বাংলাদেশের নির্বাচন ও গণতন্ত্র ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র কি অবস্থান পরিবর্তন করলো?
‘অনেক টেনশন তৈরি হয়েছিলো। তবে এসব সরিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সামনে তাকাতে চায়, পেছনে নয়’ – যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র ঢাকা সফরে কয়েক দফায় এমন মন্তব্য আসার পর প্রশ্ন উঠেছে যে নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের আগে যে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলো সেই নীতি থেকে সরে দাঁড়ালো কি না।
যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন যুক্তরাষ্ট্র আসলে তার ‘মূল্যবোধ ভিত্তিক’ নীতিগত অবস্থান অর্থাৎ গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার কিংবা মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোতে আগের নীতিতে অটল থেকেই বাংলাদেশ সরকারের সাথে সংযুক্ত থেকে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। সেটিই মি. লু’র বক্তব্যে উঠে এসেছে বলে মনে করেন তারা।
অন্যদিকে, ঢাকায় মি. লু’র বক্তব্যের পর সরকারি দল আওয়ামী লীগের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলোর মধ্যে অস্বস্তির আবহ তৈরি হয়েছে। যদিও দল দুটির নেতারা প্রকাশ্যে স্বস্তি-অস্বস্তির বিষয়টিকে উড়িয়ে দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন ‘কিছু বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝি ছিল যা সিভিল সোসাইটির লোকজন তৈরি করেছিলো। এখন আর সেটি নেই। যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে জনগণ এ সরকারের সঙ্গেই আছে।’
আর বিএনপি মহাসচিব বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, বাংলাদেশের বিষয়ে বাইরের কোনো শক্তির কিছু করার নেই, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও জনগণের বিষয়। তবে সাম্প্রতিক মানবাধিকার রিপোর্টই বলে দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র তার নীতিগত অবস্থান থেকে সরেনি।
তবে গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এ নিয়ে আর খুব একটা উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি।
এমনকি ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূতকেও প্রকাশ্যে আসতে দেখা যায়নি। এরমধ্যেই ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে ডেভিড স্লেটন মিলকে মনোনীত করেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এলিট ফোর্স র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসলে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে টানাপড়েন তৈরি হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বলেছিলেন যে ‘যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না’।
এরপর কখনো ভিসা নীতি, কখনো বা শক্ত ভাষায় মিত্রদের চাপ, পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক না পাঠানোর ঘোষণা- এমন অনেক প্রক্রিয়ায় সরকারের ওপর নজিরবিহীন চাপ তৈরি করেছিলো যুক্তরাষ্ট্র, যা নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছিলো।
বিশেষ করে র্যাবের নিষেধাজ্ঞায় বিপাকে পড়ার মধ্যে ২০২৩ সালের পঁচিশে মে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন সামনে রেখে ভিসা নীতি ঘোষণা করলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ‘দৃশ্যত নজিরবিহীন চাপে পড়ে’ যায় বলে অনেকের কাছে মনে হচ্ছিলো।
ভিসা নীতি ঘোষণা করে দেশটি বলেছিলো বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কেউ অযাচিত হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার করলে তারা ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবেন।
পরে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে এটি কার্যকর করা হয়েছে বলেও ঘোষণা এসেছিলো। তবে কাদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে সেটি কখনো প্রকাশ করা হয়নি।
বাংলাদেশের নির্বাচনের আগেই এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যকার আলোচনার খবর আসে। গত বছর নভেম্বরে ভারতের বিদেশ সচিব ভিনয় কোয়াত্রা জানান ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিদেশ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের ‘টু-প্লাস-টু’ বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
মূলত এরপরই নির্বাচন নিয়ে দৃশ্যত শক্ত অবস্থান থেকে কিছুটা নমনীয়তা প্রদর্শন শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ঢাকায় বিএনপি নেতারাও নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থানের সমালোচনা করে বক্তব্য দিতে শুরু করেন।
শেষ পর্যন্ত শেষ পর্যন্ত চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আবারো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
অন্যদিকে, নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন দলগুলো।
নির্বাচনটি সুষ্ঠু হয়নি বলেই মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। যদিও নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে কোন ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতন্ত্র, নির্বাচন, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার কিংবা মত প্রকাশের মতো ইস্যুগুলো নিয়ে একটি মূল্যবোধ ভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতির কথা চিন্তা করেছিলো। কিন্তু সে পরীক্ষায় তারা উত্তীর্ণ হয়নি।
“আমার ধারণা ভারতের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের অক্টোবর পরবর্তী অবস্থানে প্রভাব বিস্তার করেছে। এটা অনস্বীকার্য যে এমন সময়ে তাদের অবস্থানের এই পরিবর্তন দেখতে পাই যখন তার আগেই ওই বৈঠক (ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রীদের 'টু প্লাস টু') হয়েছে,” বলছিলেন মি. রীয়াজ।
তার মতে এ অঞ্চল ভারতের অবস্থানকে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব দেয় এবং এটাই বড় উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। অর্থাৎ ভারতের অবস্থান হয়তো তাদের প্রভাবিত করেছে।
ডোনাল্ড লু কী বলেছেন?
ঢাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সাথে ডোনাল্ড লু’র আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর দূতাবাসের ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় বলা হয়েছে, “সমৃদ্ধ, নিরাপদ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। আজ (বুধবার) পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আমাদের আলোচনা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে তোলা, কর্মশক্তি বৃদ্ধি, নিরাপত্তা সহযোগিতার উন্নতি, জলবায়ু সংকট মোকাবেলা এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আমাদের মূল্যবোধকে শক্তিশালী করার জন্য আমাদের যৌথ অঙ্গীকারকে পুনর্ব্যক্ত করেছে”।
পাশাপাশি ওই বৈঠকের পর ডোনাল্ড লু সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, “আমরা জানি, গত বছর বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অনেক টেনশন ছিল। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন (বাংলাদেশে) অনুষ্ঠানে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম।”
“এতে কিছু টেনশন তৈরি হয়েছিল। আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক। আমরা সামনে তাকাতে চাই, পেছনে নয়। আমরা সম্পর্ক জোরদারের উপায় খুঁজে বের করতে চাই।”
“আমাদের সম্পর্কের পথে অনেকগুলো কঠিন বিষয় রয়েছে, র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার ও ব্যবসার পরিবেশের উন্নয়ন।”
“কিন্তু কঠিন বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার জন্য ইতিবাচক সহযোগিতার ওপর ভর করে এগিয়ে যেতে চাই,” সাংবাদিকদের বলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
নির্বাচনের প্রায় সাড়ে তিন মাস পর যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকায় এসে তার এমন বক্তব্যের পরই প্রশ্ন উঠে- তাহলে কী নির্বাচন, গণতন্ত্রের মতো বিষয়গুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে দাঁড়ালো বা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করলো?
News Courtesy: