অতীতের রুশ সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাইছেন পুতিন: আলী রীয়াজ

অতীতের রুশ সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাইছেন পুতিন: আলী রীয়াজ

চলতি বছরের গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের ঘোষণা দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এখন পর্যন্ত রাশিয়া তাদের এই অভিযানকে ‘বিশেষ অভিযান’ বলে আখ্যা দিয়ে আসছে। দেশ দুইটির মধ্যে চলমান এই সংঘাত ইতোমধ্যে ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এতে দুই পক্ষের বহু হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে যুদ্ধ বন্ধে এখন পর্যন্ত কোনো তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। 

ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকের সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রীয়াজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শ্যামল রায়। 


ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কোন দিকে গড়াবে বলে আপনি মনে করেন? 

দীর্ঘ সাত মাস ধরে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন অব্যাহত আছে। এই যুদ্ধের সূচনায় অনুমান করা হয়েছিল যে, রাশিয়া সহজেই ইউক্রেনকে পরাস্ত করতে পারবে এবং গোটা ইউক্রেনের ওপর তার কর্তৃত্ব বিস্তার করে তার অনুগত একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। রাশিয়ার হাতে থাকা অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং জনবল থেকেই এই ধারণা করা হয়েছিল। বাস্তবে তা হয়নি। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী এবং সাধারণ নাগরিকরা অত্যন্ত কার্যকর প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। রাশিয়া গোড়াতে রাজধানী দখলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলেও, পরে তার কৌশল বদল করেছে। ইতোমধ্যে তারা কৌশল বদল করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে রাশিয়া এগোতে চেষ্টা করলেও সেখানে যুদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু রাশিয়া ইতোমধ্যে পূর্বাঞ্চলের ডনবাস এবং লূহান্সক অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং এই এলাকা থেকে আরও অগ্রসর হতে চেষ্টা করছে। মাঠের পরিস্থিতি বলার কারণ হচ্ছে-এটি যুদ্ধের ভবিষ্যৎ পথ রেখার ইঙ্গিত দেয়। আগামীতে রাশিয়া এই দুই অঞ্চলকে ভিত্তি করেই এগোতে চেষ্টা করবে। ইতোমধ্যে ইউক্রেনের হাতে পশ্চিমা দেশগুলোর পাঠানো অস্ত্র পৌঁছতে শুরু করেছে। তারা আরও ভালোভাবেই আগ্রাসন প্রতিরোধ করছে, অন্য অঞ্চলে কিছু জায়গা পুনরায় দখল নিচ্ছে। ফলে এই যুদ্ধ খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবেনা, ক্রমেই এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।

রাশিয়া কি এই যুদ্ধ দীর্ঘ করতে চাইছে না পশ্চিমা বিশ্ব? 

এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী করার কোনও আগ্রহ রাশিয়া বা পশ্চিমা দেশগুলোর কারোরই নেই। রাশিয়া দ্রুত অভিযান শেষ করতেই আগ্রহী। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, অর্থনৈতিকভাবে এই যুদ্ধ রাশিয়ার জন্যে ইতিবাচক নয়। রাশিয়া এই পর্যন্ত যুদ্ধে কতটা ব্যয় করেছে তা আমরা জানিনা, কিন্তু রাশিয়ার ওপরে পশ্চিমা দেশগুলোর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এটা ঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যেভাবে রাশিয়াকে দুর্বল করতে চেয়েছিল ততটা সাফল্য লাভ করেনি। তা স্বত্তেও অর্থনীতি কমপক্ষে ৪ শতাংশ সংকুচিত হবে। কিন্তু রাশিয়া এই যুদ্ধ শীতকাল পর্যন্ত জারি রাখবে, কেননা রাশিয়ায় একটা হিসাব হচ্ছে শীতকালে ইউরোপে গ্যাস সংকট এই দেশগুলোকে দুর্বল করে ফেললে, ইউক্রেনকে দেওয়া সাহায্য হ্রাস পাবে এবং তাতে করে ইউক্রনের বাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভব হবে। সেই বিবেচনায় এই যুদ্ধ অব্যাহত রাখার ব্যাপারে পশ্চিমাদের উৎসাহও হ্রাস পাচ্ছে। এই যুদ্ধে তাদের জন্যে বিভিন্ন ধরনের সংকট তৈরি করছে। এই যুদ্ধের স্থায়িত্ব নির্ধারণের বিষয় আসলেই কারও হাতে আছে কিনা সেটাই প্রশ্ন। এই যুদ্ধে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে করে যুদ্ধের নিজস্ব ডায়নামিক্সটাই ভিন্ন হয়ে গেছে। এখন ইউক্রেনের জনগণ কী চান সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিষয়। 

পুতিন এখন কী লক্ষ্য অর্জন করতে চাইছেন? 

এই যুদ্ধের সাত মাসে রাশিয়ার লক্ষ্য বারবার বদল ঘটেছে। যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা তাদের লক্ষ্য পরিবর্তনে বাধ্য করেছে বলতে পারেন। কিংবা বলতে পারেন যে, কৌশলগত কারণে তারা লক্ষ্য পরিবর্তন করেছে। গোড়াতে বলা হয়েছিলো ‘ডি-মিলিটারাইজেশন’ বা সামরিক হুমকি অপসারণ এবং ‘ডি-নাৎসিফিকেশন’ বা ইউক্রেনে নাৎসিবাদ নির্মূল করা। তারপরে বলা হলো ইউক্রেনকে ন্যাটোর বাইরে রাখা। এক পর্যায়ে বলা হলো ডনবাসে ‘গণহত্যা’ প্রতিরোধ। এখন যা দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে জমি দখল। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দুটি এলাকা–লুহান্সক এবং দোনেতস্ক রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা। পুতিন চাইছেন অতীতের রুশ সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এই বছর জুলাই মাসে প্রকাশিত পুতিনের নিবন্ধ–‘অন দ্য হিস্টোরিকালইউনিটি অব রাশানস অ্যান্ড ইউক্রেনিয়ান্স’ তিনি ইতিহাসের একটি বিশেষ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন ইউক্রেনের আলাদা কোনো জাতিগত সত্তা নেই। 

আপনি কি মনে করেন, পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র কি আন্তর্জাতিক মহলে রাশিয়াকে পঙ্গু করতে চাইছে?  

পশ্চিমা বিশ্বের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাশিয়াকে দুর্বল করা। আপনি পঙ্গু শব্দটি ব্যবহার করেছেন আমি ঠিক তত দূর যাবো না, আমার তা মনেও হয়না। গত বছরগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন রাশিয়ার ভূমিকা পশ্চিমাদের স্বার্থের সঙ্গে সংঘাত তৈরি করেছে। এই ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ের প্রধান দিক হচ্ছে যে, এতে করে বৈশ্বিক ক্ষমতা ভারসাম্য যেভাবে পশ্চিমারা চায় সেভাবে থাকেনি। এর বাইরে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আদর্শিক। সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের যে পশ্চাৎযাত্রা আমরা প্রত্যক্ষ করছি, দেশে দেশে যে অ-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলো দাঁড়াচ্ছে, যে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের উত্থান ঘটছে তাদের সাহায্য-সমর্থন যোগাচ্ছে রাশিয়া ও চীন। রাশিয়া একার্থে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী ব্যবস্থার আদর্শ হয়ে উঠছে। আদর্শিক বিবেচনায় তাই যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো তা মোকাবিলা করতে চাইছে। তার জন্যেই রাশিয়ার শক্তি ক্ষয় তাদের জন্যে দরকার। বিশেষ করে দরকার পুতিনের রুশ সাম্রাজ্যের আকাঙ্ক্ষা মোকাবিলা করা। রাশিয়ার অভ্যন্তরে গণতন্ত্রায়ণের জন্যে সেটা দরকার।       

আদৌ কী যুক্তরাষ্ট্র সেটা পারবে? 

এটা তো হাজার কোটি টাকার প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমারা রাশিয়াকে দুর্বল করতে পারবে কিনা সেটা অনেক কিছুর ওপরে নির্ভর করছে। কিন্তু তাদের এই চাওয়ার মাত্রাটি কী সেটা বোঝা দরকার। রাশিয়াকে দুর্বল করতে চাওয়াটি স্বাভাবিক, কিন্ত তার জন্যে কি পথ নেওয়া হচ্ছে, সেটা আন্তর্জাতিক আইনের ভেতরে কিনা, সুস্থ প্রতিযোগিতা নাকি অন্যায্য পথ সেটা গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেন অন্য দেশগুলোর জন্যে বিপদ ডেকে নিয়ে আসে সেটা দেখা দরকার। সেই দায়িত্ব পশ্চিমাদের যেমন তেমনি রাশিয়ারও। যেমন ধরুন ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সূচনা কিন্তু হয়েছে রাশিয়ার আগ্রাসী অভিযানের কারণে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের মধ্য দিয়ে এর সূচনা। ডনবাস বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য করা, রক্ষা করা এর অন্যতম কারণ। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বকে বুঝতে হবে যে, আদর্শিকভাবে রাশিয়াকে পরাস্ত করতে হলে তাদের নিজেদের ঘরে গণতন্ত্রের শক্তি বাড়ানো দরকার, তার ত্রুটি মোকাবিলা করা দরকার, গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সংকটে পাশে দাঁড়ানো দরকার। সর্বোপরি তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে যে ডুপ্লিসিটি বা দ্বৈততা আছে সেগুলোর ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়া। 

প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পুতিনকে হটানোর যে জল্পনা উঠেছে তা কি যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যের মধ্যে আছে, থাকলেও তা কতটা সম্ভব বলে আপনার মনে হয়?

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একবার এই ধরনের একটা কথা বলেছিলেন; এ কথাটি মোটেই সঠিক হয়নি। হোয়াইট হাউস সেটা বুঝতে পেরে দ্রুত একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে এবং সেখান থেকে সরে এসেছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নয়, অবস্থান হওয়ার সুযোগ নেই; এই ধরনের অবস্থান আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। রাশিয়ায় ক্ষমতার হাত বদল সেখানকার জনগণের বিষয়। এখন যে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন আছে তা রাশিয়ার জনগণ কীভাবে বদলাবেন সেটা তাদের বিষয়। তাদের প্রতি নৈতিক সমর্থন দেওয়ার অধিকার সকলের আছে, কিন্তু ক্ষমতা থেকে পুতিনকে সরানো যুক্তরাষ্ট্রের কাজ নয়।

News Courtesy:

https://www.ittefaq.com.bd/612135/%E0%A6%85%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B6-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A6%83%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%A0%E0%A6%BE-%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%9B%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%A8

An unhandled error has occurred. Reload 🗙