বাংলাদেশি গণমাধ্যমের পরাধীনতার পথে যাত্রা
দুই আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) এবং আর্টিকেল ১৯ তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে আবারও জানিয়েছে যে, বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিন দিন সংকুচিতই হচ্ছে না, বরং তা এক সংকটজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আরএসএফের ইনডেক্সে গত বছরের তুলনায় বাংলাদেশ আট পয়েন্ট খুইয়েছে। তবে যারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং গণমাধ্যমের খোঁজখবর রাখেন তাদের কাছে এই অধঃপতন অবাক হওয়ার মতো নয়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর কমে আসছে। ২০১১ সালে তা ছিল ৫৭ পয়েন্ট এবং ২০২৪ সালে কমে ২৭.৬৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশ কেন এই পথে হাঁটছে? কারণটাও স্পষ্ট- গণতন্ত্রের অবক্ষয়। পরপর তিনটি জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ থেকে ক্রমেই প্রতিযোগিতামূলক কর্তৃত্ববাদ হয়ে একটি মধ্যপন্থী স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে; এখানে সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে থামিয়ে দেওয়া হবে এটাই স্বাভাবিক। একটি দেশ যখন দ্রুত গণতন্ত্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সেখানে স্বাধীন সংবাদপত্র থাকতে পারে না; যে দেশে সমাবেশের স্বাধীনতা নেই সেখানে স্বাধীন গণমাধ্যম থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ এগুলো অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। স্বৈরাচারীকরণের তৃতীয় ঢেউ যেটি ২০০৬ সাল থেকে চলে আসছে- এই পুরো সময়েই মূলত বাকস্বাধীনতাকে ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক সংশ্লিষ্ট এই প্রতিবেদনগুলো এমন কিছু বলছে না যা আমরা জানতাম না। কিংবা এটি বাংলাদেশের বাস্তবতার চেয়ে ব্যতিক্রম- বিষয়টা এমনও না।
উদীয়মান স্বৈরাচারীদের প্রাথমিক লক্ষ্য হয়ে থাকে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম। এটি খুবই স্পষ্ট; রাশিয়া, তুরস্ক এবং হাঙ্গেরির মতো দেশের ক্ষেত্রেও আমরা তেমনটি দেখেছি। কিন্তু এক্ষেত্রে দুটি প্রশ্ন থেকে যায়। এই পরিস্থিতি কীভাবে হলো? আর এই প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যমই বা কী ধরনের ভূমিকা পালন করেছিল?
অতীতে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের জন্য্য প্রথাগত স্বৈরাচারীদের মধ্যে গণমাধ্যমের ওপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ আরোপ, সেন্সরশিপ আরোপ, গণমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া এবং নির্বিচারে সাংবাদিক ও মালিকদের গ্রেপ্তার করার প্রবণতা ছিল। কিন্তু স্বৈরাচারীকরণের তৃতীয় ঢেউয়ের এই যুগে নব্য-স্বৈরাচারীরা গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরও কৌশলী উপায় অবলম্বন করে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গা যেখানে গণতান্ত্রিক অবক্ষয় এবং স্বৈরাচারীদের উত্থান ঘটেছে, সেখানকার মতো বাংলাদেশেই একই পন্থা অবলম্বন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে আইনি বাধা তৈরি এবং অতিরিক্ত আইনগত ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে আইনের সীমানার মধ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দমনমূলক আইন প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ) এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর- এই পাঁচ বছর ডিএসএ সাংবাদিক ও নাগরিকদের মাথার ওপর তরবারির মতো বা একরকম খড়্গ হয়ে ছিল।
এই আইনের আগে ছিল তথ্যপ্রযুক্তি আইন (আইসিটি আইন-২০১৩)। বিশেষ করে এই আইনের ৫৭ ধারা ছিল নিবর্তনমূলক। যেটি মূলত স্বাধীন সাংবাদিকতার অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে। এর উত্তরসূরী সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ (সিএসএ) একই উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছে। ডিএসএস যে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সেটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায়। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) উদ্যোগে একটি গবেষণা কাজ চলছে ডিএসএ নিয়ে। সেখানে ১৫৩৪ জনকে পেয়েছি যারা ডিএসএ’র ভুক্তভোগী। এর মধ্যে ৪৫১ জন সাংবাদিক; এছাড়া অন্তত ৯৭ জন সাংবাদিককে এই আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
