুলো না জানাও একটা কারণ৷ যতক্ষণ তথ্য জানা যাচ্ছে না, ততক্ষণ জঙ্গি বলে বর্ণণা করা হচ্ছে৷ সর্বশেষ সন্ত্রাসী শব্দটা ব্যবহৃত হতে গিয়ে এতবেশি ভুলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে যে, এখন অনেকেই এটা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন৷ কারণ এতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়৷
News Courtesy:
https://www.dw.com/bn/%E0%A6%9C%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%BF-%E0%A6%86%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%80-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%86%E0%A6%B2%E0%A7%80-%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%9C/a-48231413