সত্যভাষী সক্রিয় মানুষ
আকবর আলি খান ছিলেন এমন একজন সক্রিয় মানুষ, যাঁর কর্ম, অবদান এবং প্রভাব স্বল্পাকারে বলার চেষ্টা অসম্ভব।
তাঁর সক্রিয়তার পরিধি এক পর্যায়ে ছিল সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে। দীর্ঘদিন তিনি বাংলাদেশের প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে তিনি ছিলেন হবিগঞ্জ মহকুমার প্রশাসক। যুক্ত হয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে। মুজিবনগরে সরকার গঠনের পরে তিনি এই সরকারের সঙ্গে যুক্ত হন। এই কারণে তিনি পাকিস্তানি সেনাশাসকদের করা কথিত বিচারে দণ্ডিত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে তাঁর অংশগ্রহণ কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয় এই কারণে যে, ছাত্রজীবনে তিনি যুক্ত ছিলেন রাজনীতিতে। শিক্ষাজীবনের শেষে তিনি পাবলিক সার্ভিসের পথ বেছে না নিলে সম্ভবত অন্যভাবেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতেন। ছাত্রজীবনে জনমানুষের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ সংযুক্তির যে সূচনা হয়েছিল সেই প্রত্যক্ষ সংযুক্তির অবসান ঘটেছে ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, তাঁর জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তাঁর সক্রিয়তাকে আমরা কোনো অবস্থাতেই কেবল প্রশাসনে তাঁর উপস্থিতি বা ভূমিকা দিয়ে বিচার করতে পারব না। কেননা, ক্রমাগতভাবে তাঁর সক্রিয়তা প্রসারিত হয়েছে। এরই ধারবাহিকতায় এক পর্যায়ে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। আবার ফিরে এসেছেন প্রশাসনের দায়িত্বে।
প্রশাসন থেকে অবসর গ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁর সক্রিয়তা শেষ হতে পারত। কেবল বাংলাদেশের প্রশাসন নয়, তিনি যুক্ত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের সঙ্গেও, ২০০৫ সাল পর্যন্ত। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে তিনি অবসর নেওয়ার পর তাঁর সক্রিয়তা পেল ভিন্ন মাত্রা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হলেন, নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করলেন। কিন্তু এগুলো তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক সক্রিয়তা। আমার বিবেচনায় তাঁর সক্রিয়তা ভিন্ন মাত্রা লাভ করে ২০০৬ সালে। কেবল এই কারণে নয় যে, তিনি সেই সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে যোগ দিয়েছিলেন এবং পরে নীতিগত কারণে তা থেকে পদত্যাগ করেন। তাঁর সক্রিয়তা হচ্ছে তিনি বেছে নিয়েছিলেন এই ভূমিকাকে যে, নাগরিক সমাজের অংশ হিসেবে তাঁকে ভূমিকা রাখতে হবে। নীরব নিরাপদ নিষ্ফ্ক্রিয়তার চেয়ে তিনি বেছে নিলেন বিপজ্জনক সরব সক্রিয়তাকে। বিপজ্জনক এই কারণে যে, তিনি এজন্য গঞ্জনার শিকার হয়েছেন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। কিন্তু তাতে তিনি মোটেই দমে যাননি। বরঞ্চ নাগরিক সমাজের অংশ হিসেবে তিনি আরও বেশি করে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। আমরা তাঁকে পাই দেশের সংকটকালে দ্বিধাহীনভাবে তিনি তাঁর মতামত প্রকাশ করার কাজে।
কিন্তু এই সময়ে তিনি গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন লেখালেখিতে। তাঁর লেখালেখির প্রস্তুতি প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘদিনের; বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন বিষয়ে অভিনেবেশের সঙ্গে পাঠাভ্যাস ছিল তাঁর। তাঁর এই অভ্যাসের কথা তিনি একাধিক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, তাঁর আত্মজীবনীতেও লিখেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর চিন্তুার সূচনা হয়েছিল ১৯৬১ সালে, কিন্তু এই বিষয়ে তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। 'ডিস?কভারি অব বাংলাদেশ' নামের বই লিখতে শুরু করার প্রায় ১৬ বছর পর তা প্রকাশিত হয়।
