ঐকমত্যের পাশাপাশি মতপার্থক্যও জনসমক্ষে প্রকাশ করবে কমিশন

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো জানানোর পাশাপাশি যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়নি, তাও স্বচ্ছতার স্বার্থে জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। এ ছাড়াও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, টেকসই সংস্কারের জন্য জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। কেউ কেউ বলছেন, বর্তমান সংবিধানকে অমান্য করেই বিপ্লব হয়েছে, তাই এটি সংশোধন করতে হবে। বিদ্যমান সংবিধানের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো রাখতে হবে। আবার কেউ বলছেন সংবিধানে হাত দেয়ার প্রয়োজন নেই। নির্বাচিত সংসদই তা করবেন।
রোববার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর ফার্মগেট কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে জাতীয় ঐকমত্য বিষয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় এসব বক্তব্য উঠে আসে। এ সময় কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
আলোচনায় সুশীল সমাজের ১১ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। তারা হলেন- সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল মতিন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান, সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ও ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম ওয়ারেসুল করিম, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মির্জা এম হাসান, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিরা দেওয়ান, নারী প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা আশরাফুন নাহার মিষ্টি, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা রাজিয়া।
এ সময় ড. আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে কিছু মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, আবার কিছু বিষয়ে এখনো মতৈক্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। আদর্শিক অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক, তাই সব বিষয়ে ঐকমত্য সম্ভব নয় এটাই বাস্তবতা।
তিনি বলেন, নাগরিক সমাজের মতামতকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে। আলোচনা থেকে পাওয়া পরামর্শ কমিশনের কার্যক্রমকে আরও অর্থবহ করবে।
আলী রীয়াজ বলেন, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, সেগুলো আমরা জনগণকে জানাবো স্বচ্ছতার স্বার্থে এবং ভবিষ্যতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে যেন জনগণ সহায়তা করতে পারে, সে লক্ষ্যেই। আমরা চেষ্টা করবো জাতীয় সনদের পাশাপাশি একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করতে, যেখানে এই মতামতগুলো প্রতিফলিত হবে।
সুশীল সমাজের সঙ্গে আলোচনার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ যথেষ্ট নয়, নাগরিক সমাজের মধ্যেও এ বিষয়ে সম্মিলিত মত থাকা প্রয়োজন। সংস্কার কর্মসূচিতে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ ব্যতীত সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতির সুযোগ নেই।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কথা উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে ছয় মাস সময় দেয়া হয়েছে, যার অর্ধেক সময় ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ে ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তাদের প্রাথমিক মতামতও নেয়া হয়েছে।
আমরা একটি মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি জানিয়ে তিনি বলেন, পরিবর্তনের সম্ভাবনা যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি এসেছে কঠিন চ্যালেঞ্জও। কারণ এই প্রচেষ্টা শুধু রাজনৈতিক নয়, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের চেষ্টা। এ পথ সহজ নয়।
মেজর জেনারেল (অব.) মুনীরুজ্জামান বলেন, জাতীয় নেতা ও রাজনৈতিক দলগুলোকে পাশ কাটিয়ে সংস্কার করা হলে তা টেকসই হবে না। সংস্কারের ক্ষেত্রে এমন কোনো কিছুতে হাত দেয়া উচিত হবে না, যা পরবর্তী সময়ে জটিলতা আরও বাড়াবে। ’৭২-এর সংবিধানে হাত দেয়া ঠিক হবে না। নির্বাচিত সরকার ও সংসদ ছাড়া সংবিধানসংক্রান্ত সংস্কার টেকসই হবে বলে মনে করি না। কারণ এখন পরিস্থিতি এমনিতেই জটিল। এ পর্যায়ে সরকারের উচিত যত শিগগিরই সম্ভব গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে হাঁটা। সে জন্য সংবিধানের মৌলিকত্ব অক্ষুণ্ন রেখে দ্রুত নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারে মনোযোগ দেয়া।
অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, ঐকমত্যে যে বিষয়গুলো আমাদের প্রয়োজন। বেসিক জিনিসগুলো চাই। কথা বলার অধিকারসহ নানা বিষয়ে একমত হতে হবে। রুল অব ল’-এর জায়গায় একমত হতে হবে। রাজনীতিতে বারবার স্বৈরতন্ত্র চলে আসে। সেই জায়গাগুলোতে জোর দেন। যেন চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে ৩৩ শতাংশ নারীদের মনোনয়ন দিতে হবে। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ উৎসাহিত করতে হবে।
বাসু দেব ধর বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের মূলনীতিতে উল্লেখ থাকলে রাষ্ট্রে চর্চা নেই। বর্তমান সংবিধান থাকবে নাকি ছুড়ে ফেলা হবে তা আমি জানি না। তবে ’৭১ পরবর্তী সংবিধান সংযোজন বিয়োজন করে রাখতে পারি আমরা। যে ক্ষমতা এক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে একক ক্ষমতার অধিকারী করে তোলে এটা বাতিল করতে হবে। একপরিবারের যে কথা সরকার শুরু থেকেই বলছেন, সেটা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। বৈষম্যের জায়গাগুলো বাদ দিয়ে এ সংবিধান রাখতে হবে।
নারী কমিশন বাতিলের দাবি এবং কমিশন সদস্যদের ওপর মৌলবাদী গোষ্ঠীর আক্রমণাত্মক আল্টিমেটামের কঠোর সমালোচনা করে ঢাবি অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, এসব ঘটনায় সরকারের নির্লিপ্ত ভূমিকা উদ্বেগজনক মনে করছি। গণমাধ্যম বর্তমানে যে অবস্থার সম্মুখীন, তাতে রাজনৈতিক দলগুলো সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
ড. মির্জা হাসান বলেন, ৫৩ বছর ধরে নাগরিক সমাজ কথা বলেছে, চাপ দিয়ে এসেছে। ফল কী হয়েছে সেটাও সবার জানা। তিনি বলেন, ক্ষমতার মালিক জনগণ। এই জনগণ চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সের জায়গায় মার্জিনালাইজড হয়ে গেছে। জনগণকে আবার কেন্দ্রে আসতে হবে।
আলোচনায় সংবিধানে হাত দেয়া যাবে না- এমন বক্তব্যের সমালোচনা করে আব্দুল মতিন বলেন, সংবিধান এটা কি- এটা সেক্রামেন্ট, এটা কি পবিত্র কোনো ঐশী বাণী এটাতে হাত দেবো না? তাহলে এখানে আসছি কেন? এই যে ম্যারাথন কাজ হচ্ছে, এত কমিশন, এগুলো সব কি বৃথা হলো। আমাদের সিলেট অঞ্চলে একটা কথা আছে, একজন ছাত্রকে অনেক পড়ানো হলো, এরপর ছাত্ররা শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলো সীতা কার বাপ স্যার। শিক্ষক বলছিল সাত খণ্ড রামায়ণ পড়ে তুমি জিজ্ঞেস করছো সীতা কার বাপ? এ সাত খণ্ড পড়ার লাভটা কি হলো? এত কর্মযজ্ঞ হলো তার লাভটা কি? এটা নির্ধারিত সংস্কার করবো বলেই এসেছি।
News Courtesy: