ডিএসএ প্রশ্নে সরকার এখন যে পদক্ষেপগুলো নিতে পারে
২০১৮ সালে প্রণীত হওয়ার পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের(ডিএসএ) কীভাবে প্রয়োগ হয়েছে যে বিষয়ে এখন কমবেশি সকলেই জ্ঞাত। সিজিএসের পক্ষ থেকে আমাদের গবেষণায় যে সব প্রবণতা উঠে এসেছে সেগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত আমাদের বিভিন্ন রিপোর্টে আমরা বলেছি। এর প্রবণতাগুলোর সারাংশ হচ্ছে এই যে, এই আইন বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের একটি অন্যতম হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, ক্ষমতাসীনদের রক্ষা করে সাধারণ নাগরিকদের ভয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে (আলী রীয়াজ, ‘প্রথম আলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা, বার্তাটি আরও কঠোর’, প্রথম আলো, ৩ এপ্রিল ২০২৩)।
আমরা জানি যে, এই আইনের আওতায় দুই মামলায় প্রায় আট মাস ধরে কারাগারে আছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা। বিচারিক আদালতে দুবার ওই শিক্ষার্থীর জামিন আবেদন নাকচ হয়। পরে গত ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্ট তাঁর জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন আদেশ স্থগিত করেন চেম্বার বিচারপতি। এই রকম উদাহরণ অনেক। একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১১টি আমলা হওয়ার কথাও শোনা গেছে।
আমার এও জানি যে, ৯ এপ্রিল পর্যন্ত কমপক্ষে মামলা হয়েছে ১২৯৩ টি, যাতে অভিযুক্তের সংখ্যা হচ্ছে ৩ হাজার ৬ শো ৫৩ জন। দীর্ঘ দিন ধরেই দাবি উঠেছে এই আইন বাতিল করতে হবে। কথাগুলো আমাদের একার নয়, যারা এই আইনের দিকে তাকিয়েছেন তারাই বলেছেন। সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের অফিসের দেওয়া টেকনিক্যাল নোট সকলের জানার পরে এই নিয়ে আলোচনা জোরদার হয়েছে। কিন্তু সরকার এই দাবি মানছেন না।
সরকারের আন্তরিকতা প্রমাণের জন্য উল্লিখিত পাঁচটি করণীয়ের পাশাপাশি নাগরিকদের, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এবং রাজনৈতিক দলগুলোরও একটি অবশ্যকরণীয় কাজ আছে। তা হচ্ছে আইনি এবং অন্যান্য সহযোগিতা নিয়ে এই আইনের ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানো, গণমাধ্যমগুলোকে এই বিষয়ে তথ্য প্রদান করা। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা এই সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে বিরূপ অবস্থায় পতিত হন।
সরকারের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন যে, জাতিসংঘের টিমের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি টিমের আলোচনা হয়েছে এবং তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে জাতিসংঘ একটি টেকনিক্যাল নোট পাঠিয়েছে (ঢাকা টাইমস, ১৫ এপ্রিল ২০২৩)। বলা হচ্ছে যে, লেজিসলেটিভ সচিবকে প্রধান করে স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে এই টিম করা হয়েছে। এই টেকনিক্যাল নোট আসার পরে নয় মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেছে।
যারা অংশীজন তাঁদেরকে সরকার এই নোটের বিষয় কিছু জানিয়েছিলেন কিনা সে বিষয়ে আমরা জানি না। জানানো হয়ে থাকলে গণমাধ্যমগুলোতে তা প্রকাশিত হয়নি। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো এই বিষয়ে অবগত হয়েছে জাতিসংঘের সূত্রে, বিশেষ করে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর যখন তা সকলের জন্য উন্মুক্ত করেছে। তদুপরি গত ৩১ মার্চ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক আইনটি অবিলম্বে স্থগিত করার আহ্বান জানানোর পরে।