শুধু তাঁর নিজের নিজস্ব গবেষণার বিষয়ই নয়, এমনকি তাঁর পেশাগত ক্ষেত্রেও আমরা তাই দেখতে পাই। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, 'যেখানেই আমি চাকরি করেছি, সেখানেই ওই চাকরি-সম্পর্কিত তাত্ত্বিক বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করেছি। যেমন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে থাকতে পানিসম্পদ সম্পর্কে যথেষ্ট গবেষণা করেছিলাম আমি। এত গবেষণা করেছিলাম যে আমাকে নিউইয়র্কের ইউএনডিপি তাদের পানিসম্পদের ওপরে দুটি প্রবন্ধ লেখার জন্য কনসালট্যান্সি দিয়েছিল। একটি জাতিসংঘের ইকোনমিক্যাল সোশ্যাল কাউন্সিলের সভায় উত্থাপন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিসোর্স ট্রেনিং সেন্টারে থাকতে সেখানে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ওপর ট্রেনিং করতে গিয়ে গভর্ন্যান্স ও পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ে আমি গবেষণা শুরু করি। পরবর্তীকালে সেটি আরও অনেক বই লিখতে সহায়তা করেছে' (আকবর আলি খান- 'আমি সত্য বলার চেষ্টা করি', প্রথম আলো, ৩ মে ২০২২)।
গবেষণার ব্যাপারে তাঁর এই নিষ্ঠা একাদিক্রমে তাঁর লেখার গভীরতা তৈরি করে এবং ভিন্ন চিন্তার প্রকাশ ঘটায়। যে কোনো বিষয়ে তিনি যে ভিন্নভাবে ভাবেন তা তাঁর প্রথম গ্রন্থেই সুস্পষ্ট হয়েছিল। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ 'সাম অ্যাসপেক্টস অব পিজেন্টস বিহেভিয়ার ইন বেঙ্গল ১৮৯০-১৯১৪ (অ্যা নিউ ক্লাসিক্যাল অ্যানালাইসিস)-এ বাংলাদেশে কৃষকরা কেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে অর্থকরী ফসল উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করেছিল তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসকরা, বিশেষত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, কেন বাংলার কৃষিব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছিল এবং তাঁর কী প্রভাব নিয়ে পড়েছিল সে বিষয়ে প্রচলিত আলোচনা ছিল দুই ধারার। একটি হচ্ছে জাতীয়তাবাদী ধারা, যেখানে ঔপনিবেশিক শাসকদের নীতির কঠোর সমালোচনা করা হয়, একে কৃষকদের ওপরে নির্যাতনের একটি রূপ বলে বর্ণনা করা হয়। তাঁরা দাবি করেন যে, অর্থকরী ফসল উৎপাদনের কারণে সেই সময়ে বাংলায় খাদ্য উৎপাদনে হ্রাস ঘটেছিল। অন্যদিকে ঔপনিবেশিক শাসকদের নীতির পক্ষে সাফাই হাজির করা হয়ে থাকে। আকবর আলি খান এই দুই ব্যাখ্যার বাইরে গিয়ে একটি নতুন ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি দেখান যে, এতে করে পূর্ব বাংলায় খাদ্যের উৎপাদনের হ্রাস ঘটেনি; বিহার, উত্তর এবং পশ্চিমবঙ্গে সামান্য হ্রাস পেলেও খাদ্য উৎপাদন প্রায় একই রকমের ছিল। এবং কৃষকরা অর্থনৈতিক বিবেচনা থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
আকবর আলি খানের লেখা বৈচিত্র্যময়, তিনি বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করেছেন; জীবনানন্দ দাশ এবং রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে তাঁর লেখালেখি এর বড় প্রমাণ। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় 'প্রলিফিক রাইটার', আকবর আলি খান ছিলেন সেই ধরনের লেখক। তাঁর লেখার বিষয়ে অভাবনীয় বৈচিত্র্য সত্ত্বেও তাঁর প্রধান গ্রন্থগুলো আমরা তিনটি বিষয়ে বিন্যস্ত করতে পারি। এগুলো হচ্ছে- অর্থনীতি, আত্মপরিচয় এবং রাজনীতি বা প্রশাসন। এসব বিষয়ে তাঁর গবেষণাগুলো নৈর্ব্যক্তিক। কিন্তু এগুলো কেবল গবেষণা এবং জ্ঞানচর্চা বলে বিবেচনা করলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। আমি মনে করি, এগুলো আকবর আলি খানের সক্রিয়তারই একটি দিক। এক ধরনের দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি এসব বিষয়ে লেখালেখিতে প্রবৃত্ত হন, বিশেষ করে ২০০৬ সালের পরের লেখাগুলোতে সেটা স্পষ্ট, তবে তাঁর দায়িত্ববোধ তাঁর আগের লেখাগুলোতেও সহজেই লক্ষণীয়।
তিনি যে তিনটি বিষয়ের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন, এই তিনটি বিষয় আলাদা করা দুরূহ; আমি মনে করি যে ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে (দেখুন, 'থ্রি ইস্যুজ অ্যাট দ্য সেন্টার অব বাংলাদেশ পলিটিক্স', নিউ এজ, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১)। সেই বিবেচনায় আকবর আলি খান বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির মর্মমূলের বিশ্নেষণ করতে সচেষ্ট ছিলেন বলে আমার বিশ্বাস।
আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটি তিনি গভীরভাবে দেখেছেন দুটি গ্রন্থে- ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত 'দ্য ডিসকভারি অব বাংলাদেশ' যা বাংলায় 'বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা' বলে প্রকাশিত, 'বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য : একটি ঐতিহাসিক বিশ্নেষণ' তাঁর এই অনুসন্ধিৎসার প্রকাশ। তাঁর এসব গ্রন্থের সব বক্তব্যের সঙ্গে আমাদের একমত হওয়া জরুরি নয়, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি গভীরভাবে বুঝতে হলে আত্মপরিচয়ের বিষয়কে যে কেবল প্রচলিত পলেমিক্যাল বিতর্ক দিয়ে বোঝা যাবে না, সেটা তিনি বুঝতে পারেন এবং আমাদের সেদিকে মনোনিবেশ করতে উৎসাহী করেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের যে ধারণা উভয়কেই তিনি অসম্পূর্ণ বলেই বিবেচনা করেছেন। কেননা, এর কোনোটিই আসলে জাতিসত্তার একটি কম্প্রিহেনসিভ ন্যারেটিভ তৈরি করে না এবং পুরো পরিচয়কে ধারণ করে না। তিনি সেটাই খুঁজতে চেয়েছেন তাঁর গবেষণায়। (এ গ্রন্থের বিষয়ে বিনায়েক সেনের আলোচনা দেখুন, বাংলাদেশে ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ভলিউম ২৬, সংখ্যা ১, মার্চ ২০০০)।
শিক্ষাজীবনে তিনি যে ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন, সেটা আমাদের স্মরণ করা দরকার। অর্থনীতিতে তিনি উচ্চতর শিক্ষা নেন, সেখানেও তাঁর গবেষণার বিশ্ব ইতিহাসের একটি বিশেষ পর্যায়ে কৃষি খাতে অর্থনীতির বিবেচনা। ১৯৮২ সালের বই, যা তাঁর পিএইচডি থিসিস সম্পর্কে আলোচনায় মিশেল বি ম্যাকআলপিন বলেছিলেন যে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ইতিহাস বিষয়ে এই বই একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান (দ্য জার্নাল অব ইকোনমিক হিস্ট্রি, ভলিউম ৪৪, সংখ্যা ১, পৃষ্ঠা ১৯৯-২০০)। যদিও এই গ্রন্থের বিষয় অর্থনীতির ইতিহাস তা সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার সমাজ, রাজনীতি ও আত্মপরিচয় বোঝার ক্ষেত্রে তাঁর একটি ভূমিকা আছে।
আকবর আলি খান সবচেয়ে বেশি পরিচিত তাঁর অর্থনীতিবিষয়ক বইগুলোর জন্য। এর মধ্যে আছে পরার্থপরতার অর্থনীতি, আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি, বাংলাদেশে বাজেট অর্থনীতি ও রাজনীতি। এই বইগুলোর ব্যাপক জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হচ্ছে সহজ ভাষায়, ক্ষেত্রবিশেষে রম্যরচনার ভঙ্গিতে তিনি অর্থনীতির জটিল বিষয়গুলো উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই বইগুলোর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এগুলো রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশ্নেষণ। এই বইগুলো নাগরিকদের জীবনে অর্থনীতির যে বিষয়গুলো প্রতিদিন প্রভাবিত করে সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং নাগরিকদের কেবল তা বুঝতে সাহায্য করেছে তা নয়, এর সঙ্গে যে প্রচলিত রাজনীতির গভীর সম্পর্ক আছে তা তিনি বুঝিয়েছেন। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- তিনি প্রচলিত ব্যাখ্যার বাইরে ভিন্নভাবে অর্থনীতিকে দেখেছেন এবং আমাদের দেখতে উৎসাহী করেছেন।
