ভারতের নতুন সরকার কি বাংলাদেশ নীতি বদলাবে?
টানা তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে বেশ কয়েক জন বিদেশী নেতার সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উপস্থিত ছিলেন, যা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। রোববারের এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হাসিনা শনিবার নয়াদিল্লি পৌঁছান। কিন্তু এই সফরের আগে এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দৃশ্যত এক ধরনের অপ্রচলিত অতিরিক্ত আগ্রহ দৃশ্যমান হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই অতিরিক্ত আগ্রহ কিছুর ইঙ্গিত বহন করে কি না, আবার অন্যদিকে এই নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) একচ্ছত্র সমর্থন হ্রাস পেয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হয়েছে। এর কোনো প্রভাব নতুন সরকারের আঞ্চলিক নীতি, বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ওপরে পড়বে কি না সেই প্রশ্নও অনেকে তুলছেন।
নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর প্রচলিত কূটনৈতিক শিষ্টাচার অনুযায়ী শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানান, মোদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং এই দুই নেতার মধ্যে টেলিফোনেও কথা হয়। কিন্তু যেটা লক্ষণীয় তা হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে হাসিনার এই সফরের কথা ঘোষণা করা হয় মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের তারিখ ঘোষণার আগেই। প্রথমে বলা হয়েছিল যে হাসিনা শুক্রবার নয়াদিল্লি যাচ্ছেন। কিন্তু শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের তারিখ রোববার নির্ধারণের পরে তাঁর এই সফরের দিন বদলে দেয়া হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, টেলিফোনে কথোপকথনের সময় মোদি হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান এবং শেখ হাসিনা তাতে সম্মতি দেন। কিন্তু যেহেতু নতুন মন্ত্রীসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের, সেহেতু এই ধরনের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে, রাষ্ট্রপতিই দেশি/বিদেশী অতিথিদের আমন্ত্রণ জানান। এই আমন্ত্রণের তালিকা বিজয়ী দলই নির্ধারণ করে, কিন্তু আমন্ত্রণ জানানো প্রটোকলের বিবেচনায় রাষ্ট্রপতির।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এই অতিরিক্ত আগ্রহের কারণ সহজেই উপলব্ধি করা যায়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসীন হবার পর থেকেই শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি ভারত অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে আসছে। এই সমর্থনের মাত্রা এতটাই যে, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের অব্যবহিত আগে যখন সব বিরোধী দল নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল তখন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকা সফর করেছিলেন। তিনি সেই সময়ে জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে যেতে চাপ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। সেই সময় দিল্লীতে ক্ষমতায় ছিল ভারতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড প্রগেসিভ এ্যালায়েন্স (ইউপিএ) জোট।
২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় এলেও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটেনি। বরঞ্চ ভারতের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বারবার একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছিল সেই সময়ে ভারত শেখ হাসিনার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘২০১৪ সালেও নির্বাচন নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিল। ভারতবর্ষ আমাদের পাশে ছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনকেও বিতর্কিত করার এবং সে নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্থাপন করা হয়েছিল। ভারতবর্ষ আমাদের পাশে ছিল। এবারও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থানটা কী ছিল বা কী আছে, তা আপনারাই জানেন’ (প্রথম আলো, ১৫ জানুয়ারি ২০২৪)।
বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে; ভারতের ক্ষমতাসীনরা বাণিজ্য এবং নিরাপত্তা স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে যখন ভারতের সম্পর্কে এক ধরনের টানাপোড়েন আছে সেই সময় বাংলাদেশে তাঁদের সমর্থনপুষ্ট সরকার থাকা জরুরি; ভারতের নীতি নির্ধারকদের বিবেচনায় এটাও আছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা তাঁদের রাজনৈতিক ভাগ্যের ব্যাপারে ভারতের মুখাপেক্ষী বলেই প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের প্রত্যাশিত প্রায় সকল কিছু মেটানোর পরেও তিস্তার পানি বণ্টনের প্রশ্ন থেকে শুরু করে সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যার ঘটনা বিষয়ে ভারত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি, তার কোনো লক্ষণও নেই। এই বিষয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরাও উচ্চবাচ্য করেন না। এগুলো ভারতকে কেবল স্বস্তিই দেয়া তা নয়, তা অব্যাহত রাখার পক্ষেই সাহায্য করে। যদিও নতুন সরকার এককভাবে বিজেপির সরকার নয়, কিন্তু মোদির নতুন সরকারের জোট সঙ্গীদের আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক কোনো আলাদা অবস্থান নেই। ফলে বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের নতুন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। এর আরেকটি কারণ হচ্ছে চীনের সঙ্গে ভারতের প্রতিযোগিতা।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠাকে ভারত অবশ্যই ইতিবাচক বলে মনে করে না। বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র যখন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্যে বাংলাদেশের ওপরে চাপ দিচ্ছিল ভারতের বিশ্লেষক এবং নীতি নির্ধারকরা এই যুক্তি হাজির করেছিলেন যে, এই ধরনের চাপের মুখে শেখ হাসিনা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়বেন। নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রকে নিষ্ক্রিয় করার জন্যে এটাই ছিল প্রধান অস্ত্র। বাংলাদেশের নির্বাচনের পরে দেখার বিষয় ছিল প্রধানমন্ত্রী তাঁর এই মেয়াদের প্রথম বিদেশ সফরের জন্যে ভারত বা চীন কাকে বেছে নেন। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ চীনের কাছে সহজ শর্তে ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চাইবার পর এই প্রশ্নটি আরও বেশি করে উত্থাপিত হতে শুরু করে। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও চুক্তির জন্যে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই করা হয়েছে। বার্তা সংস্থা ইউএনবি'র সূত্রমতে, ২১-২২ জুন নয়া দিল্লি ও ৯-১২ জুলাই চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দৃশ্যমান অতি-আগ্রহ নিয়ে যোগদানের মধ্য দিয়ে এই বার্তাই স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা চীনের সঙ্গে আরও বেশি অর্থনৈতিক সম্পর্ক, এমনকি কৌশলগত সম্পর্কে, জড়িয়ে পড়লেও তাঁরা রাজনৈতিকভাবে এখনও ভারতের ওপরেই নির্ভরশীল। ভারতকে এই বিষয়ে আশ্বস্ত করতে সক্ষম হলে ভারতের নীতি অপরিবর্তিত থাকবে।
গত দশ বছরে ধরে বিজেপি এককভাবে ক্ষমতায় থেকেছে এবং পার্লামেন্টে বিরোধী ছিল প্রায় অনুপস্থিত। অষ্টাদশ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত পার্লামেন্টে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোটের উপস্থিতির কারণে মোদি সরকারকে আগের তুলনায় অনেক বেশি জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। এই জবাবদিহিতার সিংহভাগই হবে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে। কিন্তু কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়া জোটের শরিকরা এটা বুঝতে পারেন যে, মোদি সরকারের আচরণের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে এবং সেই সুযোগে চীনের প্রভাব বেড়েছে। এটি ভারতের জন্যে রাজনৈতিক, ভূ-কৌশলগত ও অর্থনৈতিক – এই তিন বিবেচনায়ই ক্ষতিকারক। এই বিবেচনা থেকে ইন্ডিয়া জোট নির্বাহী বিভাগের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া নীতি, নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। এর বাইরে আছে পররাষ্ট্র সম্পর্ককে ব্যবহার করে মোদি ভারতীয় শিল্পপতি আদানী এবং আম্বানীকে সুবিধা দিয়েছেন কি না সেই প্রশ্ন। রাহুল গান্ধি একাধিকবার এই অভিযোগ করেছেন যে, মোদি বিভিন্ন দেশে আদানীকে ব্যবসা পাইয়ে দিতে সাহায্য করেছেন, এই প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশের কথাও উল্লেখ করেছেন। এখন আরও বেশি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেস এবং তার ইন্ডিয়া জোটের শরিকরা এই নিয়ে যদি কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেন তবে তা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের প্রশ্নকে সামনে আনবে। অবশ্য তাতে করে ভারতের বাংলাদেশ নীতিতে নাটকীয় বদলের সম্ভাবনা কম, কিন্তু এই ধরনের প্রশ্ন বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদিকে যে খানিকটা হলেও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে সেটা নিশ্চিত।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক (ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর) এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো।
নিবন্ধের মতামত ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, আটলান্টিক কাউন্সিল বা বেনারনিউজের অবস্থানের প্রতিফলন নয়, লেখকের নিজস্ব।
News Courtesy: