বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের রাজনীতি : সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের রাজনৈতিক দিক নিয়ে আলোচনা বাংলাদেশে ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় বলে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের এবং বড় প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বিষয়ে যত ধরনের আলোচনা হওয়া স্বাভাবিক ছিল গত ৫২ বছরে তা ততটা প্রত্যক্ষ করা যায়নি। যদিও এটা সবাই স্বীকার করেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত একটি ফ্যাক্টর হিসেবে উপস্থিত থেকেছে। এটা দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আলোচনায় দীর্ঘদিন ধরেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভারতের প্রসঙ্গ তুলেছেন বা তার দিকে অঙ্গুলি সংকেত করেছেন।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনার স্পর্শকাতরতার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হিসেবে ভারতের এই উপস্থিতি। ফলে আমরা দেখতে পাই যে, একদিকে আছে অযৌক্তিক ভারত-বিরোধিতা এবং অন্যদিকে ভারতের প্রতি অতিমাত্রায় সহানুভূতিশীল একটি মনোভাব। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক কখনো একরৈখিকভাবে অগ্রসর হয়নি। যে কোনো দুই দেশের মধ্যে সেটাই স্বাভাবিক। সম্পর্কের এই উত্থান-পতনের জন্য দুই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং ক্ষমতা কাঠামোয় অধিষ্ঠিতদের দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে। এ কথাও উল্লেখ করা দরকার যে, সম্পর্কের প্রকৃতি ও মাত্রা নিরূপিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশ তার প্রতিবেশীদের কী দৃষ্টিতে দেখে।
বাংলাদেশকে দেখার ক্ষেত্রে ভারতের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক এবং সাংবাদিকদের মধ্যে দুটি উপাদান সহজেই লক্ষযোগ্য। প্রথমটি হচ্ছে এই ধারণা যে ভারত ‘এক বিপজ্জনক প্রতিবেশ’ বা ‘এ পেরিলাস নেইবারহুড’-এ অবস্থিত, দ্বিতীয় হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত যেহেতু সাহায্য সহযোগিতা করেছে সেহেতু ১৯৭১-ই সম্পর্কের নির্ধারক বলে বিবেচিত হতে হবে। প্রথম বিবেচনার ফলে প্রতিবেশীদের ব্যাপারে ভারতের এক ধরনের সন্দেহ সব সময় কাজ করে এবং সেই আলোকেই এই সব দেশ বিষয়ে ভারতের নীতি নির্ধারিত হয়। এই মনোভাব গড়ে ওঠার পেছনে কৌটিল্যের পরামর্শ (প্রতিবেশীদের সব সময় সন্দেহের চোখে দেখতে হবে) কাজ করেছে, কিন্তু তা আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে ২০০১ সালের পরে ভারত যখন এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব হ্রাসের অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্রের অকণ্ঠ সমর্থন লাভ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে যে অবাধ লাইসেন্স দিয়েছে এবং তার প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করেছে তা ভারতের এই মনোভাবকে শক্তিশালী করেছে। দ্বিতীয় বিষয়, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে ভারতের ভূমিকাকে নির্ধারক হিসেবে চিহ্নিত করার বিষয়টি কেবল ভারতের দিক থেকেই করা হয়েছে তা নয়, বাংলাদেশেও এই ধারণার সমর্থক বিপুলসংখ্যক। এ কথা অনস্বীকার্য যে ১৯৭১ সালে ভারতের সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা দরকার; কিন্তু ভারতের এই ভূমিকা একদিকে মানবিক-বিবেচনা দিয়ে তৈরি হয়েছিল, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় এটি হচ্ছে ‘হিউমেনিটারিয়ান ইন্টারভেনশন’, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিবেচনা, আরও স্পষ্ট করে বললে তৎকালীন ভূ-রাজনীতি দিয়ে নির্ধারিত হয়েছিল। সেটা মোটেই বিস্ময়কর নয়; কিন্তু ৫০ বছর পরও এই ইতিহাসই কি সম্পর্কের নির্ধারক হতে পারে? পৃথিবীর ইতিহাসের অন্য উদাহরণ কী ধারণা দেয়? ভারতের প্রতি বাংলাদেশের এই কৃতজ্ঞতা ভারতের নীতিনির্ধারকদের কীভাবে বিবেচনা করা উচিত সেটি অপর্ণা পাণ্ডে এভাবে বর্ণনা করেন, ‘বলা হয় যে “কৃতজ্ঞতা” হচ্ছে বহন করার জন্য সবচেয়ে খারাপ ক্রুশ । বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়তো এটাই ভারতের মাথায় রাখা দরকার। ১৯৭১ পেরিয়ে গেছে এবং সম্ভবত ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বিষয়টিকে এভাবেই দেখা উচিত এবং আশা করা উচিত নয় যে ছত্রিশ বছর পরও তাদের “নায়ক” বা “উদ্ধারকারী” হিসাবে বিবেচনা করা হবে।’ (It is said that “gratitude” is often the worst cross to bear. With Bangladesh, maybe that is what India needs to keep in mind. 1971 has passed and maybe that is the way Indian policy makers should look at it and not hope that after thirty-six years they will still be treated as “heroes” or “deliverers.” (অপর্ণা পাণ্ডে, হাফিংটন পোস্ট, ৬ জুলাই ২০১১)।
বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের বিষয়ে সাম্প্রতিককালে যে আলোচনা হচ্ছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা কী, তা কতটা গভীর এবং এই প্রভাব বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের কতটা অনুকূলে, সেই আলোচনায় এই বিষয়গুলো মনে রাখা দরকার। ইতিহাসের ধারাবাহিকতার বিবেচনায় এটাও স্মরণে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ১৯৭২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই অগ্রসর হয়েছে। অবশ্যই এই সম্পর্ক বৈরিতায় পরিণত হয়নি, কিন্তু তা একরৈখিকভাবেও অগ্রসর হয়নি; যে কারণে এই সময়ের সম্পর্ককে বিশ্লেষকরা বলেছেন, ‘জটিল, চ্যালেঞ্জিং, উত্তেজনা ও সংকটপূর্ণ, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে নিমজ্জিত।’ (মোহাম্মাদ সিরাজুল ইসলাম, দ্য ডেইলি সান, ২ জুলাই ২০১১)। কিন্তু সেই সম্পর্কে একটি নাটকীয় পরিবর্তন সংঘটিত হয় ২০০৯ সালের পর, যাকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা এবং ভারতের নীতিনির্ধারকরা ‘স্বর্ণ যুগ’ বলে বর্ণনা করে থাকেন (বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, আলী রীয়াজ, নিখোঁজ গণতন্ত্র, পৃ. ১৭৯-২০৫)। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে যা ঘটেছে তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা যেতে পারে। ২০০৯ সালের পর ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহের মূলোৎপাটনে, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট নিতে, বঙ্গোপসাগরের দুটি প্রধান বন্দরে স্থায়ী প্রবেশাধিকার অর্জনে, একটি জ্বালানি চুক্তি স্বাক্ষর করতে (যা নিশ্চিত করে যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ দামে বিদ্যুৎ কিনবে), বঙ্গোপসাগরে নজরদারি ব্যবস্থা ইনস্টল করতে, একটি জল-বণ্টন চুক্তি করতে (যা ভারতকে কুশিয়ারা নদীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রদান করে) এবং ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় সম্পৃক্ত হতে বাংলাদেশের সমর্থন পেয়েছে। এর বিপরীতে, তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য বাংলাদেশের অনুরোধকে বারংবার উপেক্ষা করা হয়েছে; ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সবচেয়ে সহিংস সীমান্তে পরিণত হয়েছে। কারণ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশির হত্যার মিশন চালিয়ে যাচ্ছে; দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ব্যবধান কয়েক বছর ধরে ভারতের পক্ষে বেড়েছে এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে সমর্থন পায়নি। এই সময়ের বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে বিবেচিত হতে পারে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে ছিটমহল হস্তান্তর। এতে করে বাংলাদেশ পেয়েছে ১১১টি ছিটমহল এবং ভারত পেয়েছে ৫১টি ছিটমহল। এই ছিটমহল হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত সীমানা চুক্তি বাস্তবায়ন, যা বাংলাদেশ ওই সময়ে অনুমোদন করেছে; কিন্তু ভারত করেছে ২০১৫ সালের মে মাসে। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের জলসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়ে, দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় নয়। এর পরও মহীসোপানের দাবিকে ঘিরে দুই দেশের পাল্টাপাল্টি অবস্থান এবং বেইজলাইন নিয়ে আপত্তি জাতিসংঘ পর্যন্ত গড়িয়েছে ২০২১ সালে। এই রকম প্রেক্ষাপটেই ভারতের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান চান কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাংলাদেশ যা দিয়েছে তা ভারত চিরকাল মনে রাখবে।
দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের রাজনৈতিক দিক নিয়ে সাম্প্রতিককালের আলাপ আলোচনা ২০২৩ সালে, বাংলাদেশের ২০২৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে গুরুত্ব লাভ করে। একটা বড় সময় ধরেই এই আলোচনা গণমাধ্যমে এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে আলোচিত হয়েছে। অবাধ নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনা সরকারের ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকবে নাকি ক্ষমতাসীনদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন অব্যাহত রাখবে সেই প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই এই আলোচনা উঠেছিল।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা কী সেটা বোঝার জন্য ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যই যথেষ্ট। ২০২৩ সালের ৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘দিল্লি আছে আমরা আছি।’ (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ৩ অক্টোবর ২০২৩)। তিনি বলেছিলেন যে, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা হয়েছে, তলে তলে আপসের কথাও বলেছিলেন তিনি। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, তার বক্তব্যেই এটা ছিল ভারতের ওপরে নির্ভর করেই সরকার এগোচ্ছে। এটা যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখেই বলা হয়েছিল তা কিন্তু নয়। ২০২২ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, সেটি করতে তিনি ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছেন। তার ভাষায়, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।’ (প্রথম আলো, ২১ আগস্ট ২০২২)।
৭ জানুয়ারির সাজানো নির্বাচনের পর এই ধরনের কথাবার্তা এখন স্পষ্টভাবেই বলা হচ্ছে। গত ১৫ জানুয়ারি ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে তার দপ্তরে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৪ সালেও নির্বাচন নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিল। ভারতবর্ষ আমাদের পাশে ছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনকেও বিতর্কিত করার এবং সে নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্থাপন করা হয়েছিল। ভারতবর্ষ আমাদের পাশে ছিল। এবারও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থানটা কী ছিল বা কী আছে, তা আপনারাই জানেন।’ (প্রথম আলো, ১৫ জানুয়ারি ২০২৪)। এগুলো আসলে কোনো নতুন কিছু নয়, এগুলো সবার জ্ঞাত; কিন্তু ২০১৪ এবং ২০১৮-এর নির্বাচনের বিষয়ে হাছান মাহমুদের বক্তব্য ওই সব নির্বাচনে ভারতের ভূমিকার এক ধরনের প্রত্যক্ষ স্বীকৃতি মাত্র।
৭ জানুয়ারি ২০২৪-এর পর যা ঘটছে সেটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ফেব্রুয়ারির শুরুতে সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকা যান। সেই সময়ে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লি সফর করেন। সেই সময়ে তিনি যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। দোভালের ঢাকা সফর এবং হাছান মাহমুদের দিল্লি সফরের কারণ স্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারে, বিশেষ করে মিয়ানমারের চীন ও রাখাইন প্রদেশে, সে দেশের সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যে তীব্র সংঘাত চলছে সেটা ছিল আলোচনার বিষয়। গণমাধ্যমে যা জানা যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমারের সীমান্তের সংকট সামলাতে এই দুই দেশ একটি ‘সুসমন্বিত কর্মপরিকল্পনা’ বা ‘কো-অর্ডিনেটেড অ্যাকশন প্ল্যান’ নিয়ে এগোবে এমনটাই বলা হচ্ছে।
এ সব কথাবার্তা থেকে এটা আরও স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সবচেয়ে বড় কুশীলব হয়ে উঠেছে ভারত। ফলে এটা প্রশ্ন নয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা আছে কিনা। ২০১৩ সাল থেকেই এটা স্পষ্ট যে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। ২০১৩ সালের শেষে ২০১৪ নির্বাচনের অব্যবহিত আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকা সফর করেন। অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি জেনারেল এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নিতে চাপ দেন। সকল বিরোধী দল ঐ নির্বাচন বর্জন করেছিল। ২০১৮ সালে ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে, আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই ‘অত্যন্ত নিবিড়ভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করেছে’ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে ‘আওয়ামী লীগ পরবর্তী সংসদে একটি বিব্রতকর সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে’ (পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী, অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮)। তারপরও আওয়ামী লীগকে সমর্থনে ভারত অনড় ছিল। এই ধরনের কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশে এমন ধারণা জন্মে যে, হাসিনা সরকারের টিকে থাকার জন্য ভারতের সমর্থন অত্যাবশ্যক; কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এবং আলোচনা করা দরকার তা হচ্ছে, ভারত কেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে এতটাই উৎসাহী যে এই লক্ষ্যে ক্রমাগতভাবে যে কোনো ধরনের রাখঢাক করতেও আগ্রহী না।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা আলোচনার সময় আমাদের এটা মনে রাখা দরকার যে, আমরা এমন এক সময়ে বাস করি যখন অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কেবল দেশের ভেতরে কী ঘটছে সেটা দিয়ে বিচার করা যাবে না। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের পররাষ্ট্র এবং নিরাপত্তা নীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি বিবেচ্য এই কারণে যে, এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের যে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চলছে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশকে তার একটি মঞ্চ বা থিয়েটারে পরিণত করেছে।
গত বছর মে মাস থেকে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে বিশ্লেষকরা বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখার ব্যাপারে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে এটা স্পষ্ট ছিল যে তারা চান বাংলাদেশের শেখ হাসিনার সরকারকে অব্যাহত রাখার জন্য ভারত সবকিছুই করুক। একজন বিশ্লেষক লিখেছিলেন, ‘ভারতকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে থেকে এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি পরম শ্রদ্ধা রেখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনে জয়ী হতে সহায়তা করতে হবে।’ (হিরন্ময় কার্লেকার, দ্য পাইওনিয়ার, ৩ জুন ২০২৩)। আরেকজন বিশ্লেষক লিখেছিলেন, ‘হাসিনা শাসনকে সমর্থন করা ছাড়া ভারতের আর কোনো বিকল্প নেই।’ (অর্পিতা হাজারিকা, নাগাল্যান্ড পোস্ট, ৮ জুন ২০২৩)। এই বিশ্লেষণগুলো আসলে ভারতের এস্টাবলিশমেন্টের বক্তব্যগুলোকেই তুলে ধরেছিল। তাদের যুক্তির মর্মবাণী ছিল এই যে, ভারতের জাতীয় স্বার্থেই এটা করা দরকার।
তাদের দৃশ্যমান যুক্তি ছিল চারটি।
প্রথমত, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে (প্রণয় শর্মা, দ্য হিন্দু, ২০ আগস্ট ২০২৩)। এখানে গণতন্ত্র, সুষ্ঠু, সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চেয়েও ভারতের কাছে স্থিতিশীলতাই ছিল মুখ্য। একটি নির্বাচনে গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার হাত বদল ঘটলে তা কেনো অস্থিতিশীলতা বলে বিবেচিত হবে তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয়ত, ক্ষমতার হাত বদলের অর্থ হচ্ছে বিএনপি-তাদের ভাষায় বিএনপি-জামায়াত-ক্ষমতায় আসবে যাতে করে বাংলাদেশে ‘মৌলবাদীদের’ উত্থান ঘটবে; কেউ কেউ বলেছেন যে, এতে করে ‘ইসলামপন্থিরা’ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে এবং যদি জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতার ধারে কাছেও থাকে তাহলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীই চালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে (জ্যোতি মালহোত্রা, দ্য প্রিন্ট, ২৮ নভেম্বর ২০২৩)। অবাধ নির্বাচনে বিএনপিই বিজয়ী হবে এমন কোনো জনমত জরিপের কথা জানা যায় না। তাছাড়া এটা দৃশ্যত একটি পরিহাস যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বলে পরিচিত একটি ধর্মভিত্তিক দলের পক্ষ হয়ে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দলের রাজনীতি নিয়ে আপত্তি তোলা হচ্ছে। স্মরণ করা যেতে পারে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছিলেন যে, বিজেপি এবং জামায়াতের মধ্যে আঁতাত আছে ( দৈনিক বাংলা, ১০ ডিসেম্বর ১৯৯২)।
তৃতীয়ত, বিএনপি ক্ষমতায় আসলে ভারতে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, কেননা ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপির মেয়াদে বিএনপি উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন ও আশ্রয় দিয়েছে যা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল (অনন্যা ভট্টাচার্য, কোয়ার্টজ, ৫ জানুয়ারি ২০২৪)। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উত্থান এবং বিকাশের কারণ ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং গত এক দশকে এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের আপস করেছে, দুর্বল হয়ে পড়েছে ফলে তাদের প্রতি সমর্থনের বিষয় বিবেচ্য কিনা সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ।
চতুর্থত, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান চীনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য ভারতের প্রত্যক্ষ প্রভাব জরুরি (দ্য হিন্দুস্থান টাইমস, ২৮ আগস্ট ২০২৩)। স্মরণ করা দরকার যে, ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের ওপরে ভারতের একক প্রত্যক্ষ প্রভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে চীনের প্রভাব ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি হয়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এ যোগ দিয়েছে।
এই যুক্তিগুলো বারংবার বলা হলেও এগুলোর সারাৎসার যে তথ্যভিত্তিক বা বস্তুনিষ্ঠ নয় তা ভারতের এস্টাবলিস্টমেন্ট এবং বিশ্লেষকরা ভালোভাবেই অবহিত আছেন। তারা জানেন যে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকা গণতান্ত্রিক নয়। জ্যোতি মালহোত্রা ২৮ নভেম্বর ২০২৩ দ্য প্রিন্ট-এ লিখেছিলেন, “[ভারত] বুঝতে পেরেছে যে হাসিনা একজন নিখুঁত প্রধানমন্ত্রী নন-তিনি কঠোর হাতে শাসন করেন, প্রায়শই প্রয়োজনের চেয়ে কঠোর। তিনি মুক্ত ও স্বাধীন মিডিয়ার ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছেন, তিনি নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতাসীন দলের লাইন নিতে রাজি করিয়েছেন, নির্বাচনকে অবাধ ও স্বাধীন করার জন্য বিএনপিকে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত করার চেষ্টা করছেন, যাতে নির্বাচনকে অবাধ ও স্বাধীন দেখাতে পারে-এবং বিএনপি যদি গত দুবারের মতো নির্বাচন বর্জন করে, এত খারাপ দেখাবে না।” তিনি আরও লিখেছিলেন, “হাসিনা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য অসংসদীয় আচরণ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও বা নির্দেশ দিলেও ভারত নাক চেপে ধরে [সমর্থন দিয়ে যাবে]।
ভারতের নীতি নির্ধারকরা তো বটেই, এমনকি বিশ্লেষকরা নিজের দেশে গণতন্ত্রের চর্চায় কোনো ব্যত্যয় দেখতে চান না, কিন্তু প্রতিবেশী বাংলাদেশে ‘নাক চেপে’ ধরে হলেও কর্তৃত্ববাদের প্রতি সমর্থনকে যথাযথ মনে করেন। লক্ষণীয় যে এটা স্বীকার করতে তারা দ্বিধান্বিত নন। একেই ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ভারতের সাবেক কূটনীতিবিদ, বাংলাদেশে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরণ গণতন্ত্রের নিজস্ব পদ্ধতি বলে বর্ণনা করেছেন।” (কামাল আহমেদ, ‘ভারত কেন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বদলে স্থিতিশীলতার কথা বলছে’, প্রথম আলো, ২১ ডিসেম্বর ২০২৩)।