প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক শাসনে অকার্যকর হচ্ছে বাংলাদেশ: ড. আলী রীয়াজ
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সব প্রতিষ্ঠানই এখন দুর্বল। ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের জায়গাটা সংকুচিত হওয়াতে ধীরে ধীরে স্বৈরতান্ত্রিকতা দেশে আসন গেঁড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীভূত হবার কারণে সংসদ অকার্যকর হয়ে উঠছে।
বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক এবং লেখক যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ তার নিজের লেখা ‘ভোটিং ইন এ হাইব্রিড রেজিম, এক্সপ্লেইনিং দ্য টু থাউজেন্ড এইটিন বাংলাদেশ ইলেকশন’ বইয়ের আলোচনা অনুষ্ঠানে এ অভিমত তুলে ধরেন।
সোমবার ২৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা উইলসন সেন্টার এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের মডারেটর ছিলেন সেন্টারের উপ-পরিচালক ও সাউথ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র এসোসিয়েট মাইকেল কুগেলম্যান।
পুরো অনুষ্ঠানে একক বক্তা ছিলেন ড. আলী রীয়াজ। বই নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি বাংলাদেশের চলমান প্রেক্ষাপট, গণতন্ত্র আর রাজনীতি নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা করেন তিনি। ছিলো প্রশ্নোত্তরপর্বও।
অনুষ্ঠানটির আয়োজন চমৎকার এবং মুক্ত পরিবেশে হলেও আয়োজক এবং আমন্ত্রিতদের হতচকিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ মিশন কর্মকর্তাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ।
অনুষ্ঠানটি কোনো রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ না হলেও তাতে ওয়াশিংটন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বেশ কজন নেতা-কর্মী নিয়ে যোগ দেন বাংলাদেশ মিশনের ডেপুটি চীফ অব মিশন মাহবুব হাসান সালেহ ও মিনিষ্টার পলিটিক্যাল নজরুল ইসলাম। প্রশ্নোত্তরপর্বের পালা আসলে সেই ডেপুটি চীফ প্রশ্নের বদলে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। চিরাচরিত দোষারোপ যেমন ছিলো তার বক্তব্য তেমনি তীর্যক কথা বলেন আলী রীয়াজের বই নিয়েও। বইটি ‘পক্ষপাতদুষ্ট’, ‘ভন্ডামী’ এরকম অনেক কথা, শব্দ যোগ করে উত্তেজক বক্তব্য দিতে থাকেন। আর এ সময় তার পেছনে অবস্থান নেয়া যুবলীগ কর্মীরা ‘শেইম-শেইম’ বলে চিৎকার করতে থাকে। বিষয়টি উপস্থিত সকলের বিরক্তির উদ্রেক করে। মডারেটর কুগেলম্যান তাকে প্রশ্নের মধ্যে সীমিত থাকার বার বার অনুরোধ জানান। তবে শান্তভাবে ধন্যবাদ বলে পরিস্থিতি সামলে নেন ড. আলী রীয়াজ।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রসঙ্গে আলোচনায় ড. রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশে যে নির্বাচন হয়েছে তার প্রতিক্রিয়াটাই বলে দিচ্ছে নির্বাচন সেখানে হয়নি। নির্বাচন হলো গণতন্ত্র প্রধান সোপান। অথচ ২০১৮ সালের নির্বাচনে জনগণকে তাদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচন করা থেকে দূরে রাখা হয়েছে। প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নানা রকম হয়রানীমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তখন কেবল বিএনপি নির্বাচন বয়কট করেনি, সকল বিরোধি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করে।
তিনি বলেন, ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র যাত্রার নতুন উত্তরণ শুরু হয়। কিন্তু এসময়টাতে যা হয়েছে তা হলো পেশাদারিত্বের সঙ্গে গণতান্ত্রিক চর্চা এবং উন্নয়ন কোনোটাই প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়নি। আর এর ফলেই সংসদীয় গণতন্ত্র বিকাশের বৃদ্ধিটা হয়েছে খুবি দুর্বলভাবে। এ অবস্থাকে উত্তরণের জন্য বড় প্রদক্ষেপ গ্রহণ করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে।
ড. আলী রীয়াজ বলেন, এই সময়টাকে যদি মূল্যায়ন করি তাহলে বলবো ভোটের গণতন্ত্র থেকে আধা স্বৈরতন্ত্র, আধা স্বৈরতন্ত্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে
পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আস্থার সংকট থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এসেছিলো উল্লেখ করে ড. আলী রিয়াজ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সররকারের বাধ্যবাধকতা সংবিধান থেকে রোহিত করে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৯১ সাল আর ১৯৯৬ সালের নির্বাচন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অর্ন্তভুক্তি গণতন্ত্রের বিকাশে আশা যুগিয়েছিলো।একটি বহুদলীয় গণতন্ত্রের সংযোগ নিশ্চিত হয়েছিলো সে সময়টাতে।এরশাদের স্বৈরশাসনের সময়টাতে সব রাজনৈতিক দলগুলো একটা সমঝোতায় পৌঁছতে পেরেছিলো। গণতন্ত্রের লড়াইয়ের জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে সেটাকে বেছে নিয়েছিলো। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকা স্বত্ত্বেও দলগুলো গণতন্ত্রের জন্য একটা সমঝোতায় এক হয়েছিলো।
দেশের চলমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, যখন দেশে ব্যালটের নিরাপত্তা কমে গেলো, কেন্দ্র থেকে ভোটারদের উপস্থিতি হারিয়ে গেলো- সেটা কিন্তু একরকমের অর্থ বহন করলো। মত প্রকাশের সুযোগ করে দিতে হবে- সেটা থাকতে হবে সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমানভাবে।
সংসদ অকার্যকর হবার পথে উল্লেখ করে বিশিষ্ট এই রাষ্ট্র বিজ্ঞানী বলেন, গত শেষ দুই নির্বাচনে আমরা যেটা দেখছি সেটা হচ্ছে প্রাইমিনিস্টারিয়াল সিস্টেমের (প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রিক) সরকার।সব ক্ষমতা একজনের হাতেই চলে যাচ্ছে। এই যে নতুন পদ্ধতি এর কারণে গণতান্ত্রিক কাঠামোগত ব্যবস্থাটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। এককেন্দ্রিকতার কারণে সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে বটে তবে তাতে উন্নয়ন হচ্ছে বলে যে দাবি করছে তাতে বিস্তর ফারাক আছে। একটি দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে সাধারণ মানুষের সক্ষমতার মাপ-কাঠিতে। সে জায়গাটাতে এগুতে হবে, তা না হলে অর্থনৈতিক সুফল পাওয়া যাবেনা।
নিজের বই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হাইব্রিড রেজিম কথাটি একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। হাইব্রিড অর্থ হলো শংকর। একটি রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থাকে উপর থেকে দেখতে গণতান্ত্রিক মনে হবে। কিন্তু আসলে গণতান্ত্রিক নয়, এটি প্রকৃতপক্ষে কর্তৃত্ববাদী।
রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক উন্নয়ন এবং সেটা কি করে গণতন্ত্র এবং কর্তৃত্বাদীতার সঙ্গে দহরম-মহরম করছে, টু থাউজেন্ড এইটিন সালের মতো একটি নির্বাচনের দিকে ঠেলেছে, এ বইটি তারি একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র।
তিনি বলেন, বিগত দুই দশকে বাংলাদেশের যে গণতন্ত্র ছিল সেটা থেকে তার একটা পশ্চাদমুখী যাত্রা ঘটেছে অবশ্য সেটা এমন একটা সময়ে, যখন বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রিক ব্যবস্থা পিছু হটছে।
News Courtesy: