বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থা বিচার করব কিসের মানদণ্ডে
১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। ২০০৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতিবছর সারা বিশ্বে দিনটি পালিত হয়। এই প্রস্তাব যখন গৃহীত হয়, তখন লক্ষ্য ছিল জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষরকারী সদস্যদেশগুলোর মধ্যে উন্মুক্ত গণতন্ত্র বজায় রাখার জন্য সরকারের ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দেওয়া; গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো প্রচার ও অনুসরণ করা, নাগরিকদের তাদের জীবনের সবদিক সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করা। গত দেড় দশকে বৈশ্বিকভাবেই গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণ হয়েছে। দেশে দেশে গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির উত্থান ঘটেছে, রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে গণতন্ত্রের মর্মবাণী এবং প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে।
আমরা এ–ও জানি, বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রের এই পশ্চাৎ–যাত্রা এই প্রথমবার ঘটল, তা নয়। অতীতে বিশ্ব গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের দুটি পর্ব প্রত্যক্ষ করেছিল—১৯২২–৪২ ও ১৯৫৮–৭৫ সাল পর্যন্ত। এই দুই সময়, এই বিপরীত যাত্রা বিভিন্ন মহাদেশে স্বৈরাচারী শাসন তৈরি করেছিল। একভাবে বিবেচনা করলে ওই সময়ের অবস্থাটি ছিল এমন, হয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অথবা স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা—এ দুই ভাগেই ভাগ করা যেত।
কিন্তু গণতন্ত্রের পশ্চাৎ–যাত্রার এই তৃতীয় পর্বে উত্থান ঘটেছে এক নতুন ব্যবস্থার, যাকে বলা হয় হাইব্রিড রেজিম, দো-আঁশলাব্যবস্থা। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে, যখন আশা করা হয়েছিল, গণতন্ত্র একটি বৈশ্বিক প্রপঞ্চ হয়ে উঠবে, তখন এটি কল্পনারও বাইরে ছিল যে সংহত গণতন্ত্রগুলোতেও এই বিপরীত অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হতে পারে, আর এটি যে গণতন্ত্রের অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান ও উপাদানগুলো ব্যবহার করেই ঘটতে পারে, তা ভাবা হয়নি, কিন্তু তা–ই ঘটেছে। তবে যেটা লক্ষণীয়, তা হচ্ছে ১৯৭৫ সাল থেকে, অর্থাৎ ‘গণতন্ত্রের তৃতীয় ঢেউ’-এর সূচনাকাল থেকে যে দেশগুলো গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছে, সেই দেশগুলোয় গণতন্ত্রের বড় ধরনের অবনতি ঘটেছে। ১৯৯০-এর দশকে যারা গণতন্ত্রের আদর্শ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা দেখিয়েছে, তাদের একাংশ আজ কর্তৃত্ববাদের পথে। এর পেছনে প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কাজ করেছে, জনতুষ্টিবাদী নেতাদের উত্থান কাজ করেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য কাজ করেছে।
কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈশ্বিক রাজনীতি। গণতন্ত্রের আদর্শ ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শক্তিশালী দুটি শক্তির উত্থান ঘটেছে; রাশিয়া ও চীন সারা বিশ্বেই তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে এবং আদর্শ হিসেবে গণতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ভূরাজনীতি এবং ভূ–অর্থনীতির কূটকৌশলের কারণে বহু দেশেই এখন গণতন্ত্রের আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে উন্নয়নের নামে, জাতীয় স্বার্থের নামে এমন সব ব্যবস্থার দিকে দেশগুলোকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে, যেখানে ক্ষুদ্র গোষ্ঠী স্বার্থেরই প্রতিনিধিত্ব করে, সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষা সেখানে কার্যত উপেক্ষিত। এটাও প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে যে এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়, বরং উল্টো। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি ছাড়া অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা অসম্ভব; ক্ষমতাসীনেরা তা চানও না।
বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রের এই ব্যাপক ক্ষয়ের ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় অবদান রেখেছে বলেও আমরা অনুমান করতে পারি। তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আল-কায়েদার সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদেশগুলো যে কথিত যুদ্ধের সূচনা করে, তাতে অনেক স্বৈরাচারী শাসক যুক্ত হয়ে তাদের কার্যক্রমের বৈধতা আদায় করেছে। অনেক দেশ এই সুযোগে আইন ও আইনবহির্ভূত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যেগুলো শুধুকে রাষ্ট্রকেই নয়, ক্ষমতাসীন দল ও গোষ্ঠীকেও শক্তিশালী করেছে। তারা এগুলো ব্যবহার করেছে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ, জবাবদিহির ব্যবস্থাকে দুর্বল করা এবং সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বল বা ধ্বংস করার কাজে। একইভাবে ২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকট এবং ২০২০ সালে শুরু হওয়া কোভিড অতিমারিকে ব্যবহার করে স্বৈরাচারী শাসকেরা তাঁদের ক্ষমতাকে সংহত করেছেন।
সারা বিশ্বে রিপাবলিক গঠনের ইতিহাস যাঁরা জানেন, যাঁরা গণতন্ত্রের ধারণা কীভাবে বিকশিত হয়েছে সেই বিষয়ে অবগত, তাঁরা এটাও জানেন যে গণতন্ত্রের চারটি মৌলিক আদর্শ রয়েছে; সেগুলো হচ্ছে—জনগণের সার্বভৌমত্ব, প্রতিনিধিত্ব, দায়বদ্ধতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।
বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রের পশ্চাৎ–যাত্রার একটি দিক হচ্ছে বিভিন্ন দেশে এই স্বৈরাচারী শক্তিগুলো নিজেদের কেবল গণতান্ত্রিক বলেই দাবি করে তা নয়, তাদের বক্তব্য হচ্ছে গণতন্ত্রের যেহেতু সর্বজনীন কোনো সংজ্ঞাও নেই, সেহেতু তাদের চালু করা ব্যবস্থাই হচ্ছে গণতন্ত্র। এর একটি অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র আয়োজিত গণতন্ত্র সম্মেলনের সময় গণতন্ত্র নিয়ে চীন সরকারের প্রকাশিত একটি শ্বেতপত্র। ‘চায়না: ডেমোক্রেসি দ্যাট ওয়ার্কস’ শিরোনামের দীর্ঘ একটি লেখায় চীন নানাভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে চীন একটি অসাধারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র (এ বিষয়ে আলোচনা দেখুন, জাহেদ উর রহমান, ‘যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলন গণতান্ত্রিক বানিয়েছে চীনকেও!’ প্রথম আলো, ১৪ ডিসেম্বর ২০২১)। কিন্তু মনে রাখা দরকার, কেবল চীনই তা করে, তা নয়। অন্যান্য দেশের অগণতান্ত্রিক শাসকেরাও নিজস্ব ভঙ্গিতে তাঁদের শাসনকেই ‘মানুষের কাঙ্ক্ষিত’ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে জাহির করার চেষ্টা করেন।
কিন্তু সারা বিশ্বে রিপাবলিক গঠনের ইতিহাস যাঁরা জানেন, যাঁরা গণতন্ত্রের ধারণা কীভাবে বিকশিত হয়েছে, সেই বিষয়ে অবগত। তাঁরা এটাও জানেন, গণতন্ত্রের চারটি মৌলিক আদর্শ রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে জনগণের সার্বভৌমত্ব, প্রতিনিধিত্ব, দায়বদ্ধতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। জনগণের সার্বভৌমত্বের অর্থ জনগণই সরকার প্রতিষ্ঠা করবে এবং সরকার জনগণের ইচ্ছার অধীন হবে। প্রতিনিধিত্ব হচ্ছে শাসকের প্রতি শাসিতের সম্মতি প্রদানের উপায়। দায়বদ্ধতা হচ্ছে জনগণের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সম্পর্কের বিষয়। ক্ষমতাসীনেরা কেবল যাদের সম্মতি ছাড়া ক্ষমতায় যেতে পারে না, তাদের কাছেই জবাবদিহিতে বাধ্য, আর কারও কাছে নয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অর্থ হচ্ছে মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা—বাক্স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, সংঘ গঠন ও সমাবেশের স্বাধীনতা।
দীর্ঘ কয়েক শতকের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এই আদর্শগুলো বাস্তবায়নের পথ বিষয়েও একধরনের ঐকমত্য আছে, এগুলো হচ্ছে গণতান্ত্রিক শাসনের তিনটি অপরিহার্য উপাদান—১. সর্বজনীন ভোটাধিকার; ২. আইনসভা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদের জন্য নিয়মিত অবাধ, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, বহুদলীয় নির্বাচন ও ৩. নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, যার মধ্যে মতপ্রকাশ, সমাবেশ ও সংগঠন তৈরির স্বাধীনতা অন্তর্ভুক্ত। এগুলো পাশাপাশি আইনের শাসন, যার অধীন সব নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিরা সত্যিকারের আইনি সম-অধিকার ভোগ করবেন।
২০২২ সালে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসে বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের অবস্থা বিচার করতে হবে এসব মানদণ্ডেই। এর কোনো বিকল্পের সুযোগ নেই। এ কথা ঠিক যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে গণতন্ত্রের যাত্রা মসৃণ ছিল না। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের সূচনায় গণতন্ত্রের মৌলিক যে বিষয়গুলো বাস্তবায়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল এবং শাসনের যে তিন উপাদানের ভিত্তিতে আমরা বাংলাদেশে নির্বাচনী গণতন্ত্রের উপস্থিতির কথা বলতে পারতাম, গত এক দশকে তার প্রবল ক্ষয় লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। নিঃসন্দেহে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ‘নির্বাচন’ তার সবচেয়ে প্রত্যক্ষ উদাহরণ। এই দুই নির্বাচন একাদিক্রমে জনগণের সার্বভৌমত্ব, প্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহির ধারণাকেই লঙ্ঘন করেছে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রায় তিরোহিত হয়েছে, সমাবেশের অধিকার এখন নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছানির্ভর হয়ে পড়েছে। কিন্তু এর বাইরেও যদি আমরা তাকাই, তাহলে দেখতে পাই যে গোটা শাসনব্যবস্থা ও ক্ষমতাসীনেরা এখন আর ‘সম্মতি’র জন্য সচেষ্ট নয়। তার বিপরীতে শক্তি প্রয়োগের ওপর তার নির্ভরশীলতা। এগুলো ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণের লক্ষণ এবং রাষ্ট্রের ভেতরে শক্তি প্রয়োগকারী বাহিনীর আধিপত্যের প্রমাণ দেয়। ফলে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তি ও গণতন্ত্রাকাঙ্ক্ষী শক্তিকে গণতন্ত্রের এসব মৌলিক বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে, তাদের ভূমিকা নির্ধারণ করতে হবে।
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট
News Courtesy:
https://www.prothomalo.com/opinion/column/dw0grzxjii?fbclid=IwAR21W9e7XsGjq-VDE15fKFtK4fvGXrTTbH_DYqbJQvk-F34VNPI1vEsaq7o