বহুদলীয় গণতন্ত্রের শেষ সম্ভাবনাও হুমকিতে

বহুদলীয় গণতন্ত্রের শেষ সম্ভাবনাও হুমকিতে

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভবিষ্যৎ। নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত। জনগণ উদ্বিগ্ন। গ্রহণযোগ্য অবাধ নির্বাচনের আয়োজন কোন ধরনের সরকার করবে, কীভাবে করবে– তা নিয়ে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটের বর্তমান কেন্দ্রবিন্দু। তার সমাধান হিসেবে নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে তা নিয়ে আলোচনা জারি আছে। কিন্তু তার চেয়ে জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে সামগ্রিক পরিস্থিতি কি সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে? এটি সংকটের প্রকাশ, কারণ নয়। এখনকার সংকট দুই ধরনের। প্রথম হলো, সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সবার সমান অংশগ্রহণের সুযোগদানকারী নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। দ্বিতীয়ত, গত এক দশক ধরে যে শাসনব্যবস্থা চলে আসছে তা পরিবর্তন করা। এই দুটি জরুরি কাজ আশু বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কম। এটিই হলো আসল সংকট।

দ্বিতীয় সমস্যার সমাধান প্রথমটার সমাধান ছাড়া সম্ভব নয়। সরকারের তরফ .থেকে এমন নিশ্চয়তা বিধান করা দরকার, যাতে জনগণ ভোট দিতে উৎসাহিত হন। যাতে জনগণ মনে করেন যে, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তাঁদের অবাধভাবে ভোটদানের বিপক্ষে তো নয়ই, বরং পক্ষে। একমাত্র এমন ধরনের নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমেই জনমতের প্রতিফলন ঘটতে পারে। কেবল ভোটের দিনে ভোটদানের ব্যবস্থা করলেই গণতন্ত্র চলে আসে না। পৃথিবীর কোথাও এভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না এবং হয়ওনি।

যে ধরনের সরকার আছে, যেভাবে প্রশাসনিক কাঠামো সাজানো রয়েছে, যে নির্বাচন কমিশন রয়েছে তা সুষ্ঠু নির্বাচন হবে মনে হয় না। বিশেষ করে জনপ্রশাসন ২০১৮ সালে যে প্রশ্নবিদ্ধ উপায়ে নির্বাচন করেছে, যেখানে নির্বাচনের আগের রাতেই ভোট দেওয়া হয়েছিল বলে যথেষ্ট প্রমাণসাপেক্ষ উদাহরণ ছিল; তার পুনরাবৃত্তি বন্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
 
নির্বাচন কীভাবে হবে তার আগের প্রশ্ন হলো, দেশে কি রাজনৈতিক মতপ্রকাশের অধিকার রয়েছে? রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কি বিনা বাধায় চালানো যাচ্ছে? আমরা দেখেছি বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ আয়োজন ঠেকাতে তাদের ১৭ জন কর্মীর প্রাণহানি হয়েছে। এখনও দমন-গ্রেপ্তার চলছে। এমন পরিস্থিতি চালু থাকলে কী করে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারবে?

বাংলাদেশে স্বচ্ছ নির্বাচন করতে হলে এমন জনপ্রশাসন দরকার হবে, এমন মন্ত্রিসভা দরকার হবে, যারা ভোটারদের মনে আস্থার মনোভাব সৃষ্টি করবে।
২০১৪ সাল থেকেই দেখছি, নির্বাচন ব্যবস্থা তছনছ করা হচ্ছে। নির্বাচন ব্যবস্থা পুনর্গঠন করার দিকে নির্বাচন কমিশনের আগ্রহ দেখি না, সেরকম কোনো লক্ষ্য তাঁদের আছে বলেও মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাঁরা আগেরবারের মতোই নিয়মমাফিক রুটিন নির্বাচন করার জন্যই কাজ করছেন। ফলে সবার অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা এবং ভোটারদের আস্থা তৈরির পরিবেশ করা তাঁদের মূল বিবেচনায় নেই।
 
ইতোমধ্যে আরপিও সংশোধনের মাধ্যমে যে পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে তাতে নির্বাচন কমিশন আরও ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। এখন তারা চাইলেও চূড়ান্ত অনিয়ম সত্ত্বেও কোনো সংসদীয় আসনের নির্বাচন বাতিল করতে পারবে না। গাইবান্ধা উপনির্বাচনের থেকে সরকার এটি শিখেছে। কিন্তু মূল কথা হলো, কোনো একটি আসনের ফল বাতিল করাই যথেষ্ট না, সেরকম পরিস্থিতি ঘটবার পথ বন্ধ করাই হলো আসল কাজ। সেটি কেবল নির্বাচনের দিনের বিষয় নয়। নির্বাচন কমিশনের আচার-আচরণ থেকে মনে হয়, ক্ষমতা সংকুচিত হওয়ায় তাঁরা খুশি। কোনো আপত্তিই তাঁরা তুললেন না। তাঁদের ওপর জনগণে আস্থা আছে কিনা, তা নিয়ে তাঁরা চিন্তিত না।
 
বাংলাদেশের সংবিধানে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে যে একটি দলের প্রধান ঠিক করলেন কে নির্বাচন কমিশনার হবেন! এখন যেরকম পরিস্থিতি রয়েছে, নির্বাচনকালীন সরকার তো তেমনই হবে। তো সেরকম সরকারের কাছে আমরা কী আশা করতে পারি? নির্বাচন ব্যবস্থা যখন অকার্যকর, নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রধান বিরোধী দলগুলো যখন আস্থাহীন, ক্ষমতা যখন এক ব্যক্তির হাতে, মানুষ যখন ভয়ভীতির মধ্যে বাস করছে, তখন এ-ধরনের নিয়ম রক্ষার নির্বাচনে কী যায় আসে।

জাতীয় নির্বাচনের আগে আমাদের হাতে সময় অত্যন্ত কম। এখনই যদি সংকটের মীমাংসার পদক্ষেপ না নেওয়া হলে কোনো আশা দেখি না। নির্বাচন করার অনুকূল পরিবেশ নেই, কেননা রাজনীতি করার পথে বিরাট বাধা তৈরি করা হয়েছে; এটি হলো প্রথম সংকট।
 
গত এক যুগে শাসনব্যবস্থা এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে দেশ পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণের কথাটাই অবান্তর হয়ে গেছে। বরং শক্তি প্রয়োগ ও কূটকৌশলের মাধ্যমে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখাই হয়ে গেছে মূল ব্যাপার। এটিকেই আমি ভয়ের সংস্কৃতি বলে বর্ণনা করে আসছি। এবং এটি করা হয়েছে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে। পরিকল্পিতভাবে সকল প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে, ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে। দেশে শুধু রাজনৈতিক দল থাকলেই হবে না, বিভিন্ন রকম মতপ্রকাশে স্বাধীনতা থাকতে হবে। শুধু রাজনৈতিক দলের মতামত নয়, সাধারণ মানুষের মতামত প্রকাশে ভয়ংকর বাধা তৈরি করে রাখা হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট তার একটা হাতিয়ার। আরও বিভিন্ন আইন-কানুন আছে, আইন-বহির্ভূত ব্যবস্থাও জারি আছে।
 
নির্বাহী বিভাগ, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য অন্তরায়। এই অবস্থা বদলের অর্থবহ ইঙ্গিত এখনই দিতে হবে। হাতে সময় খুব কম। নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই এমন প্রশাসন ও সরকার থাকতে হবে, যাদের কাছে নির্বাচনে কোনো পক্ষের জয়-পরাজয়ের সম্পর্ক থাকবে না। এ জন্যেই দরকার একটা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তৈরি করা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি সেরকম পরিবেশ তৈরির সম্ভাবনা দেখি না। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ বা আকাঙ্ক্ষারও কোনো আলামত নেই। তাঁরা যেনতেন নির্বাচন করে জিতে আসতে উৎসাহী।

আগামী নির্বাচন বাংলাদেশের ভবিষ্যতের পথরেখা ঠিক করে দেবে যে, এই দেশে কার্যকর বহুদলীয় ব্যবস্থা থাকবে কি থাকবে না। পরপর দুটি জাতীয় নির্বাচন যেভাবে হয়েছে সেই রকম আরেকটি নির্বাচন কার্যকর বহুদলীয় ব্যবস্থার জন্যে হুমকি। কম্বোডিয়ার দিকে তাকালেই এটি বোঝা যায়।
 
এই বিপজ্জনক পথ থেকে সরে আসার ব্যবস্থা আপস-মীমাংসা, নাকি সংঘাতের মাধ্যমে হবে সেটিই এখন জ্বলন্ত প্রশ্ন। আগামী কয়েকটি মাসকে এজন্যই আমি ক্রান্তিকাল বলে মনে করি। এখনই জরুরি পদক্ষেপ না নিলে ক্ষমতাসীনরা সম্ভবত একটি যেনতেন নির্বাচন করতে পারবে, তা না নৈতিকভাবে বৈধ হবে, না নাগরিকদের অধিকারের জন্যে ইতিবাচক হবে। এই ধরনের কিছু হলে কার্যকর বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকবে কিনা তা নিয়ে ভয় আছে। এরকম অবস্থা বহাল রেখে নির্বাচন হলে গণতন্ত্রের শেষ সম্ভাবনাও তিরোহিত হবে।

আলী রীয়াজ
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট

News Courtesy:

https://samakal.com/bangladesh/article/2305174451/%E0%A6%AC%E0%A6%B9%E0%A7%81%E0%A6%A6%E0%A6%B2%E0%A7%80%E0%A7%9F-%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A6%A4%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%B7-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%93-%E0%A6%B9%E0%A7%81%E0%A6%AE%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%87%C2%A0

An unhandled error has occurred. Reload 🗙