শুধুমাত্র সংখ্যার দ্বারা আইনের এই অযাচিত ব্যবহারের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব নিরূপণ সম্ভব নয়। এখানে পরিস্থিতিটা বুঝতে হবে। যেখানে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে সাংবাদিকদের মধ্যে বা সমাজের সর্বত্র একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে। প্রথম দিকে অনুরোধ এবং নির্দেশসহ অজানা উৎস থেকে টেলিফোন করার মতো আইনবহির্ভূত ব্যবস্থা নেওয়া হত। এখন আর তেমনটি করার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ মিডিয়াকর্মীরা এখন নিজে থেকেই সেই কাজটি করছে, তারা বুঝতে পারে যে কী মুদ্রণ বা সম্প্রচার করা উচিত নয়। কারণ এর ব্যতিক্রমটি হলে তার পরিণতি কী সেটা তারা জানে।
পরিণতির মধ্যে আরও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে- মিডিয়ার আয়ের উত্সগুলোকে ছোট করে দেওয়া। এখানে হয় সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত করা বা বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলে দেওয়া যে তাদের নিজেদের স্বার্থে কোন গণমাধ্যমকে পরিহার করা উচিত। যদিও পরের উদাহরণটি খুব কমই দেখা গেছে। তবে দুয়েকটিই যথেষ্ট পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য। কারণ এটিই সবার বোধগম্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিকানার মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্বের পথ উন্মুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে এটা সর্বজনবিদিত যে, সরকারের সাথে ভালো সম্পর্ক ছাড়া কেউই টেলিভিশনের লাইসেন্স পাবে না। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে এই ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছিল। তবে এই সরকার এসে ব্যবস্থাটি আরও পাকাপোক্ত করেছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিক বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ। এটি আরও স্পষ্ট হয় যখন দেখা গেল- গত নির্বাচনে গণমাধ্যম মালিকরা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলো। ২০২৪ সালের যে নির্বাচন বিরোধী দলগুলো বর্জন করলো সেখানে অন্তত ১৯টি গণমাধ্যমের মালিক ও সম্পাদকরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলো।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমের মালিকানায় রয়েছে শিল্প প্রতিষ্ঠান; যারা মূলত অন্য ব্যবসায় জড়িত। বাংলাদেশে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মিডিয়া মালিকানাকে ভুলভাবে ‘মিডিয়ার কর্পোরেটাইজেশন’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। মিডিয়া যদি শিল্পে পরিণত হয় এবং প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের উদ্দেশ্যে মিডিয়া পরিচালনা করতো তবে এটি কর্পোরেটাইজেশন হতো। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি, এখানে মূলত ব্যবসায়িক স্বার্থে মিডিয়া গড়ে তোলা হচ্ছে। অর্থাৎ, ব্যবসায়িক স্বার্থের ঢাল হিসেবে মিডিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই মালিকানার সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো- মালিকদের ব্যবসায়িক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট খাতের সঙ্গে সরকারেরও সংশ্লিষ্টতা থাকে। যে কারণে হয় মালিককে সরকারের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়, অথবা গণমাধ্যমের মালিককে সরকার জিম্মি করে রাখে। স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশও এখানে নেই। এই পরিস্থিতি এমনি এমনি তৈরি হয়নি, বরং শাসকগোষ্ঠী এর বীজ বপণ করেছে। এমন চিত্র দেখিয়ে সরকার বলতে পারে যে- সরকার তো গণমাধ্যমের মালিক নয়; তারা স্বাধীন এবং স্বাধীনতা ভোগ করে। আমরা মন্ত্রীদের কাছ থেকে এই যুক্তি বহুবার শুনেছি। কিন্তু সরকারের বন্ধুদের ব্যক্তিগত মালিকানা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য বিপজ্জনক।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম কীভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে নিম্নগামী হয়ে গেছে তার উত্তর পূর্ববর্তী কারণগুলোতেই সুস্পষ্ট। মনে করিয়ে দেওয়া অপরিহার্য যে এগুলো বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু বা ব্যতিক্রম কোনো চিত্র নয়। এগুলো স্বৈরাচারীদের অনুসৃত পথেরই অনুসরণ। নব্য স্বৈরাচারীরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে নাগরিক ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের বোকা বানানোর চেষ্টা করে।
