একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. আলী রীয়াজ ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার সুপারিশ দেবে সংবিধান সংস্কার কমিশন
৭ জানুয়ারি শেষ হবে সংবিধান সংস্কারবিষয়ক কমিশনের কার্যকালের মেয়াদ। ওয়েবসাইট ও খানা জরিপের মাধ্যমে কমিশনের কাছে ৯৬ হাজারের বেশি মতামত এসেছে। তাতে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে সবচেয়ে বেশি মত দিয়েছেন অংশীজনরা। এই কমিশনের প্রতিবেদন তৈরির সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে খবরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেছেন কমিশনপ্রধান ড. আলী রীয়াজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শাহনাজ পারভীন এলিস।
খবরের কাগজ: কমিশনের প্রতিবেদন তৈরির অগ্রগতি কত দূর? নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন দেওয়া কি সম্ভব হবে? নাকি সরকারের কাছে বাড়তি সময় চাইবেন?
ড. আলী রীয়াজ: বাড়তি সময়ের দরকার হবে না। আমাদের কাজ হলো সংবিধান পর্যালোচনা, সারাংশ নির্ধারণ ও যৌক্তিক কিছু সুপারিশ তৈরি করা। পর্যালোচনা শেষ করে এরই মধ্যে আমরা সুপারিশ লেখা শুরু করেছি। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা কাজ শেষ করতে পারব। ৭ জানুয়ারি সরকারের কাছে জমা দেওয়ার সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে।
খবরের কাগজ: কমিশনের পক্ষ থেকে মতামত সংগ্রহের ধাপগুলো কী ছিল। এ পর্যন্ত কতজন মতামত ও মন্তব্য পাঠিয়েছেন?
ড. আলী রীয়াজ: কমিশনের ওয়েবসাইটে গত ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৫০ হাজার ৫৭৩ জন মতামত দিয়েছেন। গত ৫ থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এ বিষয়ে খানা জরিপ পরিচালিত হয়। তাতে মতামত দিয়েছেন ৪৫ হাজার ৯২৪ জন। ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৫টি রাজনৈতিক দল এবং ৩টি রাজনৈতিক জোটের মতামত এসেছে। ৭ জন সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ৪৩টি সংগঠনের অংশীজন, ১০ তরুণ চিন্তাবিদের সঙ্গে সভা করে মতামত নিয়েছি।
খবরের কাগজ: সংবিধান সংস্কারকাজে আপনাদের কাজের ধাপগুলো কেমন ছিল?
ড. আলী রীয়াজ: আমরা দুভাগে কাজটি করছি। একটি পর্যালোচনা, অন্যটি সুপারিশমালা তৈরি। পর্যালোচনায় নিজেদের সংবিধান ছাড়া আরও ১২০টি দেশের সংবিধান আমাদের গবেষণা টিম পর্যবেক্ষণ করেছে। এর মাধ্যমে বিগত ৫২ বছরে আমাদের সংবিধানের দুর্বল ও সবল দিকগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা আমরা করেছি। অংশীজনদের কাছ থেকে সংগৃহীত মত এবং কমিশনের সব সদস্যের মত একত্রিত করে সুপারিশ তৈরি করা হচ্ছে। জনমতকে প্রাধান্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সুপারিশমালায় অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আমাদের লক্ষ্য, সংবিধানকে গণতান্ত্রিক ডকুমেন্টে পরিণত করা, তার যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করা, ক্ষমতা যাতে এককেন্দ্রীকরণ না হতে পারে সেসব বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া। আমাদের সুপারিশে কোনো সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হবে না। সরকার সেগুলোকে একসঙ্গে নাকি পর্যায়ক্রমে- কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করবে, সেটা তারা নির্ধারণ করবে।
খবরের কাগজ: কমিশনের সুপারিশমালায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে কোন কোন বিষয়?
ড. আলী রীয়াজ: অংশীজনদের মতামত প্রাধান্য দিয়ে আমরা গণতান্ত্রিক ও নাগরিকের অধিকার সুরক্ষা হবে এমন কিছু বিষয়কে সংস্কারে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। তার মধ্যে রয়েছে- ক্ষমতার ভারসাম্য, পঞ্চদশ সংশোধনী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, আনুপাতিক হারে ভোটের বিধান দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শাসনকাল, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো, বাহাত্তরের সংবিধান, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, স্থানীয় সরকারব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ও ক্ষমতায়ন, গণভোট প্রভৃতি। বিশেষ করে সংসদ সদস্যদের সর্বোচ্চ বয়সসীমা কমিয়ে আনার পক্ষে আমাদের সুপারিশ থাকবে। কারণ কমিশন মনে করে, বর্তমান বাংলাদেশে সংসদে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো প্রয়োজন। তারা যাতে সংসদে তরুণ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। এ জন্য তরুণদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর পক্ষে মত দেব।
খবরের কাগজ: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে কমিশনের বিশ্লেষণ কী?
ড. আলী রীয়াজ: অতীতে এ দেশে দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো নজির আমরা দেখিনি। সেগুলোতে জনমতের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। প্রতিটিতে অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতাসীন দলই বিজয়ী হয়েছে। কাজেই দেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আমি মনে করি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিকল্প নেই।
খবরের কাগজ: সম্প্রতি আপনি বলেছেন ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবেন। সে বিষয়ে পরিকল্পনা কত দূর এগিয়েছে?
ড. আলী রীয়াজ: ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানকে কোনোভাবেই তো অস্বীকার করা যাবে না। আজ রাষ্ট্র সংস্কারে এতগুলো কমিশন হয়েছে তার সবই সম্ভব হয়েছে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে। কাজেই আমরা চাই সংবিধানে এর স্বীকৃতি থাকতে হবে। সেটা কীভাবে কোন স্থানে সংযোজন করা হবে, তা এখনো আমরা জানি না। তবে কোনো না কোনো উপায়ে এই বিষয়টা যাতে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় আমরা সেই সুপারিশ রাখব। একই সঙ্গে এই গণ-অভ্যুত্থান ঘিরে দেশবাসীর যে আকাঙ্ক্ষা তার প্রতিফলন সংস্কারের বিভিন্ন সুপারিশে উল্লেখ করা হবে।
খবরের কাগজ: যতগুলো ধাপে সংবিধান সংস্কারের মতামত এসেছে তাতে সংবিধান কি পুনরায় লিখতে হবে, নাকি কিছু সংযোজন-বিয়োজন করলেই চলবে বলে আপনি মনে করেন?
ড. আলী রীয়াজ: সেটা আমাদের আওতার মধ্যে পড়ে না, সংবিধানের খসড়া আমরা তৈরি করছি না। সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কাজেই কমিশন সে বিষয়ে সুপারিশও দেবে না। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সংবিধান পর্যালোচনা, সারাংশ নির্ধারণ ও যৌক্তিক কিছু সুপারিশ তৈরি করা। আমরা সেই সব সুপারিশ সরকারকে দেব। আমাদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। পরে সরকার রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে তারা সংবিধান পুনর্লিখন করবেন না সংযোজন-বিয়োজন করে সংশোধনী এনে সংকট সমাধানের পথ খুঁজবেন, অগ্রসর হবেন- সেটা তাদের সিদ্ধান্ত।
খবরের কাগজ: বিগত দিনে এ দেশের সংবিধান ১৭ বার পরিবর্তন হয়েছে। সেসব পরিবর্তন কী কারণে করা হয়েছে বলে মনে করছেন?
ড. আলী রীয়াজ: কমিশনের পর্যালোচনা বলছে, শুরু থেকে এ পর্যন্ত সংবিধানে যতগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে তার গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তি কেউ দেখাতে পারেনি। মূলত ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সংবিধান বারবার সংশোধন করা হয়েছে। সেগুলোতে নাগরিক অধিকার ও জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। সংসদীয় ব্যবস্থা পাল্টে দিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা যেমন প্রবর্তন করা হয়েছিল, অন্যদিকে দুবার সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে। আমি বারবার বলেছি, চলমান সংবিধানে একনায়কত্ব কায়েমের পথ আছে। আর এ কারণেই সংবিধানকে সামনে রেখেই এ দেশে বারবার একনায়কত্ব ও এক ব্যক্তির শাসন চলেছে। যার ফলাফল সুখকর ছিল না। এসব কারণে রাষ্ট্রপতির মেয়াদকাল দুই বছর বহাল থাকলেও পরিবর্তন আসতে পারে প্রধানমন্ত্রীর শাসনকালের মেয়াদে।
খবরের কাগজ: সংবিধান বারবার পরিবর্তন করা কতটা যৌক্তিক?
ড. আলী রীয়াজ: কোনো সংবিধান পারফেক্ট নয়, এটা কোনো ঐশীবাণী না, এটা জনগণের আকাঙ্ক্ষার ফসল, রাষ্ট্রের জন্য দিকনির্দেশনা। রাষ্ট্র ও জন-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তা পরিবর্তন হতেই পারে। এক-তৃতীয়াংশ সংবিধান আপনি বদলাতে দেবেন না- এটা নৈতিক, আইনি, রাজনৈতিক কোনো দিক থেকেই সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আর সেটাই করা হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। কাঠামোগত ও মর্মবস্তুর দিক থেকে আমি মনে করি, এ দেশের সংবিধান দুবার পুনর্লিখন হয়েছে। তার একটি হলো ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে চতুর্থ সংশোধনী, যা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। অপরটি ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের খোলনলচে পাল্টে দেওয়া হয়েছে। বলা যায়, ওই দুটি সংশোধনীর মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে একদলীয় শাসনব্যবস্থা ও জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে, যা এ দেশের মানুষ গ্রহণ করেনি।
খবরের কাগজ: ১৯৭২ সালের সংবিধানকে অনেকেই সর্বজন গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করে থাকেন। আপনার বিশ্লেষণ কী?
ড. আলী রীয়াজ: আমি তা মনে করি না। বাহাত্তরের সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়াই ছিল ত্রুটিপূর্ণ। কারণ জরুরি অবস্থার সময় যেভাবে গণপরিষদ তৈরি করা হয়েছিল, তা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বেশির ভাগ প্রতিনিধিত্ব ছিল একটি দলের। মাত্র তিনজন ছিলেন অন্য দলের। ফলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতের প্রতিফলন তাতে ছিল না। এ ছাড়া কন্টেন্টের দিক থেকেও বাহাত্তরের সংবিধানের নাগরিকদের অধিকার সংকুচিত করা হয়েছে।
খবরের কাগজ: সংবিধানে নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের প্রাধান্য থাকা বা রাষ্ট্রধর্ম নির্ধারণ করে দেওয়াকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ড. আলী রীয়াজ: আমি মনে করি, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থা বিরাজমান। সেটা ধর্মের দিক থেকে, নৃতাত্ত্বিকভাবে, বিশ্বাসের দিক থেকে। তাই শব্দের বিচার-বিবেচনায় না জড়িয়ে বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থাকে সংরক্ষণ করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আর সে জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তা সরকারকে করতে হবে। আমাদের এমন সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়া দরকার, যেখানে বহুত্ববাদী এই সমাজে সবার অধিকার রক্ষিত হবে।
খবরের কাগজ: শত ব্যস্ততার মধ্যেও মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. আলী রীয়াজ: খবরের কাগজ পরিবারের জন্য শুভ কামনা করছি।