তাহের আবু সাইফ, আপনি বাংলাদেশের গর্ব
তাহের আবু সাইফ যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (এনএই) সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এনএইর সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়া হচ্ছে, বৈশ্বিকভাবে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কৃতীমান বিশিষ্ট গবেষক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ।
প্রতিবছর এ ধরনের স্বীকৃতি লাভের যোগ্যতা অর্জন করেন এক থেকে দেড় শ গবেষক, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থেকে থাকেন ২০ থেকে ২৫ জন। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে একে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি বলে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশি ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের মধ্যে এযাবৎ তাহের আবু সাইফসহ এই স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনজন। ১৯৭৩ সালে স্থপতি ড. ফজলুর রহমান খান এবং ২০০১ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ড.ফজলে হুসেইন।
তাহের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়, আরবানা শ্যাম্পেনের মেকানিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক, ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর এবং কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন তিনি। তাঁর কাজের ক্ষেত্র হচ্ছে বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং। ন্যানো রোবটের একজন অন্যতম উদ্ভাবক তিনি।
এক দশকের বেশি সময় ধরে তিনি নিরলসভাবে কাজ করছেন ক্যানসারের নিরাময়বিষয়ক গবেষণা নিয়ে। হঠাৎ মনে হতে পারে, যিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত নন, তিনি কী করে ক্যানসার নিয়ে গবেষণা করছেন। এখানেই তাহের এবং তাঁর গবেষক দলের বৈশিষ্ট্য। তারা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রযুক্তিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে কাজ করছেন।
২০১৪ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘এমন একসময় হয়তো আসবে, যখন কোনো রোগীর একটি নির্দিষ্ট স্থানে (যেমন ক্যানসার রোগীদের নির্দিষ্ট টিউমার অংশ) ওষুধ দিতে হলে সেটি রোবট দিয়ে করা সম্ভব হবে। এর ফলে ওষুধ নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে শরীরের অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়বে না।’
তাহের কী ধরনের কাজ করছেন, তার একটি ধারণা পাওয়া যায় ২০১৪ সালে পৃথিবীর বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল ‘নেচার কমিউনিকেশন’-এ।
তিনি ও তাঁর নেতৃত্বাধীন গবেষক দল আবিষ্কার করে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট রোবট। এর নাম হচ্ছে ‘রোবোটিক বায়োলজিক্যাল সুইমার’ (বায়ো-বট সুইমার)। এটি যে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট রোবট, তা-ই নয়; এর কাজ হচ্ছে, রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে গেলে কিংবা ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর কোষে নির্দিষ্ট স্থানে ওষুধ দিতে পারা। তাঁরা যদি সফল হন, তাহলে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সম্ভব হবে। নিরাময়ও সম্ভব হতে পারে।
তাহের সাইফের এই কাজ নিয়ে ২০১৪ সালে প্রথম আলোয় লিখেছিলেন নুরন্নবী চৌধুরী (‘আমিই বাংলাদেশ: বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র রোবট’, ৪ আগস্ট ২০১৪)। এক দশক আগে তিনি বলেছিলেন, ‘জীবন আর যন্ত্রের সমন্বয়ে আরও কিছু রোবট তৈরি করতে চাই।’ ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাহের ও তাঁর দলের আবিষ্কার নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে বলা হয়েছিল, ‘২০১৬ সালের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হতে পারে এই প্রযুক্তি।’
তাহের সাইফের এসব আবিষ্কার নিয়ে ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি কথা বলেছিলেন আনিসুল হকের সঙ্গে। আনিসুল হক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এই যে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে এটা, ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল আপনাকে নিয়ে লিখেছে বড় প্রতিবেদন, নানা বিজ্ঞান সাময়িকীতে লেখা হচ্ছে, কেমন লাগে আপনার?’ তার উত্তরে তাহের বলেছিলেন, ‘স্বপ্নটাই বড়। আমি রোজ ঘুম থেকে উঠি, আরও আত্মবিশ্বাসী হই, পারব।’ (ড. তাহেরের জীবন্ত রোবট, ৩ জানুয়ারি ২০১৬, প্রথম আলো)।
তাহের স্বপ্ন দেখেন, আমাদেরও স্বপ্ন দেখান। আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন স্বপ্ন দেখার কথা।
মৃদুভাষী, সজ্জন তাহের প্রচারবিমুখ মানুষ। আমার বন্ধুজন। দেখা হলে তাঁর আচরণ আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে কী করে নিজের কাজে নিবেদিত হতে হয়। এই সংবাদ পাওয়ার পর ফোনে অভিনন্দন জানাতে গেলে তাহেরের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, ‘খুব বড় বিষয় নয়’। কিন্তু তারপরই বলেন, ‘কাজ বাড়ল, দায়িত্ব বাড়াল।’ স্বীকৃতির আনন্দের পাশে দায়িত্বশীলতার স্মরণ, এই হচ্ছে কাজের অঙ্গীকার।
আমরা এমন একসময়ে বাস করছি, যখন সুসংবাদ খুব বেশি পাই না। অন্যদিকে আছে প্রচারের উৎসব, যার অনেকটাই আদৌ প্রচারের যোগ্য কি না, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। অথচ কৃতী মানুষদের কাজ নিয়ে প্রচার হয় না। তাঁরা থাকেন আড়ালে। অনুপ্রেরণার উৎসগুলো সীমিত, বিজ্ঞানচর্চার আগ্রহ তৈরি হবে—এমন পরিবেশ বাংলাদেশে প্রায় অনুপস্থিত।
তাহের আবু সাইফের এই স্বীকৃতিকে উপলক্ষ করে হলেও বাংলাদেশে অনেকে তাঁর কাজের সঙ্গে পরিচিত হবেন, সেটা প্রত্যাশা। তার চেয়েও বড় আশা হচ্ছে, বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে স্বপ্ন জেগে উঠুক, গবেষণার আগ্রহ জাগুক, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হোক। প্রতিকূল পরিবেশেও নতুন কিছু আবিষ্কার করার, মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার চেষ্টা শক্তিশালী হয়ে উঠুক।
তাহেরের হাতে এই স্বীকৃতিপত্র তুলে দেওয়া হবে আগামী সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিং আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে। ন্যাশনাল একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৬৪ সালে। এর সদস্যসংখ্যা হচ্ছে দুই হাজার। এটি ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসের (এনএএস) অংশ। ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন স্বাক্ষরিত কংগ্রেসের একটি আইন দিয়ে এনএএস প্রতিষ্ঠিত।
এনএএসের কাজ হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-সম্পর্কিত বিষয়ে স্বাধীন পরামর্শ দেওয়া। ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেডিসিন একত্রে কাজ করে।
এর সদস্যদের ১৯০ জন হচ্ছেন নোবেলজয়ী। সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটনে যে অনুষ্ঠান হবে, তার একটা বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই অনুষ্ঠানে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। তাঁর কারণ হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখা।
তাহেরের এই সাফল্য ও স্বীকৃতিতে তাঁকে অভিনন্দন। তাহের, আপনাকে নিয়ে আমরা গর্ব করব; বাংলাদেশ যেন গর্ব করে, সেটাই আশা।
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট
News Courtesy:
https://www.prothomalo.com/opinion/column/4u7o4xrs5d?fbclid=IwAR2i8yb5_6sYfvi_mi4MfsFptFW9o_3twYRIj5vH1-EsBANUS13BvrgMyX4