যদিও এগুলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিলুপ্তির চিত্রই ফুটিয়ে তোলে; তবে কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারে স্বৈরাচার তৈরি এবং টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে গণমাধ্যম কী ভূমিকা পালন করেছে। একটি আদর্শ পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমকে গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অভিভাবক হিসেবে কাজ করতে হয়। কিন্তু এটাও সত্য যে, সব গণমাধ্যম একই ভূমিকা পালন করে না। যেমনটা আমরা জানলাম, যখন শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠরা গণমাধ্যমের মালিক, তখন আমরা গণমাধ্যমের কাছ থেকে ‘ওয়াচডগের’ ভূমিকা আশা করতে পারি না। ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ হিসাবে গণমাধ্যমের ভূমিকাটি এখানে সবচেয়ে অলংকারমূলক হয়ে যায়। বাংলাদেশে গণমাধ্যম স্বৈরাচারের উত্থানে এবং শাসনব্যবস্থাকে স্বৈরাচারে রূপান্তরের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর উপায় হিসেবে এখানে তারা এমন একটি ন্যারেটিভ তৈরি করেছে যা স্বৈরাচারী পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখিয়েছে এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের নিয়মিত লঙ্ঘনকেও শাসকগোষ্ঠীর রীতিসম্মত কাজ হিসেবে দেখিয়েছে। এভাবে খুব সহজে সরকারকে সত্যের একমাত্র বাহক হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
রিপোর্টিং থেকে শুরু করে বড় ন্যারেটিভ তৈরি করে সরকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া; এই এর মাধ্যমে শাসনকে বৈধতা প্রদান করা হয়। দুটিরই উদাহরণ বাংলাদেশ; যা এখানে বিগত এক দশকে হয়েছে। বাংলাদেশি গণমাধ্যম দীর্ঘদিন ধরে তথাকথিত ‘ক্রসফায়ার’-এর পুলিশের বর্ণনার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন পর্যন্ত তোলেনি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিজেদের মতো দেওয়া এসব তথ্যকে ‘রিপোর্ট’ হিসাবে উপস্থাপন করা নিছক তথ্যগত ভুলের বিষয় নয়, বরং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে ন্যায্যতা দেওয়ার একটি উপায়ও ছিল। একইভাবে, জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে গণমাধ্যম গণতন্ত্রের বদলে তথাকথিত অবকাঠামোগত উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েছে। যদিও তারা এই উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি বা কার্যকর প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন করেনি। ব্যক্তিগতকরণের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে সবচেয়ে নমনীয় বা নিজের মতো করা যায়। প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগতকরণে স্বৈরাচারীকরণের মূল উপাদানগুলো বা ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ এবং জবাবদিহিতার অভাবের মতো বিষয়গুলো তৈরি করে। বাংলাদেশে শুধু রাষ্ট্র, সরকার ও দলের মধ্যকার বিভেদই অস্পষ্ট নয়, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পার্থক্যও ইচ্ছাকৃতভাবে মুছে ফেলা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অনেক বাংলাদেশি গণমাধ্যম এই প্রক্রিয়ার চিয়ারলিডার হিসেবে কাজ করেছে।
আলী রীয়াজ একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। যার গবেষণার আগ্রহে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, গণতন্ত্র, সহিংস চরমপন্থা এবং বাংলাদেশের রাজনীতি। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো তিনি। আলী রীয়াজ আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (এআইবিএস) প্রেসিডেন্ট। তার সাম্প্রতিক প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে ‘Pathways for Autocratization: The Tumultuous Journey of Bangladeshi Politics (Routledge: 2024), The Charade: Bangladesh's 2024 Election (Prothoma: 2024)’ এবং How Autocrats Rise: Sequences of Democratic Backsliding (Palgrave Macmillan, published in 2024 )বইটির সহ-লেখক তিনি।
News Courtesy: