রাষ্ট্র একা সংকট সৃষ্টি করে না, বৈশ্বিক ব্যবস্থাও দায়ী

রাষ্ট্র একা সংকট সৃষ্টি করে না, বৈশ্বিক ব্যবস্থাও দায়ী

বিশ্বের একটি ক্ষুদ্র অংশ রাষ্ট্র। বৈশ্বিক শক্তিগুলোর কাছে রাষ্ট্র, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো প্রায় দুর্বল হয়ে পড়ে। অধিকাংশ সময় রাষ্ট্রীয় সংকটকে শুধু শাসন ব্যবস্থার সংকট হিসেবে দেখা হলেও এ সংকটগুলো প্রায়ই বহিঃশক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়।

 

বিশ্বের একটি ক্ষুদ্র অংশ রাষ্ট্র। বৈশ্বিক শক্তিগুলোর কাছে রাষ্ট্র, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো প্রায় দুর্বল হয়ে পড়ে। অধিকাংশ সময় রাষ্ট্রীয় সংকটকে শুধু শাসন ব্যবস্থার সংকট হিসেবে দেখা হলেও এ সংকটগুলো প্রায়ই বহিঃশক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। সংকটের বিভিন্ন দেশীয় মাত্রা থাকলেও বৈশ্বিক অর্থনীতি, প্রযুক্তি, জলবায়ু ইত্যাদি মূল কারণে রাষ্ট্রকে চাপের মধ্যে কাজ করে যেতে হয়। এ সংকটগুলোকে রাজনৈতিক সরকারগুলো নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ চলে।

গতকাল রাজধানীর এক পাঁচ তারকা হোটেলে তিন দিনব্যাপী ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন’-এর দ্বিতীয় দিনের এক অধিবেশনে এসব কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক আলী রীয়াজ। ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ভাঙন, পুনর্গঠন’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে মোট আটটি গোলটেবিল বৈঠক ও চারটি পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।

‘ফ্রাজিলিটি অ্যাজ দ্য নিউ নরমাল স্টেটস ইন পার্মানেন্ট ইমার্জেন্সি’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত দিনের প্রথম অধিবেশনে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনীতির দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট যে ভূরাজনৈতিক কেন্দ্র আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সরে গেছে। চীনসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় প্রভাব বাড়িয়েছে। এতসবের পরও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোর মূল যুক্তি বদলায়নি। বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলো এখনো এমন এক ব্যবস্থায় চলতে বাধ্য, যা তারা নিজে তৈরি করেনি। দেশগুলোর বহু সংকট বাইরের অর্থনৈতিক চাপে তৈরি হয়। এর ফলে রাষ্ট্র নিজেও বহিরাগত ধাক্কার কাছে দুর্বল হয়ে পড়ে।’

 

অধিবেশনে দেয়া বক্তব্য একান্তই ব্যক্তিগত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের ভঙ্গুরতাকে প্রায় পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ কারণের ফল হিসেবে দেখা হয়। সেখানে দেশীয় বিভিন্ন মাত্রা আছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু সংকটকে কেবল রাষ্ট্র বা সরকারের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তের ফল হিসেবে দেখলে বিষয়টি অর্ধেক রয়ে যায়। সংকট বৈশ্বিক, এর প্রভাব স্থানীয়। আর এ চাপ শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক রূপ নেয়, যা অনেক সময় সরকারগুলো ক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে। তবে এটাও সত্য, জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতি সরকারকে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে সাহায্য করে। এর ফলে সেখানে নজরদারি বাড়ে, নির্বাহী ক্ষমতা শক্তিশালী হয়। কভিড-১৯-এ আমরা তা স্পষ্টভাবে দেখেছি।’

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে রাষ্ট্র অংশ নিলেও নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ থাকে না বলেও মনে করেন অধ্যাপক রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক উত্তাল সময়গুলোই দেখুন—শ্রীলংকা, এরপর বাংলাদেশ, তারপর নেপাল। তিন দেশেই একসময় প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে, আবার মারাত্মক বৈষম্যও তৈরি হয়েছে। এ বৈষম্যই অসন্তোষ বাড়িয়েছে, যা পরে রাজনৈতিক সংকটে রূপ নিয়েছে। তাই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো যে ভঙ্গুরতা তৈরি করে, রাষ্ট্র সেখানে অংশ নেয় ঠিকই, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করে না। জলবায়ু পরিবর্তন আরেকটি উদাহরণ। বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি, অথচ সমস্যার কারণ হিসেবে আমাদের অবদান খুবই কম। অর্থাৎ সংকট বলতে আমরা যে বাস্তবতা বুঝি, তার উৎস দুদিকে—বাইরের ধাক্কা ও ভেতরের শাসন ব্যবস্থা। বৈশ্বিক অর্থনীতি, প্রযুক্তি, জলবায়ু—সব মিলিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যেখানে রাষ্ট্রকে চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়, আর সেই চাপই অনেক সময় ক্ষমতা বাড়ানোর অজুহাত হয়ে দাঁড়ায়। সংবিধান ও আইন ব্যবহার করেই রাষ্ট্র তা করে।’

তিনি বলেন, ‘প্রায় সব দেশের সংবিধানেই জরুরি অবস্থা ব্যবহারের সুযোগ আছে। গত কয়েক দশকে বহু দেশে জরুরি ক্ষমতা ব্যবহার করে সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতিক সংগঠন ও নাগরিক স্বাধীনতা সীমিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে শুধু সাংবিধানিক উপায়ই নয়, আইনের বাইরেও নানা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এটি আবার এমন সময় ঘটছে যখন বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ চলছে। গত কয়েক দশকে বহু দেশে জনতা ও ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। এ দূরত্ব যত বাড়ে, শাসকগোষ্ঠী তত বেশি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ভর করে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। সবকিছু এক সঙ্গে দেখলে চিত্রটি পরিষ্কার যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপ, জলবায়ুর ঝুঁকি, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক পিছিয়ে পড়া, বৈষম্য ও জনঅসন্তোষ—এসব মিলিয়ে একটি পরিবেশ তৈরি হয়, যেখানে রাষ্ট্র চিরস্থায়ী সংকটের মধ্যে কাজ করে, যে পরিস্থিতি রাষ্ট্র নিজে একা সৃষ্টি করে না।’

এ সংকট থেকে বাঁচতে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে বলে জানান অধ্যাপক রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘নাগরিক হিসেবে প্রথম প্রয়োজন সতর্কতা। গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার মূল শর্তই হলো সতর্ক দৃষ্টি। রাষ্ট্র কী করছে, কেন করছে—সে প্রশ্ন রাখতে হবে। রাষ্ট্রকে যেন বৈশ্বিক ব্যবস্থার বাইরে কোনো বিচ্ছিন্ন সত্তা ধরে নেয়া না হয়। একই সঙ্গে জরুরি ক্ষমতার অজুহাতে মৌলিক অধিকার কত দ্রুত ক্ষয় হয়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সতর্কতা, জবাবদিহির দাবি ও জনতার সঙ্গে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দূরত্ব কমানোর সংগ্রামই এখন সবচেয়ে জরুরি।’

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে এ অধিবেশন ছাড়াও আরো তিনটি পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন ও আটটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব আলোচনায় দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ অংশ নেন। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনে ৮৫টি দেশের ২০০ জন আলোচক, ৩০০ জন ডেলিগেট ও এক হাজারের বেশি অংশগ্রহণকারী যোগ দিচ্ছেন বলে জানিয়েছে সিজিএস।

News Courtesy:

Bonikbarta | November 24, 2025

 

 

An unhandled error has occurred. Reload 🗙