মার্কিন নিষেধাজ্ঞার এক বছর: সরকারের মনোভাব কতটা পাল্টেছে

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার এক বছর: সরকারের মনোভাব কতটা পাল্টেছে

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাব এবং তার সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের এক বছর পূর্তিতে এই প্রশ্ন উত্থাপন করা স্বাভাবিক যে বাংলাদেশের ওপর এর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিষয়ে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে এবং এই সব বাহিনীর সদস্যরা যে কার্যত দায়মুক্তি ভোগ করেন, তাতে কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কি না, সে বিষয়ে হিসাব-নিকাশ করার তাগিদ অনুভব করাই স্বাভাবিক। 

গত বছর ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যেসব অভিযোগে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, অর্থাৎ বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুম, তা নতুন কোনো বিষয় ছিল না। এক দশকের বেশি সময় ধরেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রমাণাদিসহ এই সব বিষয়ে অভিযোগ করে এসেছে। ফলে মানবাধিকার সংগঠন এবং কর্মীরা মনে করেছেন যে এই পদক্ষেপ বরং দেরিতেই নেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ এই পদক্ষেপকে সীমিত বলেই মনে করে থাকেন।

তবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে এই পদক্ষেপ ছিল অভাবিত এবং সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল দ্রুত। সরকার আগে যেমন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বলেছে, সেই ধারা অক্ষুণ্ন রেখে যথারীতি এসব ঘটনা অস্বীকার করে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। যাঁরা বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মাত্রা বিষয়ে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন না, তাঁরাও এই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে মনোযোগ দেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পশ্চাদযাত্রার বিষয়ে আরও বেশি আলোচনার সূত্রপাত হয়। বাংলাদেশের যাত্রা যে স্বৈরতন্ত্র অভিমুখী হয়ে পড়েছে, তা অনেকেরই নজরে আসে। এক বছরে এই পরিস্থিতির কোনো ধরনের বদল ঘটেনি, বরং এখন বিরাজমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষিতে শাসনব্যবস্থার এই দিক আরও বেশি প্রকট হয়েছে, আলোচিত হচ্ছে।

নিষেধাজ্ঞার অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত লবিস্টকে আবারও সক্রিয় করে এই প্রত্যাশায় যে লবিস্ট মার্কিনি আইনপ্রণেতাদের এটা বোঝাতে পারবেন যে তাঁরা ভুল তথ্যে বিভ্রান্ত হয়েছেন; পরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আইনজীবী নিয়োগের কথাও বলা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে নীতি প্রণয়নের প্রক্রিয়া বিষয়ে যঁারা জানেন, তাঁরা এটা স্মরণ করিয়ে দেন যে এসব পদক্ষেপ প্রভাব ফেলতে পারবে না। আইনপ্রণেতারা সরকারের প্রোপাগান্ডার চেয়ে যে স্বাধীন মানবাধিকারগুলোর সংস্থার দেওয়া তথ্যেই আস্থা রাখবেন, সেটাই স্বাভাবিক। এই সব প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ সরকার কত অর্থ ব্যয় করেছে, তা জানা না গেলেও এটা স্পষ্ট যে সরকার একসময় এই পথে সাফল্যের আশা ত্যাগ করেছে। কিন্তু ইতিমধ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন যে মানবাধিকার সংস্থাগুলো গুমের শিকার বলে যাদের তালিকা দিয়েছে, তাঁদের অনেকেই অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টায় ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছেন।

বাংলাদেশ সরকার যে এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করার কৌশল গ্রহণ করেছে, তার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, এর সঙ্গে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা যোগ করা হয়নি। তদুপরি সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে যা হয়, এ ক্ষেত্রেও তা–ই হয়েছে; যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ ক্রমাগত উপেক্ষার মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে অন্যান্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখার নীতিতে পরিবর্তনের আশঙ্কা তৈরি করা হচ্ছে কি না, সেটা ক্ষমতাসীনেরা বিবেচনা করছে বলে মনে হয় না।
গুমের ঘটনা ও এর সঙ্গে অভিযোগ ওঠা সংস্থার বিষয়ে তদন্ত না করে পুলিশ উল্টো গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারকে হেনস্তা করতে শুরু করে। অভিযোগ ওঠে যে পুলিশ তাঁদের এমন বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে জোর করছে, যেখানে বলা হচ্ছে যে পরিবারগুলো পুলিশকে ভুল তথ্য দিয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যা বা গুমের ঘটনাগুলো ধামাচাপা দিতেই উৎসাহী এবং এগুলো অব্যাহত রাখার ব্যাপারেই আগ্রহী। মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন র‍্যাবের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে ‘গর্হিত কাজ’ বলে বর্ণনা করেন, সেই সময়ে বোঝা যায় যে বাংলাদেশ এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করাকেই কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে। আগস্টে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত বাংলাদেশ সফরের সময়ও সরকার এই কথাই বলে যে মানবাধিকার সংগঠনের দেওয়া গুমের তালিকা সঠিক নয়।

বাংলাদেশ সরকার যে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করার কৌশল নিয়েছে, সেটা বিভিন্ন কার্যক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জানুয়ারি মাসেই নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন দুই র‍্যাব কর্মকর্তা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন এবং কর্নেল খান মোহাম্মদ আজাদকে পুলিশের সর্বোচ্চ পদকে ভূষিত করা হয় এবং সেপ্টেম্বরে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনকে পুলিশের প্রধান (আইজিপি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আগস্টের শেষে নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন তৎকালীন পুলিশ প্রধান এবং র‍্যাবের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদকে জাতিসংঘে পুলিশপ্রধানদের সম্মেলনে যোগদানের জন্য মনোনীত করা হয়। জাতিসংঘের সম্মেলন বা বৈঠকে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের ভিসা দেওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার সূত্রে তিনি নিউইয়র্ক সফর করেন এবং সেখানে বাংলাদেশের নাগরিকদের একটি সংবর্ধনায় ভাষণও দেন, যেখানে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তারাও।

এসব ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্ট হয় যে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে একধরনের চাপ অনুভব করলেও ক্ষমতাসীনেরা তাদের অবস্থান অব্যাহত রাখাই শুধু নয়, বরং জোরদার করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা যে র‍্যাবকে সব ধরনের জবাবদিহির ঊর্ধ্বে রাখতেই আগ্রহী, তা র‍্যাবের নতুন প্রধান খুরশিদ খানের অক্টোবরে বলা বক্তব্যেই স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘র‍্যাব সংস্কারের প্রশ্নই ওঠে না’। অন্যদিকে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের দূত পিটার হাস বারবার বলেছেন, ‘জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানবাধিকার আইন মেনে চলা ছাড়া র‍্যাবের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নেই।’

র‍্যাবের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুমের ঘটনা হ্রাস পেয়েছে, এটা যদি বলা হয়ে থাকে, তা আংশিকভাবে সঠিক। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’–এর দেওয়া তথ্য ও সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ-সিজিএসের জন্য করা গবেষণা অনুযায়ী, ২০০২ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হত্যার শিকার হয়েছেন ২৫ জন। ২০২১ সালে একই সময়ে মারা গিয়েছিলেন ৫৯ জন। ওই বছর মারা যান ৭৮ জন। অধিকার বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরে গুমের শিকার হয়েছেন ১৬ জন, সিজিএসের গবেষণায় সেই সংখ্যাটি ২২, সারা বছরে ২৪ জন। সংখ্যার এই হেরফের সামান্যই, তদুপরি এমনকি একটি বিচারবহির্ভূত হত্যা, একটি গুমের ঘটনাও অগ্রহণযোগ্য, নাগরিকের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

বাংলাদেশ সরকার যে এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করার কৌশল গ্রহণ করেছে, তার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, এর সঙ্গে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা যোগ করা হয়নি। তদুপরি সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে যা হয়, এ ক্ষেত্রেও তা–ই হয়েছে; যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ ক্রমাগত উপেক্ষার মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে অন্যান্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখার নীতিতে পরিবর্তনের আশঙ্কা তৈরি করা হচ্ছে কি না, সেটা ক্ষমতাসীনেরা বিবেচনা করছে বলে মনে হয় না।

এক বছর আগে র‍্যাবের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যে গভীর উদ্বেগ, সেটি তার অংশ। ফলে সেই পরিস্থিতির ব্যাপারে কিছু না করার কৌশল ক্ষমতাসীনদের কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রমাণ। এগুলো অন্যরা লক্ষ করছেন না, এমন মনে করা বিবেচকের পরিচায়ক নয়। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে অব্যাহতভাবে মতপ্রকাশের অধিকার, সমাবেশের অধিকারসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মনোযোগের মধ্যে আছে। গত কয়েক দিনে বিভিন্ন দূতাবাসের বক্তব্য, জাতিসংঘের বিবৃতি, সভা-সমাবেশের অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ারের টুইট এই ইঙ্গিত দেয় যে ভিন্নমত দমন এবং বিরোধী রাজনীতিবিদদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাগুলো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি লক্ষ করা হচ্ছে। র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার এক বছরের মাথায় এগুলো সবারই মনে রাখা দরকার।

● আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট

News Courtesy:

https://www.prothomalo.com/opinion/column/b7fcv3x0ac?fbclid=IwAR0YxmTHOgxebcjp8GCqtPVX9Ker9riZ9Th5BaAz6-jr01w_s7sakhneswo

An unhandled error has occurred. Reload 🗙