চীন-রাশিয়া একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো অন্যদিকে
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে আগামী ৯ এবং ১০ই ডিসেম্বর আয়োজিত হতে যাচ্ছে গণতন্ত্র সম্মেলন। এতে অংশ নিতে বিশ্বের ১১০টি রাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বাভাবিকভাবেই এ সম্মেলনকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে অনেকের মধ্যেই প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। আমন্ত্রণ না পাওয়া অনেক দেশ এবং কতিপয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক এই সম্মেলনে আমন্ত্রিত দেশগুলোর তালিকা দেখে নানা সমালোচনাও করছেন। এ পরিস্থিতিতে এ সম্মেলনকে ঘিরে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে মানবজমিনের মুখোমুখি হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো, বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আলী রীয়াজ। তিনি পাবলিক পলিসি স্কলার হিসেবে ‘উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারস’- এ কাজ করেছেন। গেল বছর আলী রীয়াজ আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশ স্টাডিজ (এআইবিএস)-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
মানবজমিন: যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র সম্মেলন কেন আয়োজন করছে? সংক্ষেপে যদি ব্যাখ্যা করতেন...
আলী রীয়াজ: সারা বিশ্বজুড়েই গণতন্ত্রের বড় রকমের সংকট চলছে। গত কিছুদিন ধরে এ নিয়ে বিভিন্নভাবে আলোচনা হয়েছে। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন- এ সংকট মোকাবিলা করার জন্য গণতন্ত্রের যেসব মৌলিক আদর্শ রয়েছে সেগুলোর ওপর জোর দিয়ে বিভিন্ন দেশ যারা গণতান্ত্রিক দেশ বা গণতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত তাদেরকে তিনি স্বাগত জানাবেন, সম্মেলনে সমবেত করবেন। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এ সংকট কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তার পথ নির্ধারণ করবেন। সেক্ষেত্রে তিনটি বিষয় নির্ধারিত হয়েছে: যারা কর্তৃত্ববাদের বিরোধিতা করছেন, যারা দুর্নীতি মোকাবিলার চেষ্টা করছেন এবং যারা মানবাধিকার রক্ষণ করছেন কিংবা যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরোধিতা করছেন। মোট ১১০টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। উক্ত উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তারা কিছু কর্মসূচি প্রণয়ন করবেন। দুটি সম্মেলনের একটি এবার হচ্ছে, এটি প্রথমবার। পরবর্তীটি সম্ভবত আগামী বছর হবে। এসবের লক্ষ্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে, আদর্শগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং সে বিষয়ে সম্মিলিত কোনো পদক্ষেপ নেয়া যায় কিনা তা নির্ধারণ করা।
মানবজমিন: কেউ কেউ বলছেন, এই সম্মেলন করা হচ্ছে চীনকে চাপে রাখতে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চীনবিরোধী জোটকে সমপ্রসারিত ও শক্তিশালী করতে। এ ধরনের কথার কোনো ভিত্তি আছে?
আলী রীয়াজ: সারা বিশ্বের দিকে তাকালেই বুঝা যাবে দুটি আদর্শিক অবস্থান তৈরি হয়েছে যার একটির প্রতিনিধিত্ব করে যুক্তরাষ্ট্র। অপরটির প্রতিনিধিত্ব করে চীন এবং (বলা যায়) রাশিয়া। তবে চীনের অর্থনৈতিক শক্তির কারণে এবং ক্রমাগত প্রভাব বৃদ্ধির কারণে দীর্ঘদিন যাবৎ বিশ্বজুড়ে যে ‘লিবারেল ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ আছে তা তারা পরিবর্তন করতে চাইছে। যেমন: গণতান্ত্রিক আদর্শের ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান হলো- জনগণের অংশগ্রহণমূলক কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করা, সাফল্য অর্জন করা এবং সেটাকেই তারা প্রচারের চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র সেটার বিরোধিতা করছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, বিভিন্ন দেশ যারা উদার গণতান্ত্রিক, সকলের অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা চান (রাজনৈতিক ব্যবস্থা এমনকি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা) তারাও সেটার বিরোধিতা করছে। ফলে, হ্যাঁ, সেই দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার যে শক্তি এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তি সেগুলোকে সমবেত করার চেষ্টা করছে। সেই অর্থে এটা চীনের সঙ্গে এক ধরনের আদর্শিক বৈপরীত্য। ফলে এর বিরোধিতা তো হবেই।
মানবজমিন: ‘পাকিস্তানে প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনীই সরকার চালায়।’ ‘ভারতে বিজেপির মতো হিন্দুত্ববাদী দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায়।’ এ ধরনের সমালোচনা করে থাকেন অনেকেই। তাদের প্রশ্ন, ওই দুই দেশ সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেলেও বাংলাদেশ কেন পায়নি?
