সিইসির মুখে কেন রাজনীতিবিদদের মতো কথা

সিইসির মুখে কেন রাজনীতিবিদদের মতো কথা

নির্বাচন কমিশন যে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে একটি ছেলেখেলায় পরিণত করেছে, তার বহুবিধ প্রমাণ রয়েছে। নতুন যুক্ত হলো গাজীপুরের সিটি নির্বাচনের প্রস্তুতি দেখতে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের মন্তব্য। তিনি বলেছেন, ‘কালোটাকা দিলে নেবেন, কিন্তু ভোটটা পছন্দমতো লোককে দেবেন। যেহেতু ভোট দেওয়ার সময় ওই ব্যক্তি আপনাকে দেখবে না।’ (এনটিভি অনলাইন, ১০ মে ২০২৩) 

বুধবার সিইসি গাজীপুর গিয়েছিলেন নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নানা অভিযোগ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা সরেজমিন দেখার জন্য; পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে মতবিনিময় করতে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হচ্ছে, ‘মতবিনিময় সভায় প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে চলাসহ নির্বাচন সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ করার জন্য নানা বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেন সিইসি।’ তাঁর এ বক্তব্যকে ‘নির্দেশনা’ বলে মনে করবেন কি না, সেটা প্রার্থীরা ও ভোটাররা বলতে পারবেন। কিন্তু এতে কালোটাকা দেওয়ার ব্যাপারে প্রার্থীরা যে নিরুৎসাহিত হবেন না, তা বোধগম্য। 

সিইসির এ মন্তব্য অনেকটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথার প্রতিধ্বনির মতো। ২০২১ সালের ২১ মার্চ মমতা বলেছিলেন, ‘বিজেপি ভোট কিনতে টাকা দিলে নিয়ে নেবেন, কিন্তু ভোট দেবেন তৃণমূলকে’। এ ধরনের কথা বলার সময়ে মমতা খানিকটা রাখঢাক করেছিলেন, ‘এমনিতে অর্থের বিনিময়ে ভোট দেওয়া অপরাধ। তবে ওরা যে অর্থ দেবে, সেটা তো আপনাদেরই। তাই সেটা নিয়ে নেবেন, তারপর ভোট দেবেন তৃণমূলকে।’ (প্রতিদিনের সংবাদ, ২১ মার্চ ২০২১) বাংলাদেশের সিইসি এটুকু রাখঢাক করেছেন বলে খবরে বলা হয়নি। তা ছাড়া একজন রাজনীতিবিদ যে ভাষায় কথা বলেন, নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনের প্রধান তা বলতে পারেন না, এটা নিশ্চয় সবাই বুঝতে পারেন। 

একই সময়ে সিইসি এ–ও বলেছেন যে গাজীপুর সিটির ভোট ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ এবং সারা বিশ্ব এ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। (বিডিনিউজ, ১০ মে ২০২৩) বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এমন কথা বলেছিলেন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে (বিবিসি, ১১ এপ্রিল ২০২৩)। সবাই গাজীপুরের দিকে তাকিয়ে আছেন, এমনটিই যদি তিনি মনে করেন, তবে কী করে এ ধরনের মন্তব্য করলেন! 

বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগের পর অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ। তার মানে অধিকাংশ ভোটারের আস্থা অর্জনে কমিশন সফল হয়নি। সেই ঘাটতি প্রযুক্তি দিয়ে পোষানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। এরই মধ্যে নির্বাচনের দিন সাংবাদিকেরা সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে কী করতে পারবেন বা পারবেন না, তার নীতিমালা প্রকাশ করার এটিই ইঙ্গিত, কমিশন স্বচ্ছতার পক্ষে নয়। এই নীতিমালা সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ নির্বাচনের পথে বাধা তৈরি করবে। 

গাজীপুরে ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় কী ঘটেছিল, তা পর্যবেক্ষকদেরই শুধু নয়, সাধারণ মানুষেরও মনে থাকার কথা। (যাঁরা এ বিষয়ে অবগত নন, তাঁরা বিবিসি বাংলার ২৭ জুন ২০১৮-এর প্রতিবেদন, ডেইলি স্টার–এর ২৮ জুন ২০১৮-এর বিশ্লেষণ দেখতে পারেন)। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল। গাজীপুর ও খুলনায় শান্তিপূর্ণ কৌশলী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে মডেল তৈরি হয়েছিল, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার পরিপূর্ণ রূপ দেখতে পাওয়া গেছে। এবারের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিচ্ছে না, কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেই বিভিন্ন ধরনের টানাপোড়েন দৃশ্যমান। সাবেক মেয়র প্রার্থী হওয়ার আগে ‘গুম’ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি গুম না হলেও তাঁর প্রার্থিতা গুম হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি প্রার্থী হতে পারেননি। 

এরই মধ্যে কমিশনের পক্ষ থেকে গাজীপুরে মডেল নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল উপনির্বাচনে ইতিমধ্যে একটি মডেল উপহার দিয়েছে, একে বলা হচ্ছে ‘উকিল মডেল’। সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কী মডেল উপহার দেবে, তা নিয়ে চলছে আলোচনা। ইসলামপন্থীদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সখ্যের নতুন অধ্যায়ের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এই নির্বাচনে তার প্রতিফলন দেখা যেতে পারে বলেও গুঞ্জন আছে। 

