হাসিনার হেফাজত সংযোগ: ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি কি হুমকির মুখে?
বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্য সরানোর বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের দাবির প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থন নিয়ে বিস্ময় এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নাগরিক সমাজের একাংশ।
তাঁদের কেউ কেউ বলেছেন, পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন থেকে শুরু করে ভাস্কর্য সরানোর বিষয় পর্যন্ত একের পর এক ছাড় দেয়ার কারণে ধর্ম-নিরপেক্ষতার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বাংলাদেশের রয়েছে, তা-ই হুমকির মুখে পড়তে পারে।
অনেক বিশ্লেষক আবার মনে করেন, নির্বাচন সামনে রেখে এবং প্রতিপক্ষ বিএনপি'র রাজনীতি বিবেচনা করে আওয়ামী লীগ ইসলামপন্থীদের একটা অংশকে কাছে রাখতে চাইছে।
মঙ্গলবার রাতে হেফাজতের নেতা এবং আলেমদের নিয়ে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খোলামেলা ভাবে বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য স্থাপন করাটা তিনি নিজেও পছন্দ করেননি।
সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্য অপসারণের দাবিতে হেফাজতে ইসলাম বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন করলেও ধারণা করা হচ্ছিল যে সরকার হয়তো বিষয়টিকে আমলে নিচ্ছে না।
কিন্তু হেফাজতের নেতা আহমদ শফি সহ আলেমদের নিয়ে এক অনুষ্ঠানে ভাস্কর্য অপসারণের দাবির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থনকে বিপদজনক আপোষ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।
হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী পাঠ্য-পুস্তকে পরিবর্তন আনা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ইসলাম-পন্থীদেরকে একের পর এক ছাড় দিচ্ছে। আর এটা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে আঘাত করছে বলে তিনি মনে করেন।
"শিক্ষা কার্যক্রম থেকে শুরু করে কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি দেয়া - এগুলো একেকটি ছাড়। এধরণের ছাড় বার বার দিলে সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য শুভ হবে না। কারণ ধর্ম নিরপেক্ষতার আদলে এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং রাষ্ট্রের মূলনীতিতেও তা আছে। রাষ্ট্রে এই ভিত্তির উপরই আঘাত আসতে পারে," বলেন অধ্যাপক মামুন।
তবে কওমি মাদ্রাসা-ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সাথে আওয়ামী লীগ বা সরকারের সম্পর্ক নিয়ে অনেক অভিযোগ যে উঠছে এবং অনেকে যে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন, সেটি ক্ষমতাসীন এই দলটি আমলে নিচ্ছে না। কারণ আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, যারা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন, তাদের চেয়েও অনেক বেশি মানুষ খুশি হবেন। এমন অবস্থান ঢাকার বাইরে এবং গ্রাম পর্যায়ে তাদের দলের জন্য ইতিবাচক হবে বলে তাদের ধারণা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং গবেষক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান মনে করেন জামায়াত-ই-ইসলামী সহ ইসলামপন্থী কিছু দল নিয়ে বিএনপি'র জোট যে রাজনীতি করছে, তা বিবেচনায় নিয়ে আওয়ামী লীগ এই অবস্থান নিচ্ছে। এটাকে তিনি বিপদজনক বা আপোষ হিসেবে দেখতে রাজি নন।
তিনি বলেন, "বিএনপি জোটের রাজনীতি মোকাবেলা করতে হলে আওয়ামী লীগকে ইসলামপন্থীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত যারা বাংলাদেশকে গ্রহণ করে, তাদের মিত্র করার বিষয়টি স্বাভাবিক। এটাকে ছাড় না বলে আমি উপলব্ধি হিসেবে বলবো। কারণ মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির একটি ছিল সামাজিক সুবিচার। সেদিক থেকে দেখলে, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে অকারণে আহত করে রাজনৈতিক কোন লাভ নেই এবং বুদ্ধির দিক থেকেও তা ঠিক নয়।"
এতদিন ধরে মূলত বিএনপি'র বিরুদ্ধেই ইসলামপন্থী দলগুলোকে নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগ ছিল। এখন আওয়ামী লীগও ধর্মকে সামনে আনতে চাইছে, এমন অভিযোগ উঠছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগও একই পথে এগুলে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবির।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ মনে করেন, সরকার একটা রাজনৈতিক চাপে থাকার কারণে সাময়িক সুবিধা পাওয়ার জন্য যদি এমন কৌশল নেয়, সেটা সমাজ এবং রাষ্ট্রের ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
হেফাজতের সঙ্গে সরকার ও আওয়ামী লীগের সম্পর্ক নিয়ে বিশ্লেষকদের অনেকের মধ্যে নানান প্রশ্ন এবং সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে ।
কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করছেন, ধর্ম নিরপেক্ষতার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির জায়গা থেকে তাঁরা কোনোভাবেই সরে আসছেন না।
News Courtesy:
https://bbc.com/bengali/news-39582438