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত কেন প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে আগ্রহী সেই বিষয়ে ভারতের এস্টাবলিশমেন্ট এবং বিশ্লেষকরা যে সব যুক্তি দেখান সেগুলো অনেকেই গ্রহণযোগ্য মনে করেন না, এগুলো দৃশ্যত গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। সে কারণেই প্রশ্ন ওঠে তা হলে ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে, যা সহজেই নিয়ন্ত্রণমূলক বলে প্রতীয়মান হয়, সেই ভূমিকা রাখতে চায় কেন? সাধারণ মানুষের মনেও প্রশ্ন আছে ভারত আসলে কী চায়। এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় এর কারণ হিসেবে তিনটি বিষয়কে চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার রাজনৈতিক অভিলাষ এবং ভূকৌশলগত নিরাপত্তা। দ্বিতীয় হচ্ছে অর্থনৈতিক স্বার্থ। তৃতীয় হচ্ছে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে সীমিত রাখা।
ভারত গোটা দক্ষিণ এশিয়াকে তার ব্যাকইয়ার্ড (বা উঠোন) বলে বিবেচনা করে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার সময় থেকে লক্ষ করলেই দেখা যাবে ভারত ভৌগোলিকভাবেই তার সীমানা বৃদ্ধি করতে চেয়েছে। যেহেতু ভারতের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন যে ভারত এমন এক নেইবারহুডে বা এলাকায় অবস্থিত যেখানে তার চারপাশের দেশগুলো তার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন, সেহেতু ভারত তার প্রতিবেশীদের ওপরে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ করতে অভ্যস্ত। এক্ষেত্রে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর ক্ষমতাসীনরা তাদের অভ্যন্তরীণ এবং পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ে ভারতের পরামর্শ গ্রহণ করবে। এর অন্যথা হলেই ভারত তার স্বার্থের অনুকূলে যে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সিকিমের ইতিহাস, বিশেষ করে সিকিম কী করে ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হলো সেই ইতিহাস যারা জানেন, তারা একথা সহজেই উপলব্ধি করবেন। কিন্তু সিকিমের ঘটনা একার্থে ব্যতিক্রম নয়, শ্রীলঙ্কায় সৈন্য প্রেরণ (১৯৮৭-১৯৯০), নেপালের বিরুদ্ধে একাধিকবার (১৯৮৯, ২০১৫) ঘোষিত-অঘোষিত অবরোধ আরোপের ঘটনাই শুধু ঘটেনি, ক্ষমতায় কে থাকবে না থাকবে সেটার ব্যাপারে ভারতের দূতিয়ালির ঘটনা ঘটেছে, নেপালের সংবিধান নিয়ে ভারত প্রকাশ্যে আপত্তি করেছে। মালদ্বীপে ১৯৮৮ সালে সেনাঅভ্যুথানের মুখে ভারত সৈন্য পাঠিয়েছিল। সেখানের রাজনীতিতে ভারতের উপস্থিতি যে প্রত্যক্ষ তা ২০২৩ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীদের পরিচিতি এবং সেই সময়ের বিতর্কের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
ভারতের এই দৃষ্টিভঙ্গি যে আরও বেশি দৃঢ় এবং সুস্পষ্ট রূপ নিয়েছে ২০০১ সালের পর থেকে তা আগেই উল্লেখ করেছি। তার একটি কারণ হচ্ছে ভারতের ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা। তা ছাড়াও ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তন এবং চীনের উত্থান ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা তার কারণ। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চীনের মোকাবিলা করার জন্য ভারতের ওপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা ভারতের দীর্ঘ দিনের যে সুপ্ত আকাক্সক্ষাকে জাগিয়ে তোলে তা হচ্ছে নিজেকে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে উপস্থিত করা। বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে ভারতের দাবির জন্য তার দরকার তার এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনরো ডকট্রিনের অনুসরণে এটাই হচ্ছে ভারত ডকট্রিন। যার অর্থ হচ্ছে তার প্রতিবেশী দেশে অন্য কোনো শক্তির উপস্থিতি সহ্য না করা।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভারত মহাসাগরে চীন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে। গত দুই দশকে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূত্রেই চীন ভারত মহাসাগরের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে তার উপস্থিতি বাড়াতে শুরু করে। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে ভারত মহাসাগরে অবস্থিত ছয়টি দ্বীপ-শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মরিশাস, সিসিলিস, মাদাগাস্কার এবং কমোরোসে চীনের দূতাবাস আছে, এদের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে। অন্যদিকে ১৯৬২ সাল থেকেই মিয়ানমারের সঙ্গে সখ্যের কারণে চীন সেখানে ব্যাপকভাবে উপস্থিত। ভারত মহাসাগরের অংশ হিসেবে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব অপরিসীম। বঙ্গোপসাগর দিয়ে পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ বাণিজ্যিক পণ্য পরিবাহিত হয়। বাণিজ্যিক বিবেচনার বাইরে নিরাপত্তার বিবেচনাও ভারত চায় বঙ্গোপসাগরে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হোক। ভারত মহাসাগরে চীনের এই উপস্থিতিকে ভারত তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচনা করে। যে কারণে ভারত মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে।
শুধু তাই নয়, চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারত আরাকান প্রদেশে বন্দর তৈরি করেছে। ভারতের কালাদান মাল্টি মোডাল প্রজেক্টের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে কলকাতার সঙ্গে দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলোর যোগাযোগ সহজ করা। শ্রীলঙ্কায় ভারতের এই প্রকল্পের লক্ষ্য একাধিক, যার মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে যা সাবমেরিনগুলো কিনেছে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি নৌঘাঁটি তৈরি করা হয়েছে তার ওপরে নজর রাখা; কিন্তু ভারতের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির ওপরে নজরদারি করা। এ কারণে ভারত শ্রীলঙ্কা, মরিশাস এবং মালদ্বীপে ‘কোস্টাল সার্ভেল্যান্স’ বা উপকূলীয় নজরদারি ব্যবস্থার জন্য রাডার স্থাপন করেছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ভারত ২০টি আধুনিক রাডার সিস্টেম বসানোর ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে ২০১৯ সালে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। বলা হচ্ছে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে ‘মেরিটাইম সিকিউরিটি’ বা সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই পদক্ষেপ কার্যকর হবে। এতে করে বাংলাদেশ কার্যত চীনের বিপরীতে ভারতের যে নিরাপত্তা সেটাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের স্মরণ করা দরকার যে, বাংলাদেশ ভারতকে চট্টগ্রাম এবং মংলাবন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে।
ভারতের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের বাংলাদেশকে ব্যবহার করার এটাই একমাত্র ঘটনা নয়। ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যের যোগাযোগের পথ হচ্ছে শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেন্স নেক। ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এই করিডর একটি দুর্বল গ্রন্থি। ভারত এই পথের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করে উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশের ভেতরে দিয়ে যাতায়াতের চারটি পথ নিশ্চিত করেছে। এই ট্রানজিট রুটগুলো কেবল বাণিজ্যিক সুবিধাই দেবে এমন মনে করার কারণ নেই। এগুলো থেকে দেখা যায় যে, ভারত বাংলাদেশের ওপরে তার নিয়ন্ত্রণ রাখতে আগ্রহী যাতে করে ভারতের ভূ-কৌশলগত নিরাপত্তা এবং স্বার্থ অক্ষুণ্ণ থাকে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির গোড়াতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের ঢাকা সফর এবং তারপর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের দিল্লি সফরের সময় মিয়ানমারের চীন এবং রাখাইন রাজ্যের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা এবং যে ‘সুসমন্বিত কর্মপরিকল্পনা’র কথা বলা হচ্ছে তার প্রাথমিক লক্ষ্য কার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা? রাখাইন রাজ্যে ভারতের যে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ আছে এবং ওই অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থ যেভাবে সংশ্লিষ্ট তা কি বাংলাদেশের সঙ্গে অভিন্ন? রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশের যে দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া দরকার তা কি ভারতের স্বার্থের অনুকূল?
ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থের বিষয়টি এই তথ্যেই স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ ভারতে যত রপ্তানি করে তার চেয়ে বেশি আমদানি করে। ২০২২-২৩ সালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সামগ্রিক আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার পরও ভারত থেকে আমদানি হয়েছিল ১২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করেছে ২ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। এই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি ভারতের অনুকূলে ক্রমবর্ধমান। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ১৮ কোটি বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে। অর্থনৈতিক স্বার্থের বিবেচনাটি কেবল বাণিজ্য ঘাটতি দিয়ে দেখলে হবে না। বাংলাদেশের আমদানি কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে বাংলাদেশেকে বিভিন্ন ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য ভারতের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতের দিকে তাকালে আমরা এই অর্থনৈতিক স্বার্থের বিষয়টি বুঝতে পারব। এই বছর বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতার ৪০ শতাংশ অলস থাকবে বলেই সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে (শেয়ার বিজ, ৩১ জানুয়ারি ২০২৪)। অথচ প্রতিবছর ভারতের আদানি থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই আদানি পাওয়ার (ঝাড়খন্ড) লিমিটেডকে (এপিজেএল) পরিশোধের জন্য ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিল অনুমোদন করেছে (ইত্তেফাক, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে গৌতম আদানির ঘনিষ্ঠতা সকলের জানা এবং এই বিষয়ে ভারতের বিরোধী দল ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রশ্ন তুলেছে। ভারতের ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করেছিল।
বাংলাদেশের ওপরে ভারত তার নিরঙ্কুশ প্রভাব নিশ্চিত করতে চায় এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব সীমিত রাখতে। এটা আপাতদৃশ্যে বিস্ময়কর মনে হতে পারে, কেননা ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ মিত্র বলেই পরিচিত। এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চীনের প্রভাব মোকাবিলায় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র একত্রে কাজ করে এবং চতুর্পাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপ কোয়াডের সদস্য; কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে ভারত চীনের সঙ্গেই অবস্থান নিয়েছে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতের বাণিজ্যিক স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক আকারে বিনিয়োগ ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশের বাজার সৃষ্টি করবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য বাংলাদেশে ভারতের যে ক্যাপটিভ মার্কেট আছে তাতে বড় রকমের ধাক্কা দেবে মনে করা অতিরঞ্জন নয়। এর একটি রাজনৈতিক দিকও আছে। গত কয়েক বছরে মোদি সরকারের আমলে ভারতে গণতন্ত্রের ব্যাপক ক্ষয় ঘটেছে; মানবাধিকার এবং মতপ্রকাশের অধিকার সংকুচিত হয়েছে। এই রকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হলে ভারতে তার অনুপস্থিতি জাজ্বল্যমান হয়ে উঠবে এবং তা মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের এই দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের জন্য অনুকূল কিনা সেটা বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা বুঝতে পারেন না এমন মনে করার কারণ নেই। দৃশ্যত তাদের দলীয় স্বার্থ এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য তারা এগুলোকে গ্রহণযোগ্য বলেই বিবেচনা করছেন। আশু মেয়াদে তা তাদের জন্য লাভজনক, ভারতের জন্যও। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদের বিবেচনায় ভারতের নীতিনির্ধারক, বাংলাদেশের অন্য রাজনৈতিক দলসমূহ এবং নাগরিক সমাজের সদস্যরা এই প্রশ্নগুলো কীভাবে মোকাবিলা করবেন তার ওপরেই নির্ভর করবে ভারতের এই প্রভাব আগামীতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট।
News Courtesy: