ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ডিপ্লোম্যাটে আলী রীয়াজের সাক্ষাৎকার

ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ডিপ্লোম্যাটে আলী রীয়াজের সাক্ষাৎকার

বাংলাদেশে সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ড. আলী রীয়াজের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে দ্য ডিপ্লোম্যাট। আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। ড. রিয়াজ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। তার গবেষণা ও প্রকাশনার ক্ষেত্র হচ্ছে গণতন্ত্র, সহিংস উগ্রবাদ, ধর্ম ও রাজনীতি এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত তার সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করে কালবেলায় তুলে ধরা হলো -

বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান বিরোধীদলসহ তাদের সমমনা দলগুলোর নির্বাচন বয়কটের মধ্যেই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আবারও ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে টানা চতুর্থবারের মেয়াদে ক্ষমতায় বসেছে দলটি। নির্বাচনের আগে থেকেই বিরোধীদলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার রাখা হয়েছে। নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুবই কম যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। অনেক বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ একদলীয় শাসনের দিকে এগিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে?

আমি মনে করি বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ লেখা হয়ে যায়নি। বরং তা এখনও লেখা হচ্ছে : বিরোধীরা যদি বুঝতে পারে, দেশ একদলীয় শাসনের যুগে প্রবেশ করছে, তাহলে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে পারে। তারা ভাবতে পারে, রাজনীতির বর্তমান গতিপথই তাদের নিয়তি নয়।

জনসাধারণের কথা বলার এবং প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ অনেকাংশে কমিয়ে ফেলা হয়েছে। যদিও ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় নাগরিকরা অসন্তোষ ও হতাশা প্রকাশ করছে, তবুও এখন পর্যন্ত কোনো জনরোষ দেখা যায়নি। বিরোধীদলের অংশগ্রহণবিহীন এবং কম ভোটার উপস্থিতির নির্বাচনের পরেও জনগণের কাছ থেকে শক্তিশালী কোনো প্রতিক্রিয়া না আসার জন্য মোটামুটি ৩টি কারণকে দায়ী করা যেতে পারে।

প্রথমত, নির্বাচন এমন হবে সেটি অপ্রত্যাশিত ছিল না। ২৮ অক্টোবর থেকে, ঘটনার প্রবাহ জনসাধারণের কাছে স্পষ্ট ধারণা দিয়েছে, নির্বাচন এমনই হবে। আর একারণে মানুষ নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। দ্বিতীয়ত, নির্যাতিত হওয়ার ভয়। ভয়ের সংস্কৃতি সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে এবং আমরা নিপীড়নের প্রকৃতি প্রত্যক্ষও করেছি। এসবই একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছে। তৃতীয়ত, বিরোধীদলগুলোর মধ্যে ঐক্যের অনুপস্থিতি। ১৬টি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করলেও তারা একক মঞ্চে আসতে ব্যর্থ হয়েছে। একইভাবে, জনসাধারণ মনে করেন- এমন একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা নেই যিনি সবাইকে একত্রিত করতে পারেন।

ভারত, চীন এবং রাশিয়ারর প্রতিক্রিয়া আগে থেকেই অনুমানযোগ্য ছিল। তারা শেখ হাসিনার বিজয়কে স্বাগত জানান। এদের মধ্যে, চীনের বিবৃতি ছিল সবচেয়ে জোরাল। তারা ‘চীন-বাংলাদেশ সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারত্বকে’ একটি নতুন উচ্চতায় উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া মৃদু সমালোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে জোরাল মনোভাব প্রকাশ করেছে, তারা নির্বাচনকে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নয়’ বলে বিবৃতি দিয়েছে। তবে তার বিবৃতিতে একটি অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করার প্রতিশ্রুতির কথাও বলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাজ্য জোর দিয়ে বলেছে, এই নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মৌলিক উপাদানগুলো পূরণ করেনি। নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য, উন্মুক্ত এবং ন্যায্য প্রতিযোগিতার ছিল না। কানাডা হতাশা প্রকাশ করে বলেছে, এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্রের নীতির ঘাটতি হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের কাছ থেকে তীব্র নিন্দা এসেছে, তিনি বিরোধীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা, প্রচারণার সময় এবং নির্বাচনের দিনে আইন লঙ্ঘন ও অনিয়মের ঘটনাগুলো স্বাধীন ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়াও ‘সব বাংলাদেশির ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

চীনের বিবৃতিটি খুব মনোযোগ সহকারে পড়তে হবে। বিবৃতিটি কেবল অভিনন্দন বাক্য বা একটি সাধারণ অভিনন্দন বার্তা ছিল না। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় এবং বহিরাগত হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করতে চীন বাংলাদেশকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে।’ বিবৃতিটি চীনের পূর্বের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে। অবশ্য বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অবক্ষয়ের বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশগুলোর মনোযোগও স্পষ্ট। তবে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো আবারও গণতন্ত্রের চেয়ে আঞ্চলিক স্বার্থের কথা চিন্তা করছে বলে মনে হচ্ছে যা চীনের আরও উত্থানকে সহজতর করবে।

আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলোর কার্যত কোনো ভূমিকা ছিল না। বিগত নির্বাচনে এই দলগুলোর জনপ্রিয়তা কেমন ছিল সেই হিসেবে দেখলে এবারের নির্বাচনে তাদের ভূমিকা কেমন হবে সেটা আগে থেকেই অনুমানযোগ্য ছিল। নির্বাচনে ছিল ৪টি নতুন দল যারা আগে কখনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচনে অংশ নেওয়া ২০ টি দল ২০১৮ সালের নির্বাচনে ১ শতাংশেরও কম ভোট পেয়েছিল।

এই দলগুলো সরকারের কাছে আসন ভাগ করার জন্য অনুরোধ করেছিল। পূর্বের নির্বাচনগুলোতে আসন ভাগের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে অনেকেই সংসদ সদস্য হয়েছিল। সরকার এই দলগুলোকে নির্বাচনে যোগদানের জন্য প্ররোচিত করেছিল। একবার এই দলগুলো মনোনয়ন জমা দিলে তারা শাসনের জন্য অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। এখন এসব দল ও তাদের নেতাদের কেউ কেউ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করে কান্নাকাটি করছে।

নিঃসন্দেহে আগামী দিনে বিএনপি কঠিন সময়ের মুখোমুখি হবে। কিন্তু তারা সংসদের বাইরে থাকবে বলে নয়; দলটি ২০১৪ সালের পর সংসদের বাইরে ছিল এবং গত সংসদে তাদের মাত্র সাতজন সদস্য ছিল। বিএনপির ভবিষ্যৎ কঠিন হতে চলেছে, একারণেও নয় যে তাদের জনসমর্থন নেই। প্রকৃতপক্ষে ২০২২ সালের গ্রীষ্ম থেকে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি আয়োজিত সমাবেশগুলোতে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করেছে এবং এই জনসমর্থন ক্রমবর্ধমান বলে দেখা গিয়েছিল। বিএনপিকে ভাঙার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দলটি ঐক্যবদ্ধ ছিল। অন্যান্য বিরোধীদলগুলোর সঙ্গে বিএনপির ঐক্যবদ্ধ আহ্বান জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এসব ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান প্রমাণিত হয়েছে।

কিন্তু দলের নেতাকর্মীদের দুর্দশা আরও বাড়বে কারণ তারা শাসকদের কঠোর পদক্ষেপের সম্মুখীন হতে পারে। কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়াই ‘অদৃশ্য মামলা’, কয়েক বছরের পুরোনো অভিযোগসংক্রান্ত হয়রানি চলতেই থাকবে। অনেককে দোষী সাব্যস্ত করা হবে যেমনটা আমরা নির্বাচনের আগে দেখেছি। এক অর্থে বিএনপির ভবিষ্যৎ দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের সঙ্গে অন্তর্নিহিতভাবে জড়িত। নিপীড়নের মাধ্যমে দলটিকে নিষিদ্ধ বা আন্ডারগ্রাউন্ডে ঠেলে দেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তবে নির্বাচনই বাংলাদেশের রাজনীতির শেষ নয়। বিরোধীরা যদি উপলব্ধি করতে পারে, দেশ একদলীয় শাসনের যুগে প্রবেশ করছে, তাহলে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে পারে। তারা ভাবতে পারে, রাজনীতির বর্তমান গতিপথই তাদের নিয়তি নয়। সব প্রতিকূলতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আপাতদৃষ্টিতে বিএনপিই সবচেয়ে শক্তিশালী দল।

আলী রীয়াজ : যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট

News Courtesy:

https://www.kalbela.com/opinion/sub-editorial/63735

An unhandled error has occurred. Reload 🗙