বিক্ষোভ, বিদ্যুৎ ঘাটতি, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধিতে শেখ হাসিনার শাসন চ্যালেঞ্জের মুখে

বিক্ষোভ, বিদ্যুৎ ঘাটতি, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধিতে শেখ হাসিনার শাসন চ্যালেঞ্জের মুখে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল এই সপ্তাহান্তে আরেকটি গণমিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান স্বেচ্ছাচারী কায়দায় দেশ শাসন করা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বিরোধী দলগুলোকে একত্রে কাজ করতে হবে। সারা দেশে ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়, বিদ্যুতের ঘাটতি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে গত সেপ্টেম্বর মাস থেকেই সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু, পর্যবেক্ষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের শাসনামলে বছরের পর বছর ধরে জনসাধারণের মধ্যে যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল উক্ত অর্থনৈতিক বিপর্যয়গুলো তাকে ত্বরান্বিত করেছে মাত্র। এই সরকারের বিরুদ্ধে প্রচুর আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগের পাশাপাশি দেশের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা হরণ করা নিয়েও সমালোচিত রয়েছে।

হংকং ভিত্তিক বিখ্যাত ইংরেজি সংবাদপত্র সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে শুক্রবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেঃ ক্ষমতাসীন দল ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বারবার ভিন্নমতের উপর দমন-পীড়ন চালিয়েছে, বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার করেছে এবং বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালানো সহ সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছে। দুই সপ্তাহ আগে রাজধানী ঢাকায় সমাবেশের সময়ও যেমনটি দেখা গেছে যে, যখন লাখো বিরোধীদলীয় সমর্থক শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি করেছিলেন। পুলিশ ও বিরোধীদলীয় সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত একজন নিহত ও ৫০ জন আহত হওয়ার কয়েকদিন পর ওই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে সময়, প্রধান বিরোধী দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) দুজন জ্যেষ্ঠ নেতাকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, বিরোধী দলের নেতাদের সাজা বাতিল করা, মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে এমন আইন বাতিল করা সহ নিজেদের দাবিদাওয়া মেনে নিতে সরকারকে চাপ দিতে এই সপ্তাহান্তের গণমিছিলের পাশাপাশি বিএনপি আগামী ৩০ ডিসেম্বর দেশব্যাপী বিক্ষোভ ও ঢাকায় আরও একটি গণমিছিলের পরিকল্পনা করেছে।

২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি

প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবির পাশাপাশি বিক্ষোভকারীরা “নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার” গঠনেরও আহ্বান জানিয়েছে। শেখ হাসিনা পদত্যাগের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবে, বুধবার তিনি ঘোষণা করেছেন, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হবে।

আগের দুটি নির্বাচন নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল। শেখ হাসিনার দলের ভোট কারচুপির অভিযোগে ২০১৮ সালের নির্বাচনী ফলাফলও বিতর্কিত, যেখানে তার দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেছেন, “তারা একইভাবে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা যতদিন সম্ভব ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করবে। বর্তমান সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর আচরণ বলছে, তারা বিরোধী দলের দাবিতে কর্ণপাত করবেন না।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিরোধী দলগুলোকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটি বৃহত্তর বিস্তৃত জোট গঠন করতে হবে এবং একই সাথে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

‘লেভেল ইলেক্টোরাল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির জন্য এটা অপরিহার্য, অন্যথায় ২০১৮ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি রোধ করা কঠিন হবে। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ অব্যাহত রাখাটাও গুরুত্বপূর্ণ।

ডিসেম্বরের শুরুতে (রাজপথের) বিক্ষোভের পর বাংলাদেশে অবস্থিত এক ডজনেরও বেশি পশ্চিমা দূতাবাস একটি যৌথ বিবৃতি জারি করে, যেখানে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের (সুযোগ সৃষ্টি) এবং সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। একদিন পর জাতিসংঘও একই আহবান জানায়।

আলী রীয়াজ বলেন, “বাংলাদেশ ২০১৪ সাল থেকে স্বৈরশাসনের দিকে ঝুঁকছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে সেটা ক্রমবর্ধমান হচ্ছে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ এমন একটি নির্বাচন চায় যেখানে তারা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে এবং তাদের ভোটের দাম থাকবে।”

নিপীড়নমূলক শাসন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেখ হাসিনার শাসনামলের নিপীড়নমূলক আচরণ বিরোধীদের দুর্বল করে ফেলেছে। যে কারণে বর্তমান মেয়াদের বেশিরভাগ সময় তারা যৎসামান্য প্রতিরোধের মুখে পড়ছে।

আলী রীয়াজ বলেন, “বিরোধীদের নিপীড়ন করতে সরকার অনেক সময় আইনি, অনেক সময় আইন বহির্ভূত পন্থা অবলম্বন করেছে। (২০১৮ সালে করা) ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এর মতো আইনগুলোকে সরকার এবং তার সমর্থকরা নিজেদের বিরুদ্ধে যে কোনও সমালোচনাকে নীরব করতে ব্যবহার করেছে।”

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ওই আইনটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা (বিশেষ করে অনলাইনে) খর্ব করতে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আইনটি প্রণীত হওয়ার পর থেকে এর আওতায় হাজার হাজার মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা এই আইনটি বাতিলের দাবিও জানাচ্ছেন।

ক্ষয়িষ্ণু ‘মিরাকল’ অর্থনীতি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহু বছর ধরে বিশ্ব সম্প্রদায়ের অনেকেই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের দিকে ফিরে তাকান নি কারণ শেখ হাসিনার শাসনামলের কিছু অর্জন বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির একটিতে পরিণত করেছিল। ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৪ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছিলেন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ড সহ সসমসাময়িকদের বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে।

কিন্তু, (করোনা) মহামারী এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে দেশটির “মিরাকল অর্থনীতি” এখন বৈশ্বিক ধাক্কার পরিণতির মুখোমুখি, যার ফলে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকা দুর্বল হয়ে গেছে। এর জবাবে, তেলের মূল্য মোকাবিলায় শেখ হাসিনার সরকার জুলাই মাসে জ্বালানির দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। জীবনযাত্রার ব্যয় (বৃদ্ধির) ফলস্বরূপ চাপে পড়ে লাখ লাখ স্বল্প-আয়ের বাংলাদেশি নিজেদের টেবিলে খাবার রাখতে সংগ্রাম করছে।

আলী রীয়াজের যুক্তি হলো, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সঙ্কটকে সরকার কর্তৃক পাবলিক ফান্ডের অপব্যবহার করার ‘যৌক্তিক কারণ’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক আর্থিক দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের রিপোর্ট জনগণের ক্ষোভকে আরও উস্কে দিয়েছে।

মেগা (অবকাঠামো) প্রজেক্টগুলোর সাথে সম্পর্কিত কিছু বড় বিদেশী ঋণের সময়সীমা দ্রুত এগিয়ে আসায় (সংশ্লিষ্ট) কর্মকর্তারা আগামী বছরের শুরুর দিকে আর্থিক চাপ বৃদ্ধির জন্যও প্রস্তুত হচ্ছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন নির্মিত ৩.৬ বিলিয়ন ডলারের পদ্মাসেতু এবং বেশিরভাগ রাশিয়ার অর্থায়নের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

আলী রীয়াজ বলেন, “সাধারণ মানুষের উপর চেপে বসা সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো বিক্ষোভের সম্ভাব্য কারণ হলেও, বেশ কিছুদিন থেকেই এ ধরনের অসন্তোষ তৈরি হচ্ছিল। পদ্মা সেতুর মতো কিছু অবকাঠামো প্রকল্পের প্রয়োজন আছে কিন্তু, পর্দার আড়ালে যেভাবে সেখানে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে এবং টেকসই নয় এমন প্রকল্পগুলোর সংখ্যাই প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয়।”

News Courtesy:

https://forumbangladeshstudies.com/2022/12/27/scmp-report/?fbclid=IwAR3z8Gpm8y2lpvM3Sl1eUEglxNxs6WAn0gsQ054X9XWDf4OeczvX0e1b4lA

An unhandled error has occurred. Reload 🗙