গাজীপুরের পর অন্যান্য সিটি নির্বাচনেও বিএনপি অংশ নেবে না। প্রধান বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে নির্বাচন করে কমিশন আদৌ তাদের সক্ষমতা দেখাতে পারবে, এমন আশার কারণ নেই। কেননা আগেও দেখা গেছে, কমিশন এ ধরনের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করলেও জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের একটি অঙ্গে পরিণত হয়েছে। 

স্মরণ করা যেতে পারে, কে এম নূরুল হুদার কমিশন ২০১৭ সালে কুমিল্লা ও রংপুরের সিটি নির্বাচন করেছিল। সহিংসতা, কারচুপি ও অনিয়মের বড় ধরনের কোনো অভিযোগ ছাড়াই এসব ভোট সম্পন্ন হয়, কিন্তু সেই কমিশন শেষ পর্যন্ত জাতিকে উপহার দিয়েছে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনে কী ঘটেছে, তা সবাই জানেন। তার পরিণতি হয়েছে এখনকার সিইসির ভাষায়, ‘বিভিন্ন দেশ আমাদের নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে।’ 

কমিশনের কোনো কোনো সদস্য জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাঁদের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন (ডেইলি স্টার বাংলা, ২৫ এপ্রিল ২০২৩)। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ সব বিরোধী দল অংশ নিয়েছিল, কিন্তু তাতে কমিশন ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এই কমিশনের দাবি যে ওই নির্বাচনের দায় তাদের নয়, কিন্তু ২০১৮ সালের পরে এমন কী পরিবর্তন ঘটেছে, যা ভিন্ন প্রক্রিয়ার ইঙ্গিত দেয়? 

তদুপরি আউয়াল কমিশনের পরীক্ষার ফলাফল গাইবান্ধার উপনির্বাচনেই স্পষ্ট হয়েছে। নির্বাচন বাতিল করে কমিশন আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু এটা তো স্পষ্ট যে নির্বাচনের আগেই ‘ডাকাতি’র লক্ষণ জেনেও কমিশন তা প্রতিরোধ করতে পারেনি (প্রথম আলো, ১৪ অক্টোবর ২০২২)। শুধু তা–ই নয়, গত বছরের অক্টোবরের এই নির্বাচনের ‘অনিয়মে’ যুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা পর্যন্ত নিতে পারেনি। 

সবার আপত্তি অগ্রাহ্য করে ইভিএমে জাতীয় নির্বাচন করার পথ ধরেছিল এই কমিশন। আর্থিক সংকটের কারণে তাঁদের পিছিয়ে আসতে হয়েছে। কিন্তু বিতর্কিত ইভিএম দিয়েই উপনির্বাচন এবং স্থানীয় নির্বাচন করা হচ্ছে। রাজনৈতিক সমস্যা যে প্রযুক্তি দিয়ে সমাধান হয় না, সেটা বহুভাবে প্রমাণিত। ইভিএম নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই বগুড়ার উপনির্বাচনের ফল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ব্যাখ্যা সন্তোষজনক হয়নি। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের ফল প্রশ্নবিদ্ধই থেকে গেছে। 

বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগের পর অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ। তার মানে অধিকাংশ ভোটারের আস্থা অর্জনে কমিশন সফল হয়নি। সেই ঘাটতি প্রযুক্তি দিয়ে পোষানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। এরই মধ্যে নির্বাচনের দিন সাংবাদিকেরা সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে কী করতে পারবেন বা পারবেন না, তার নীতিমালা প্রকাশ করার এটিই ইঙ্গিত, কমিশন স্বচ্ছতার পক্ষে নয়। এই নীতিমালা সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ নির্বাচনের পথে বাধা তৈরি করবে। 

স্থানীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এসব আলোচনা থেকে বোঝা যায়, এই কমিশনের অধীনে এবং বিরাজমান ব্যবস্থা অব্যাহত রেখে অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই। জাতীয় পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দরকার হচ্ছে এমন ব্যবস্থা করা, যা ভোটারদের মধ্যে এই আস্থা তৈরি করে যে তাঁদের ভোট দেওয়ার মতো পরিস্থিতি আছে। নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা বিভিন্ন সময় বলেছেন, ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে লুকিয়ে থাকা ‘ডাকাতদের’ মোকাবিলার কৌশল নিয়ে তাঁরা ভাবছেন। (প্রথম আলো, ২০ জুন ২০২২) কিন্তু ভোটকেন্দ্রের বাইরে এবং ভোটের আগেই যে ‘ডাকাতি’র ব্যবস্থা আছে, নির্বাচন কমিশন এটা নিয়ে চিন্তিত বলে মনে হয় না। তার বদলে সিএইসি এখন কালোটাকা নিয়ে পছন্দমতো ভোট দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।   

● আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট

News Courtesy:

https://www.prothomalo.com/opinion/column/ci1t8j3gu1?fbclid=IwAR1VfaZbydqcYo9xkNw48fIeBRximwCCknOOft_rq78NO2b_iJVhEc6fdTo

An unhandled error has occurred. Reload 🗙