সংকটে গণতন্ত্র, দেশে-বিদেশে কোথাও সুসংবাদ নেই

সংকটে গণতন্ত্র, দেশে-বিদেশে কোথাও সুসংবাদ নেই

বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রের জন্য সুসংবাদ তো নেইই, বরং দুঃসংবাদই এখন বড় হয়ে উঠেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংগঠন ফ্রিডম হাউসের প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন ‘ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২০’-এ সেই চিত্রই উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে গত বছরের সার্বিক চিত্র এবং ১৯৫টি দেশ ও ১৫টি টেরিটরি বা অঞ্চলের অবস্থার বর্ণনা রয়েছে। বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রের যে পশ্চাৎযাত্রা, তা ১৪ বছরে পড়েছে ২০১৯ সালে।

শুধু তা-ই নয়, ২০১৯ সালের অবস্থা আগের বছরের চেয়েও খারাপ হয়েছে। ওই বছর গণতন্ত্র ইতিবাচক অগ্রগতি অর্জন করেছে মাত্র ৩৭টি দেশে। অন্যদিকে গণতন্ত্রের অবনতি হয়েছে ৬৪টি দেশে। আগের বছরে যদিও গণতন্ত্রের অবনতি হয়েছিল ৬৮ দেশে, কিন্তু উন্নতি হয়েছিল ৫০টি দেশে। যোগ-বিয়োগের হিসাবে অবস্থাটা ইতিবাচক নয়। বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না, এটাই স্পষ্ট।

প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, কর্তৃত্ববাদী শাসকদের অবারিত নিষ্ঠুরতা এবং গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর নৈতিক অবক্ষয় একত্র হয়ে এমন প্রতিকূল অবস্থা তৈরি করেছে, যাতে করে সুশাসনের দাবি করাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। গত বছর সারা বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়েছে, যেগুলো নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের আকাঙ্ক্ষাই তুলে ধরে। সে আকাঙ্ক্ষা অক্ষয়, সেগুলো সর্বজনীন। কিন্তু ক্ষমতায় যারা আছে, তারা কেবল এসব চাপ মোকাবিলায় সক্ষম নয়, তারা প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগে মোটেই কুণ্ঠিত নয়।

এই যে গণতন্ত্রের পেছনযাত্রা, তার এক বড় উদাহরণ আমরা দেখতে পাই ভারতে। প্রতিবেদনের হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক ২৫টি দেশের মধ্যে এক বছরে সবচেয়ে বেশি স্কোর কমেছে ভারতের। ভারতের অবস্থা বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের তিনটি ঘটনা—কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের অবসান, আসামে নাগরিক তালিকা (এনআরসি) তৈরি এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) মাধ্যমে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি দেশের মৌলিক যে অঙ্গীকার বহুত্ববাদ ও নাগরিকের অধিকার, তা থেকে সরে এসেছে। বলা হয়েছে, ‘এগুলো ছাড়া গণতন্ত্র বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না।’

ভারতের গণতন্ত্রের জন্য যে বিপদ আসন্ন, সেটি প্রতিবেদনের এ কথাতেই স্পষ্ট। এই প্রতিবেদন ২০১৯ সালের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে। কিন্তু তারপর গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে যে পরিকল্পিত সহিংসতা ঘটেছে, তা সবার জানা। ভারতীয় সংবাদপত্রের শিরোনাম ধার করেই বলা যায়, গুজরাট মডেল দিল্লিতে হাজির হয়েছে। ভারতের গণতন্ত্র যে ২০১৯ সালের অবস্থা থেকে আরও পিছিয়ে পড়েছে, এটাই তার প্রমাণ। রাষ্ট্র যে এখন আর নাগরিকের অধিকারের রক্ষাকর্তা নয়, আদালতকে যে কীভাবে নাগরিকের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হচ্ছে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ তৈরি হয়েছে।

কিন্তু ভারত একা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি যে ইতিবাচক নয়, সেটাও এই প্রতিবেদনে আছে। কয়েক বছর ধরে গণতান্ত্রিক নিয়ম ও আদর্শের ওপরে যে হামলা হচ্ছে, অবমাননা হচ্ছে, সেই বিষয়ে প্রতিবেদনের বক্তব্য সুস্পষ্ট। নির্বাচনের সততা (ইন্টেগ্রিটি), বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে রক্ষাকবচগুলোর ওপরে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এর পাশাপাশি প্রেসিডেন্টসহ অন্যরা সংবাদমাধ্যম, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের অন্যান্য খুঁটিগুলোর বিরুদ্ধে অনবরত কথার হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন। এগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে তার পক্ষে মানবাধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলার জায়গা দুর্বল করে ফেলেছে। আর তারই সুযোগ নিচ্ছেন স্বৈরাচারী শাসকেরা।

প্রতিবেদনের এই কথাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, বিভিন্ন দেশের স্বৈরশাসকদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সখ্যের বিষয়। তিনি এখন স্বৈরশাসকদের পক্ষেই কথা বলছেন। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে অভ্যন্তরীণ বিভাজন।

যে কারণে আজকের বিশ্বে গণতন্ত্রের লড়াই হয়ে পড়েছে নেতৃত্বহীন। ফ্রিডম হাউসের এই প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছে, ‘এ লিডারলেস স্ট্রাগল ফর ডেমোক্রেসি’ বা গণতন্ত্রের জন্য নেতৃত্বহীন লড়াই। দেশে দেশে স্বৈরশাসকেরা অভ্যন্তরীণ ভিন্নমতের শেষ চিহ্নগুলোকে দমন করছেন। আর গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই যে লড়াই, তাতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছে চীন। দেশের ভেতরে উইঘুরের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত আছে। লাখ লাখ মানুষকে বন্দী অবস্থায় রাখা হয়েছে। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশে, এমনকি নির্বাচনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে চীন। চীনের সেন্সরশিপ এখন দেশের বাইরে বিস্তার লাভ করেছে। শুধু এই প্রতিবেদন নয়, অন্যান্য ঘটনায়ও দেখা যায় যে চীন স্বৈরশাসকদের পাশেই আছে। মিয়ানমার তার উজ্জ্বল উদাহরণ। প্রতিবেদনে মিয়ানমারের অবস্থান ‘আংশিক মুক্ত’ থেকে ‘মুক্ত নয়’ বলেই চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ‘গণতন্ত্রের’ জন্য এই প্রতিবেদনে ইতিবাচক কিছু থাকবে না, সেটা সহজেই বোধগম্য। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থার উন্নতি হয়েছে—এটি কেবল সরকারি ভাষ্য ছাড়া আর কোথাও পাওয়ার কারণ নেই। ফলে এটা মোটেই বিস্ময়কর নয় যে বাংলাদেশের স্কোর ২০১৮ সালের চেয়ে আরও দুই পয়েন্ট নেমে দাঁড়িয়েছে ৩৯। অর্থাৎ ১০০-র মধ্যে ৩৯। এই নম্বর প্রাপ্তি বলে দেয় দেশের অবস্থা। শুধু তা-ই নয়, গত দশকে যাদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়েছে তাদের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৯ নম্বরে। এই ১০ বছরে বাংলাদেশের স্কোর কমেছে ২০ পয়েন্ট। বাংলাদেশের আগে যেসব দেশ আছে তার মধ্যে ছয়টি দেশই হচ্ছে ‘মুক্ত নয়’ বলে চিহ্নিত, সহজ ভাষায় একেবারে খোলামেলা স্বৈরতন্ত্র। বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার স্কোর হচ্ছে ৪-এর মধ্যে মাত্র ১। এর একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের নির্বাচন হচ্ছে ‘ডিপলি ফ্লড’ বা ব্যাপকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। একাডেমিক ভাষা ব্যবহারের আড়ালে যে কথাটা লুকানো তা নিশ্চয় বাংলাদেশের নাগরিকেরা জানেন। বিরোধীদের শক্তি সঞ্চয়ের বা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো বাস্তব সম্ভাবনা আছে কি না, তার জন্য বরাদ্দ ৪ পয়েন্টের মধ্যে দেওয়া হয়েছে মাত্র ১। বাংলাদেশের ‘গণতন্ত্রের’ ক্রমাবনতি যে বিশ্বের মনোযোগের মধ্যে আছে, তা এই প্রতিবেদন আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। এটাও দেখিয়েছে যে এই অবনতি এক দশক ধরেই হচ্ছে।

গণতন্ত্রের এই সংকট বৈশ্বিক। কিন্তু তার সমাধান খুঁজতে হবে দেশের ভেতরেই। কেননা গণতন্ত্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশ্বিক নয়, সেগুলো অভ্যন্তরীণ। সব ধরনের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশে দেশে যে গণতন্ত্রের লড়াই হচ্ছে, সেটা হচ্ছে ইতিবাচক দিক। যত শক্তি প্রয়োগ করা হোক না কেন, মানুষের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা সর্বজনীন, তার বিজয়ও সেই কারণেই অনিবার্য।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর

News Courtesy:

https://www.prothomalo.com/opinion/column/%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A7%87-%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A6%A4%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%93-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A6-%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%87

An unhandled error has occurred. Reload 🗙