আলী রীয়াজ: পাকিস্তান এবং ভারতকে আমন্ত্রণ জানানোর কতগুলো কৌশলগত কারণ রয়েছে। শুধু যে গণতান্ত্রিক বিবেচনাই প্রাধান্য পেয়েছে সেটি নয়? এর কারণ যুক্তরাষ্ট্রকে এই অঞ্চলে এবং অন্যান্য অঞ্চলে তার কৌশলগত যে নীতি আছে সেদিকে গুরুত্ব দিতে হয়েছে। একথা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারতকে এখন আর আমরা কোনো অবস্থাতেই গণতান্ত্রিক দেশ বলতে পারবো না। এটাকে অনেকেই ইলেক্টোরাল অটোক্রেসি বা নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র বলে বর্ণনা করেন। পাকিস্তানে রয়েছে ‘হাইব্রিড রেজিম’ অর্থাৎ এক ধরনের দোআঁশলা শাসন ব্যবস্থা- সেটা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বৈশ্বিক রাজনীতিতে ভারতের একটি বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে এবং এই অঞ্চলে চীনকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকার কথা যুক্তরাষ্ট্র বিবেচনা করে। পাকিস্তানকে প্রয়োজন এই অর্থে যে, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মৈত্রী আছে। তদুপরি, এখন আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহারের কারণে সেখানে স্থিতিশীলতা রক্ষায় (সম্ভবত অতীতে সেখানে যে কথিত সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধ হয়েছে তার অংশীদার হিসেবে) পাকিস্তানকে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন আছে। তাদেরকে আমন্ত্রণ করার পেছনে এই বিবেচনাগুলো কাজ করেছে। শুধু তাদের ক্ষেত্রেই নয়। ফিলিপাইনও আমন্ত্রিত হয়েছে। তাদের শাসন ব্যবস্থাকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক বলা যায় না। কিন্তু ওই অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রভাব রাখার ক্ষেত্রে ফিলিপাইনের প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্র দেখতে পায়।
মানবজমিন: ‘যুক্তরাষ্ট্র দুই পর্বে এই সম্মেলন করবে বলেছে’ উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘তারা দুই ধাপে এই সম্মেলন করবে। এ বছর এবং আগামী বছর। প্রথম ধাপে কয়েকটি দেশ যোগ দেবে। আমরা হয়তো দ্বিতীয় পর্বে আমন্ত্রণ পাবো।’ আরেকটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোকে গণতন্ত্র সম্মেলনে ডেকেছে, যে কারণে আমন্ত্রিতদের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই।’ আপনি কি মনে করেন?
আলী রীয়াজ: পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য পরস্পরবিরোধী হলো না কি? একদিকে তিনি বলছেন দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে ডাকা হয়েছে, আবার অন্যদিকে তিনি বলছেন আগামী বছর ডাকা হবে। তাহলে তার বিবেচনায়, বাংলাদেশ কি আগামীতে দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হবে? আসলে দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশকে ডাকা হয়নি। দুই একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়েছে যেগুলোর কারণ কৌশলগত। যুক্তরাষ্ট্র এটাও বিবেচনা করেছে যেসব জায়গায় কোন দেশকে ডাকলে সেখানকার অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী হতে পারে। তিনটি মাপকাঠির ভিত্তিতে ডাকা হয়েছে: কর্তৃত্ববাদ মোকাবিলা করা, দুর্নীতি দমনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা এবং মানবাধিকার সংরক্ষণ করা বা মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। এসব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এবং হোয়াইট হাউস এই মুহূর্তে মনে করছে না যে বাংলাদেশ এসব মাপকাঠিতে উতরে গেছে। সে কারণেই বাংলাদেশকে ডাকা হয়নি, এটাই স্বাভাবিকভাবে বুঝতে হবে। আগামীতে ডাকা হবে কিনা, আমার ধারণা যুক্তরাষ্ট্র সেটা বিবেচনা করবে আগামী এক বছরে কি পরিস্থিতি তৈরি হয় সেটার ওপর ভিত্তি করে। হ্যাঁ, বাংলাদেশকে হয়তো ডাকা হতেও পারে যদি বাংলাদেশে আগামী এক বছরে ওই তিনটি বিষয়ের উন্নতি ঘটে। তাহলে অবশ্যই ডাকা হবে বলে আমি মনে করি। তবে, সে সিদ্ধান্ত অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের।
মানবজমিন: প্রায় আড়াইশ’ বছরের যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে যা ঘটেছে তার প্রেক্ষিতে অনেকেই বলছেন, বিশ্ব গণতন্ত্র সম্মেলন করার আগে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত নিজ দেশের গণতন্ত্রের দিকে নজর দেয়া। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের দুর্বলতাগুলো সুস্পষ্টভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। গত চার বছর ধরে হোয়াইট হাউস এবং হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যে সমস্ত কার্যক্রম করেছেন সেগুলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলোকে প্রকট করেছে। ৬ই জানুয়ারির যে ‘ইনসারজেন্সি’ সেটা আসলে বড় রকমের দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের এ সমস্ত দুর্বলতার কথা কেউ অস্বীকার করছে না। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অনেক ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। যেমন: ওই ঘটনার সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল তাদেরকে বের করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, বিচারের সম্মুখীন করা হচ্ছে। কয়েকশ’ লোকের বিচার করা হচ্ছে, কেউ কেউ ইতিমধ্যে দণ্ডিতও হয়েছেন। এর পাশাপাশি তদন্ত হচ্ছে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। অন্যান্য যেসব প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ছিল, সেগুলোও মোকাবিলার চেষ্টা করা হচ্ছে। একথাগুলো বললাম এ কারণে নয় যে, তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র অকস্মাৎ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। সেগুলোতো কেউ অস্বীকার করছে না, প্রেসিডেন্ট বাইডেন করছেন না, যারা কংগ্রেসে আছেন বিশেষ করে ডেমোক্রেটিক পার্টির তারা করছেন না, এ দেশের বিশ্লেষকরা করছেন না। এগুলো মোকাবিলা করা খুবই জরুরি এবং অভ্যন্তরীণভাবে তা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তার অর্থ এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রকে তার বৈশ্বিক ভূমিকা থেকে পিছিয়ে আসতে হবে। একটি বড় দেশ, সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একটা দায়িত্ব আছে। বিভিন্ন বৈশ্বিক ফোরামে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। দীর্ঘদিন যাবৎ যুক্তরাষ্ট্র সে ভূমিকা পালন করছে। সবসময় সঠিক বলেছে তাও বলছি না। কিন্তু ভূমিকাতো পালন করেছে। এ দায়িত্ব তাকে পালন করতে হবে। সে পটভূমিতেই এই সম্মেলনের কথা বলা হচ্ছে। আর সর্বশেষ যেটা আমি বলবো সেটা হচ্ছে, এখন আর ঘরে-বাইরের কোনো বিষয় নয়। যারা বলছেন ভেতরে সংকট, বাইরে কেন তাকায়; তাদের বলবো ভেতর-বাইরে বলে তো আর কিছু নেই। বৈশ্বিকভাবে অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে সম্মিলিতভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। ঘরে করবেন, বাইরে করবেন না তাহলে হবে না। আবার বাইরে করবেন, ঘরে করবেন না তাতেও হবে না। ফলে এটা বিবেচনায় নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র দুভাবেই সেটা মোকাবিলা করছে। কতোটা সফল হবে সেটা আমরা আগামীতে দেখবো, ঘরে কতোটা হবে, বাইরে কতোটা হবে। সবমিলিয়ে ঘরে-বাইরে দুটোকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা- আমি সেরকম পরিস্থিতি দেখতে পাই না। এখনকার বিশ্বে সেটা সম্ভব নয়।
মানবজমিন: যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা আফগানিস্তান ছেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে আবারো তালেবান শাসন ফিরে এসেছে। যদিও ট্রাম্পের আমলেই ওই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, সেটা বাস্তবায়ন করেছেন বাইডেন। সমালোচকরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রচারে নেতৃত্ব দেয়া যুক্তরাষ্ট্র একদিকে দেশটিকে এভাবে ছেড়ে চলে আসলো, অন্যদিকে গণতন্ত্র সম্মেলন আয়োজন করছে...
আলী রীয়াজ: গণতন্ত্র সম্মেলনের সঙ্গে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি আমি একেবারেই সংশ্লিষ্ট বলে মনে করি না। আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তটি আমার বিবেচনায় ২০০৫ বা ২০০৬ সালে নেয়া উচিত ছিল। তারপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা উপস্থিতি অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন এবং ক্ষতিকারক হয়েছে। বিভিন্ন কারণে প্রেসিডেন্টরা চিন্তা করেছেন এবং পরবর্তী প্রেসিডেন্টের জন্য সেটা রেখে গেছেন। ট্রাম্প যে চুক্তি করে গেছেন সেটা আত্মসমর্পণের দলিল। ফলে, বাইডেনের জন্য সেটা একটা বড় রকমের বিপদ সৃষ্টি করেছিল। তিনি যদি চুক্তি না মানতেন তাহলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতো যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে চুক্তি করলে তারা সে চুক্তি মানেন না। আবার সেটি পালন না করলে তিনি এখন যে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়েছেন সেটি তিনি এড়িয়ে যেতে পারতেন। বাস্তবিক কারণে এবং তাড়াহুড়োর কারণে কৌশলগত কিছু ভুল হয়েছে। বিভিন্ন নাগরিক বিভিন্নভাবে বিপদগ্রস্ত হয়েছেন। সেগুলো না হলে সবচেয়ে ভালো হতো। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ভেবেছিল সেখানকার সরকার আরও কিছুদিন টিকে থাকবে এবং তার মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলা করা যাবে। সেটি হয়নি। অনেককে তাই দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। এটিতো অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু তার সঙ্গে গণতন্ত্র সম্মেলনের সংযুক্তি আমি দেখতে পাই না। দুটো ভিন্ন বিষয়। আফগানিস্তানকে ডাকাও হয়নি। তাকে গণতান্ত্রিক বলে বিবেচনাও করা হচ্ছে না। তালেবানের উত্থানের কারণ অভ্যন্তরীণ। তার সঙ্গে পাকিস্তানের একটা ভূমিকা আছে। সে প্রসঙ্গও ভিন্ন। সে প্রসঙ্গে আমরা আলাদাভাবে আলোচনা করতে পারি। কিন্তু এসবের সঙ্গে গণতন্ত্র সম্মেলনের কোনো সম্পর্ক নেই। যারা তৈরি করছেন তারা সম্ভবত ভুল করছেন।
মানবজমিন: চীন-রাশিয়া বাদ গেলেও কর্তৃত্ববাদী শাসনের জন্য সমালোচিত পোল্যান্ড ও ফিলিপাইনের মতো দেশ সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেয়েছে। চীন এবং রাশিয়া যৌথভাবে গণতন্ত্র সম্মেলনের নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে বিভক্ত করা হবে। গত শনিবারই এক জ্যেষ্ঠ চীনা কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সম্মেলনটি একটি তামাশা হবে এবং আমেরিকার যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা সেটা প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করে না।’
আলী রীয়াজ: চীন-রাশিয়া আমন্ত্রিত না হওয়ার কারণটা নিশ্চয়ই আমি-আপনি বুঝতে পারি। আগেও বলেছি বিশ্বে যে উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আছে চীন ও রাশিয়া সেটা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে। ফলে তারা এটাকে তামাশা বলবেন সেটাইতো স্বাভাবিক। না বললেই আমি বিস্মিত হতাম যে তারা এটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। ফলে চীনের এই প্রতিবাদকে আমি স্বাভাবিক বলেই বিবেচনা করি। তাতে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধভাবে অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে মোকাবিলা করার চেষ্টা দুর্বল হবে বলে আমি মনে করছি না। চীন তার প্রচেষ্টা চালাবে। রাশিয়াও সেটা চালাচ্ছে। আর বিভক্তির প্রশ্নে বলবো- পৃথিবী এক অর্থে বিভক্তই আছে। চীন-রাশিয়া একদিকে। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য শক্তিগুলো আরেক দিকে। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা হচ্ছে, আপনি এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা চান কিনা যেটা দেশে দেশে অংশগ্রহণমূলক এবং নাগরিক অধিকার সম্বলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কায়েম করে, বহাল রাখে নাকি তা রাখে না? সেই অর্থে চীন অন্যভাবে একটা আদর্শিক অবস্থান স্থাপনের চেষ্টা করে। ফলে ‘বিভক্ত করা হচ্ছে’ বলার কোনো বাস্তবসম্মত ভিত্তি আছে বলে আমি মনে করি না। এটা নতুন করে কোনো বিভক্তি তৈরি করবে না। বরঞ্চ এ ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো সারা বিশ্বে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হবে এবং অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে শক্তিশালী হবে, গণতন্ত্রের যে পশ্চাৎযাত্রা শুরু হয়েছে সেটাকে মোকাবিলা করা যাবে।
মানবজমিন: যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে- সম্মেলন উপলক্ষে যারা দুর্নীতি, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত এবং যে সকল ব্যক্তি দেশে দেশে গণতন্ত্রকে দুর্বল করে এমন ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্র একাধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারেন?
আলী রীয়াজ: যে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে সেটা খুব স্বাভাবিক। শুধু এই সম্মেলন ঘিরেই নয় বিভিন্ন সময়ই যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ব্যক্তি, দেশ এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এক্ষেত্রে যেহেতু তারা চিহ্নিত করতে পারছে যেকোনো দেশগুলো এবং কোনো ব্যক্তিরা, অথবা কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের ভূমিকা পালন করছে তাদের বিরুদ্ধে তারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে বা করার চেষ্টা করবে। সম্ভবত একটি তালিকাও তারা তৈরি করেছেন। নিষেধাজ্ঞা দু’রকম। একটা ‘কম্প্রিহেনসিভ’, সেটা দেশের ওপর। অন্যটা ‘টার্গেটেড’ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর আরোপ করা হতে পারে। আবার পণ্যের ওপরও হতে পারে। যেমন: এই জিনিস রপ্তানি করা যাবে না। সাধারণত যেটা হয় সেটা হলো ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে সেসব ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রে আসতে দেয়া হয় না, তাদের যে সমস্ত সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রে বা তার বাইরে আছে যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করে সেগুলোকে ‘ফ্রিজ’ করে ফেলতে। এ ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার বিষয় আইনেও আছে। সেটা হচ্ছে ‘ম্যাগনেটস্কি অ্যাক্ট’।
মানবাধিকারের বিরুদ্ধে যারা কাজ করে যুক্তরাষ্ট্র অতীতে এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আমার ধারণা ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট থেকে টার্গেটেড নিষেধাজ্ঞার কথাই বলা হচ্ছে। কমিপ্রহেনসিভের কথা বলা হচ্ছে না। আমরা অপেক্ষা করি, তালিকাটা দেখি। তবে, অনুমান করা যায় যারা সুস্পষ্টভাবে গণতন্ত্র সম্মেলনের তিনটি বিষয় বিশেষ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে যারা সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট ভূমিকা রাখছেন এবং যাদের ব্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আছে, তাদের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে। এটা আমার কাছে খুব বেশি অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না।
