দেশের এবং দেশের জনগণের ভবিষ্যৎ লুণ্ঠিত হয়েছে
বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তৈরি এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জকে একটি ‘লুটেরা মডেল’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে (প্রথম আলো, ৭ জুলাই ২০২৩)। এই গবেষণা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দেশের প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে সংবাদ হবার পরে কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদনের এই অংশটি আইএমইডি’র ওয়েব সাইট থেকে সরিয়ে নিয়েছেন এবং এই বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছে যা কার্যত হাস্যকর বলেই প্রতীয়মান।
বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে যে অবাধ লুন্ঠন চলছে সেটা অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে; যে সব বিশ্লেষক এবং সাংবাদিক এই বিষয়ে খবর রাখেন তাঁরা বলেছেন অনেক দিন ধরেই। সরকার ও সরকারের সমর্থকরা তাকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্ত একথা সকলের জানা যে, আসলে এই খাত থেকে ৯০ হাজার কোটি টাকা এইভাবেই ‘লুট’ করে নেয়া হয়েছে। এই বছর ফেব্রুয়ারিতে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘লুন্ঠিত ভবিষ্যৎ - বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের চালচিত্র’ (প্রথমা, ২০২৩) গ্রন্থে সাংবাদিক ইসমাইল আলীর অধ্যায়ে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। কিন্ত যেটা বোঝা দরকার তা হচ্ছে – এই ‘লুটেরা মডেল’ কেবল এই একটি খাতে উপস্থিত ছিলো বা আছে তা নয়। এদিক সেদিক তাকালে অন্যান্য খাতেও তা দেখতে পাবেন। একই গ্রন্থে শওকত হোসেন-এর অধ্যায়ে আছে ব্যাংকিং খাতে এই মডেলের বাস্তবায়নের কথা। কি করে এই মডেলের বাস্তবায়ন হচ্ছে কথিত মেগা প্রজেক্টের নামে তারও আলোচনা আছে আরেকটি অধ্যায়ে। আমার এই কথাগুলো ঐ বইয়ের বিজ্ঞাপন দেবার জন্যে নয়; এটা স্মরণ করিয়ে দিতে যে, এই ‘লুটেরা মডেল’কে বলা হচ্ছে ‘উন্নয়নের মডেল’ এবং তার পরিণতি কেবল একটি খাতে সীমিত নয়।
এইভাবেই দেশের এবং দেশের জনগণের ভবিষ্যৎ লুণ্ঠিত হয়েছে। এই প্রক্রিয়া যে অব্যাহত আছে তার প্রমাণ হচ্ছে ব্যাংকিং খাতের বিষয়ে গৃহীত সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলো। একদিকে ঋণ খেলাপিদের জন্যে আরো বেশি সুবিধা দেয়া হচ্ছে (নয়া দিগন্ত অনলাইন, ২১ জুন ২০২৩), অন্যদিকে সংসদে পাশ হওয়া ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) বিল, ২০২৩ অনুযায়ী ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকার মেয়াদ টানা ৯ বছর থেকে বাড়িয়ে ১২ বছর করা হয়েছে (বিডিনিউজ২৪, ২১ জুন ২০২৩)। এসব যে একটি গোষ্ঠীকে দেয়া সুবিধা মাত্র তা বোঝার জন্যে খুব বেশি কষ্ট করতে হয়না।
লুটপাটের এই ধারা অব্যাহত রাখতে একদিকে বিদেশ থেকে নেয়া হচ্ছে বেহিসেবি ঋণ, অন্যদিকে টাকা ছাপানো হচ্ছে। এই বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ঋণের অবস্থা কি সেটা ‘লুন্ঠিত ভবিষ্যৎ’ বইয়ে জিয়া হাসান তাঁর নিবন্ধে দেখিয়েছেন। তারপরে গত কয়েক মাসে অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। ১৭ জুনে যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘গত ১৪ বছরে দেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৭ হাজার ৩৪৬ কোটি ডলার বা ৩২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।’ এই প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছে ‘বৈদেশিক ঋণ এখন গলার কাঁটা’ (যুগান্তর, ১৭ জুন ২০২৩)। গত অর্থ বছরে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেশুমার টাকা নিয়েছে। সব মিলে এর পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা (শেয়ার বিজ, ৭ জুলাই ২০২৩)। এই ঋণের টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিচ্ছে কোথা থেকে? এই টাকা দিচ্ছে নতুন টাকা ছাপিয়ে। তার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে জিনিশপত্রের দাম বাড়ছেই।
এই হচ্ছে অর্থনীতির ‘উন্নয়ন মডেল’। ফলে কেবল বিদ্যুৎ খাতেই যে এই অবস্থা তা নয়। চারদিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন অবস্থা কী। প্রশ্ন হচ্ছে আমি-আপনি এগুলো ধর্তব্যে নেবো নাকি অন্য কিছুতে মগ্ন থাকবো।
[লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। লেখাটি ফেসবুক থেকে নেয়া]
News Courtesy:
https://mzamin.com/news.php?news=63779&fbclid=IwAR1CELAdRLtU_A6KmG2ynXGf-BLWduXeowxVXYNbnOdYKUPa2_mupGK-9Fs