এই বইগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। এর পাশাপাশি তাঁর 'দারিদ্র্যের অর্থনীতি- অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ' (২০২০) গ্রন্থটি সকলের অবশ্যপাঠ্য বলেই আমি মনে করি। দারিদ্র্যের কারণ অনুসন্ধানে তত্ত্ব, বৈশ্বিক ইতিহাস এবং বাংলাদেশের অবস্থার এতটা গভীর ও অনুপুঙ্খ আলোচনা সহজে চোখে পড়ে না। বাংলা ভাষায় এই বিষয়ে বইয়ের সংখ্যা স্বল্প। আকবর আলি খান এই শূন্যতা পূরণে অগ্রগামী। এটা লক্ষণীয় যে, তিনি বইটি বাংলায় লিখেছেন। এ কথাটি আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই এই কারণে যে, আমরা জানি তিনি কেন বাংলায় লেখার কথা ভেবেছেন। এর জন্য আমরা স্মরণ করব 'অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনা জালে রাজনীতি' গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি যা লিখেছেন। ওই বই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, তাঁর ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে একটি বই লেখার, ভেবেছিলেন ইংরেজিতে লিখবেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বাংলায় খানিকটা রম্যভাবেই লিখলেন; কিন্তু উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট- 'আমি চাই বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে চিন্তা করুক এবং নিজেরাই সংস্কারের পথ বেছে নিক।'
রাজনীতি বিষয়ে তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে 'ফ্রেন্ডলি ফায়ারস, হাম্পটি ডাম্পটি ডিজঅর্ডার, অ্যান্ড আদার এসেজ- রিফ্লেকশন অন ইকোনমি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স ইন বাংলাদেশ', গ্রেশাম'স ল সিনড্রোম অ্যান্ড বিয়ন্ড, অ্যান অ্যানালাইসিস অব দ্য বাংলাদেশ ব্যুরোক্রেসি এবং 'অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনা জালে রাজনীতি'। এই বইগুলোর একটি অন্যতম দিক হচ্ছে- তিনি রাজনীতির সমস্যাগুলোই কেবল চিহ্নিত করেছেন তা নয়, সেগুলোর সমাধানেরও দিকনির্দেশ করেছেন। 'ফ্রেন্ডলি ফায়ারস, হাম্পটি ডাম্পটি ডিজঅর্ডার, অ্যান্ড আদার এসেজ- রিফ্লেকশন অন ইকোনমি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স ইন বাংলাদেশ' গ্রন্থের লেখাগুলো চার ভাগে বিভক্ত- যার চতুর্থ ভাগের রচনাগুলোর লক্ষ্য হচ্ছে কী ধরনের পলিসি তৈরি করা।
রাজনীতি বিষয়ে আকবর আলি খানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে আমি 'গ্রেশাম'স ল সিনড্রোম অ্যান্ড বিয়ন্ড, অ্যান অ্যানালাইসিস অব দ্য বাংলাদেশ ব্যুরোক্রেসি'কে বিবেচনা করি। তাঁর কারণ হচ্ছে- বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার, বিশেষ করে প্রশাসনিক ব্যবস্থার, মৌলিক দুর্বলতাকে তিনি তথ্য এবং বিশ্নেষণের মধ্য দিয়ে আমাদের কাছে স্পষ্ট করেছেন। ২০১৫ সালে প্রকাশিত এই বই একাদিক্রমে তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা এবং গবেষণার ফল। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, 'বাংলাদেশের সংস্কার নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি ১৯৬৮ সালে। এ সম্পর্কে বই প্রকাশিত হয় ৪৭ বছর গবেষণা শেষে।' এই বইয়ের সারকথাটি তিনি বলেছেন- বাহ্যিকভাবে, আধুনিক প্রশাসনের একটি বিস্তৃত কাঠামো বাংলাদেশে বিদ্যমান। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের জনপ্রশাসন একটি রাষ্ট্রের মৌলিক কাজগুলো, যেমন- আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা, মানবাধিকার রক্ষা এবং ন্যায়বিচার দেওয়া, কার্যকরভাবে সম্পাদন করতে অক্ষম। বাংলাদেশের গোটা শাসনব্যবস্থার এই সংকট অবশ্যই কেবল প্রশাসনের বিষয় নয়, তার সঙ্গে যুক্ত দেশের রাজনীতি (এই বইয়ের বিষয়ে আমার আলোচনা দেখুন, জার্নাল অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, ভলিউম ২২, সংখ্যা ১, ২০২০, পৃষ্ঠা ৯০-৯২)। আকবর আলি খানের বইয়ে সেটা আলোচিত হয় প্রশাসনের রাজনীতিকরণের প্রসঙ্গে, যাকে আমরা বলব দলীয়করণ। আকবর আলি খানের এই বই প্রকাশের পরে যা আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
আকবর আলি খান সেটা উপলব্ধি করেছিলেন বলেই আমরা অনুমান করতে পারি গত কয়েক বছরে তাঁর রাজনৈতিক সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে, যা প্রকাশিত। তাঁর রাজনৈতিক সক্রিয়তা দলের অনুসরণ নয়, স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ এবং বিরাজমান সংকটের গভীরতা বিষয়ে সকলকে অবহিত করা। আকবর আলি খানের ব্যাপক পরিচিতির পেছনে সেটাই অন্যতম কারণ। তাঁর সব বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হলেও এটা সকলের কাছেই স্পষ্ট ছিল যে বাংলাদেশের রাজনীতির এই সংকটকালে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁর অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। এ প্রসঙ্গে আবারও বলি, দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিরাপদ নিষ্ফ্ক্রিয়তা যখন বুদ্ধিজীবীর বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে সেই সময়ে বিপজ্জনক সক্রিয়তা- লেখা এবং বলার মধ্য দিয়ে বেছে নিয়েছিলেন আকবর আলি খান।
সেই কারণেই এটা আমাদের বলতেই হবে, আকবর আলি খানের জীবনাবসান কেবল একটি যুগেরই অবসান ঘটাল তা নয়, এর মধ্য দিয়ে এই সময়ের সম্ভবত সবচেয়ে সাহসী কণ্ঠস্বর নীরব হয়ে গেল। যে কোনো মৃত্যুই অপূরণীয়, কিন্তু কিছু মৃত্যু সমস্ত জাতির জন্য তৈরি করে অপূরণীয় শূন্যতা- আকবর আলি খানের মৃত্যু এই দুঃসময়ে গোটা জাতির জন্য এক অভাবনীয় শূন্যতা তৈরি করে দিল। তাঁর গবেষণাভিত্তিক লেখা, এমনকি আত্মজীবনী আমাদের বারবার দেখায় যে, তিনি একটি পথের সন্ধান করছেন- তাঁর একার জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের জন্য।
তাঁর গবেষণা এবং সক্রিয়তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে একজন পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান মানুষের কথা, একজন জ্ঞানী মানুষের অবদানের কথা, মনে করিয়ে দেবে কী করে প্রচলিত চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করতে হয়। আমরা তাঁর বইগুলো বারবার পাঠ করব। কিন্তু তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানানোর প্রকৃত উপায় হচ্ছে অকুণ্ঠ চিত্তে সত্য প্রকাশ করা। কেননা, আকবর আলি খান সেই কাজটিই করছিলেন তাঁর লেখায়, তাঁর কথায়, তাঁর সক্রিয়তায়। তাঁর কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এখন আমাদের।
News Courtesy:
https://samakal.com/kaler-kheya/article/2209132037/%E0%A6%B8%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B7%E0%A7%80-%E0%A6%B8%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A7%9F-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%81%E0%A6%B7