মানবজমিন: অনেক দেশকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বন্ধু বলে থাকে। কিন্তু তারা ওই সম্মেলনে আমন্ত্রণ পায়নি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্র দেশ রয়েছে। কিন্তু, সেখান থেকে শুধু ইসরাইল ও ইরাক আমন্ত্রণ পেয়েছে। সৌদি আরব, আরব আমিরাত পায়নি। ন্যাটো মিত্র তুরস্কও আমন্ত্রণ পায়নি। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
আলী রীয়াজ: মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বিবেচনা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। সৌদি আরব বাদ যাওয়াটা বিস্ময়কর কিছু নয়। সৌদি আরবকে গণতান্ত্রিক দেশ বলে বিবেচনার কোনো কারণ নেই। আরব আমিরাতের ব্যাপারটিও ওই একই। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে সম্পর্ক তাতে ইরানকে আমন্ত্রণ জানানোর কোনো লক্ষণই ছিল না বা বিবেচনাই করা হয়নি। হ্যাঁ, ইরাকের ব্যাপারে আপনি সংশয় প্রকাশ করতেই পারেন। কিন্তু ইরাককে বাদ দিয়ে শুধু ইসরাইলকে আমন্ত্রণ জানালে সেটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক সমালোচনার মধ্যে পড়তে হতো। ফলে, এসব আঞ্চলিক বিবেচনাগুলো কাজ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বিবেচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে কাজ করেছে। আফ্রিকার ক্ষেত্রেও তাই। মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে অনেক বেশি করেছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি সেটা মোটেও বিস্ময়ের সৃষ্টি করে না। এর আগেও বলেছি, ফিলিপাইনকে আমন্ত্রণ জানানোটা আমি ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছি না। এক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত আপত্তি আছে। কিন্তু, আমি বুঝতে পারছি সেটা কৌশলগত কারণে করা হয়েছে।
মানবজমিন: তাইওয়ানকে আমন্ত্রণ জানানো নিয়েও অনেক কথা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো তাইওয়ানকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এ ছাড়া তাইওয়ান নিয়ে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এখন একটা টানাপড়েন চলছে। এর মাঝে তাইওয়ানকে আমন্ত্রণ জানানোয় উত্তেজনার পারদ কি আরও বাড়বে বলে মনে করেন?
আলী রীয়াজ: তাইওয়ানকে আমন্ত্রণ জানানোর দুটো কারণ রয়েছে বলে আমি মনে করি। একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, তাইওয়ানে গণতন্ত্রের চর্চা অনেক শক্তিশালী। ফলে, তাইওয়ানকে বাদ দেয়াটা খুব বিবেচকের কাজ হতো না। ১১০টি দেশের মধ্যে ছোট ছোট অনেক দেশও তো রয়েছে। সে বিবেচনায় হয়তো তাইওয়ানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দ্বিতীয় কারণটি হলো তাইওয়ানকে আমন্ত্রণ জানিয়ে চীনকে একটা সুস্পষ্ট বার্তা দেয়া যে যুক্তরাষ্ট্র কতোটা সুস্পষ্টভাবে গণতান্ত্রিক এবং অগণতান্ত্রিক বিষয়গুলো বিবেচনা করে। আমি বুঝতে পারি সেই বার্তাটি যেমন বেইজিং পর্যন্ত পৌঁছেছে, তেমনি আপনার-আমার কাছেও পৌঁছেছে। বোঝা যাচ্ছে এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একটা কঠোর অবস্থান নিচ্ছে। চীন শুধু বড় দেশ বলে, তার প্রভাব বেশি বলে তার দিকে তাকিয়ে তাইওয়ানকে নেয়া হবে না, সেভাবে যুক্তরাষ্ট্র বিবেচনা করেনি। এটা উত্তেজনা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। এক্ষেত্রে কৌশলী হতে পারতো যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। কিন্তু কৌশলী না হওয়াটা বিস্ময়কর নয়। এখনকার পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে যে সম্পর্ক, সে সম্পর্কের কারণে এটাই স্বাভাবিক যে তারা তাইওয়ানকে আমন্ত্রণ জানিয়ে চীনকে একটা সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র একটা কঠোর অবস্থান নেবে।
News Courtesy:
https://mzamin.com/article.php?mzamin=305564