ফলকার টুর্ক আইনটিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে এর ধারাগুলোতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার আহ্বান জানিয়েছেন। আইনমন্ত্রী বলেছেন, জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনা চলছে, ‘আমরা [টেকনিক্যাল নোট নিয়ে] আলোচনা-পর্যালোচনা করছি’ (নিউজবাংলা ২৪,২ এপ্রিল ২০২৩)। এই সব আলোচনায় সরকার কতটা আন্তরিক সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এই কারণে যে, এই আইন নিয়ে এত ধরনের আলোচনা সত্ত্বেও সরকার এই বিষয়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখেনি। আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের এখানে অনেক সময় এই আইনের মাধ্যমে হয়রানির অভিযোগ এসেছে। প্রয়োজন হলে আইনের বিধি সংযুক্ত করা বা পরিবর্তন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
এই আইন সংশোধন করা হবে এই কথা এই প্রথম শোনা গেল তা নয়। এই আইন তৈরির প্রক্রিয়ার সময় থেকেই আমরা তা শুনে আসছি। সাংবাদিক নেতাদের, গণমাধ্যমের সম্পাদকদের এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তারপর থেকে প্রায়শই এই কথা বলা হচ্ছে। ফলে এই নিয়ে সরকার আসলেই আগ্রহী এবং আন্তরিক এমন মনে করার কারণ দেখি না। গত সাড়ে চার বছরের অভিজ্ঞতা বলে যে, এই আইন বাতিলের আর কোনো বিকল্প নেই।
সরকার যেহেতু দাবি করছেন যে তাঁরা এই আইনের সংশোধনী এনে একে গ্রহণযোগ্য করতে চান সেহেতু সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে তার আন্তরিকতা প্রমাণ করা। সকলের আস্থা অর্জন করতে হলে সরকারকেই এখন পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
আমি মনে করি যে, এখনকার পরিস্থিতিতে সরকারের করণীয় হচ্ছে অবিলম্বে পাঁচটি পদক্ষেপ নেওয়া।
১. ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের প্রয়োগের ওপরে নির্ধারিত সময়ের জন্য মরিটরিয়াম আরোপ করা। এই সময় কতটা হবে সেটা সরকার নির্ধারণ করবে এই বিবেচনায় যে, জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনা এবং দেশের অংশীজনদের কাছে তাঁদের সংশোধনী প্রস্তাব কখন পেশ করতে পারবে এবং তার ভিত্তিতে পদক্ষেপের ব্যাপারে কখন ঐকমত্য তৈরি হবে। অনেকেই হয়তো বলবেন যে, এই আইনের ওপর মরিটরিয়াম আরোপ করে হলে এই সময়ে যদি অপরাধ হয় তবে তা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে। এটা স্পষ্ট যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যেসব মামলা করা হয়েছে সেগুলো ছাড়া সব ধরনের অপরাধ মোকাবিলার জন্য দেশে প্রচলিত আইন আছে। যেমন ধরুন সাইবার স্পেসে নারীদের হয়রানি জাতীয় অপরাধ; এগুলো মোকাবিলার জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আশ্রয় নেওয়া যাবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় অভিযোগগুলো দ্রুত মোকাবিলা করার ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়া জরুরি। মানহানির অভিযোগের মোকাবিলার জন্য দণ্ড বিধির ৪৯৯ যথেষ্ট।
২. এই আইনে এ যাবৎ যত মামলা হয়েছে, সেগুলোর বিস্তারিত তথ্য সরকার প্রকাশ করুন। কার বিরুদ্ধে কোন ধারায় মামলা হয়েছে, কবে হয়েছে, সেগুলো কী অবস্থায় আছে, কতগুলো মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে তা সকলকে জানাতে হবে। আমরা সিজিএসের পক্ষ থেকে যে গবেষণা করেছি সেখানে বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি; তাতে করে একটি চিত্র বোঝা যায়, প্রবণতা বোঝা যায়। কিন্তু এগুলোই সব মামলা নয়। এই আইনে মামলার সংখ্যা জানার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। আপনাদের স্মরণে থাকবে যে, এই ধরনের তথ্যের জন্য ২০২২ সালে অনুরোধ জানিয়েছিলেন মানবাধিকার কর্মী সাদ হাম্মাদি। কিন্তু তাকে এই সব তথ্য দেওয়া হয়নি। এ থেকে সরকারের অস্বচ্ছ এবং লুকোছাপা করার প্রবণতাই কেবল দৃশ্যমান হয়েছে তা নয়, এতে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে আমরা যা জানি তার চেয়ে অধিক হারে এই আইনের প্রয়োগ হয়েছে এবং এর একটি বড় সংখ্যা সরকারের পক্ষ থেকেই করা হয়েছে।
৩. এ যাবৎ যেসব মামলা হয়েছে তাতে পুলিশ কবে ও কোন মামলায় আইনে নির্ধারিত ৬০ দিন বা আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে ৭৫ দিনের মধ্যে তাঁদের তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পেরেছে তার তালিকা প্রকাশ করুন। এই তালিকা থেকে বোঝা যাবে যে সরকার যে ধরনের ‘অপপ্রয়োগের’ কথা বলছেন তাঁর বাইরে আইন অনুসরণে সরকারের ব্যত্যয় কতটা।
৪. এই আইনের আওতায় এখন পর্যন্ত যারা আটক হয়েছেন এবং যারা বিচারাধীন আছেন তাঁদের জামিন প্রদান করুন। দেখা গেছে যে, পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত চলাকালেই মাসের পর মাস অভিযুক্তরা আটক থাকেন। ন্যায়বিচারের জন্য এই ব্যবস্থা প্রতিবন্ধক এটা সকলের বুঝতে পারেন। প্রশ্ন উঠবে যাদের বিরুদ্ধে নারীদের হয়রানির অভিযোগ আছে, কিংবা আর্থিকভাবে প্রতারণার অভিযোগ আছে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে (যেমন দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায়) মামলা করার ব্যবস্থা নিন।
৫. গত সাড়ে চার বছরে এই আইনের আওতায় যারা ভুক্তভোগী হয়েছেন এবং যাদের বিরুদ্ধে মামলা খারিজ হয়ে গেছে বা যারা ইতিমধ্যে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন তাঁদের ক্ষতিপূরণের জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায় তার জন্য বিচার বিভাগীয় একটি কমিটি গঠন করুন।
উল্লিখিত এই পাঁচ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে এমন কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি তা মনে করি না। আইনটি যেভাবে প্রণীত হয়েছে তাতে এই আইনের সংশোধনীর কোনো উপায় আছে তাও আমার মনে হয় না। আমি মনে করি এই আইন যত দিন বহাল থাকবে তত দিন পর্যন্ত নাগরিকের কথা বলার জায়গা সীমিত থাকবে এবং দেশে যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে তা অব্যাহত থাকবে। তবে এই আইন বাতিল করলেই দেশে ভয়ের সংস্কৃতির অবসান হবে তাও নয়। কিন্তু এই আইন যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তাতে করে এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
সরকারের আন্তরিকতা প্রমাণের জন্য উল্লিখিত পাঁচটি করণীয়ের পাশাপাশি নাগরিকদের, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এবং রাজনৈতিক দলগুলোরও একটি অবশ্যকরণীয় কাজ আছে। তা হচ্ছে আইনি এবং অন্যান্য সহযোগিতা নিয়ে এই আইনের ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানো, গণমাধ্যমগুলোকে এই বিষয়ে তথ্য প্রদান করা। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা এই সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে বিরূপ অবস্থায় পতিত হন।
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং সুইডেনের গথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং রিসার্চার
News Courtesy:
https://www.prothomalo.com/opinion/column/x73g63ucr8?fbclid=IwAR1U8rrY5ryeNvh0u7Ek5GJZqqTgDdZBmTkCzvcrWLTmZCcYPRqgWVVPpL8