চীন যে কারণে কোয়াডে যোগদানের বিষয়ে বাংলাদেশকে ‘সতর্ক’ করেছে
ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং সম্প্রতি অনেককে অবাক করে দিয়ে খোলামেলাভাবে বলেছেন, কোয়াডে (যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া- চার দেশের কৌশলগত অনানুষ্ঠানিক নিরাপত্তা সংলাপ) বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ককে ‘যথেষ্ট খারাপ’ করবে।
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক অনেক বিশ্লেষকদের কাছে চীনের এই 'সতর্কবার্তা' অবাক করার মতো কারণ ঢাকা ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচিত হয় না। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে নয়াদিল্লি ভিত্তিক সাংবাদিক প্রণয় শর্মা এমনটাই জানিয়েছেন।
তেমনই একজন বিশ্লেষক হলেন ভারতের ফরেন সার্ভিসে ৩৬ বছর চাকরির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কানওয়াল সিবাল। তার মতে, বাংলাদেশের নৌ-বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় তাই দেশটি সমুদ্র নিরাপত্তায় অবদান রাখতে পারবে না। তিনি এটাও জানান যে, কোয়াডে যোগ দেয়ার জন্য বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এমন কোন কথা তিনি শুনেন নি।
বেইজিং কোয়াডকে একটি "চক্র" হিসেবে দেখছে উল্লখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়ঃ এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে গঠিত কোয়াড সমুদ্র, সাইবার ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বেইজিং এটিকে একটি "চক্র" বলছে যা নতুন স্নায়ু যুদ্ধ শুরু করতে পারে। অন্যান্য দেশগুলোকে কোয়াডে অন্তর্ভুক্ত করে এই 'গ্রুপিং' এর সম্প্রসারণ সম্পর্কে ক্রমশ উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে চীন।
সিবালের মতে, চীনা রাষ্ট্রদূতের ওই মন্তব্য ছিল 'বাংলাদেশকে ভারতের খুব বেশি কাছাকাছি না আসতে সতর্ক করা, যার মধ্যে রয়েছে ভারত এবং জাপানের সাথে পূর্ব দিকের সংযোগ প্রকল্পগুলো।'
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া একটি সংকেতের কথা উল্লেখ করেন- সে সময় (তৎকালীন) মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগান ঢাকা সফর করেছিলেন এবং ওয়াশিংটনের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন।
রীয়াজ বলেন, “চীনা রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যটি বাংলাদেশের কোয়াডে যোগদানের ভবিষ্যত সম্ভাবনা রোধ করার পূর্ব-উদ্যোগমূলক পদক্ষেপ। সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাছাকাছি যাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশকে সতর্ক করে দেয়াও।'
চীনা রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছিলেন, লি'র বার্তাটি ছিল "দুঃখ প্রকাশ করার মতো" এবং "আক্রমণাত্মক"। আমরা স্বতন্ত্র এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র, নিজেরাই আমাদের পররাষ্ট্রনীতি স্থির করি। এক্ষেত্রে চীনের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।
এদিকে, চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিং বুধবার এক নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় হস্তক্ষেপের কোন প্রচেষ্টার কথা অস্বীকার করে বলেন, কোয়াড সম্পর্কে যে কোন মন্তব্যের অর্থ হস্তক্ষেপ করা নয়, বরং রাজনৈতিক 'চক্র'-এর বিরোধিতা করা।
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে ভারত-চীনের প্রতিযোগিতা বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়ঃ
ভারত দীর্ঘদিন ধরেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চীনের সামরিক ও বিনিয়োগ সম্পর্ক নিয়ে সতর্ক - এই অঞ্চলটিকে ভারত তার প্রভাব বিস্তারের অঞ্চল হিসেবে দেখে - দুই দেশের সীমান্ত ভাগাভাগি নিয়ে চলমান বিরোধের মধ্যে সন্দেহ আরও বাড়ছে যা স্বাভাবিক হওয়ার তেমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, নয়াদিল্লি তার "নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসি'র আওতায় এসব দেশগুলোতে বিনিয়োগের মাধ্যমে এই অঞ্চলের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক বিশেষভাবে উষ্ণ হয়ে উঠেছে এবং এখন নয়াদিল্লি ঢাকাকে এই অঞ্চলের প্রবেশ দ্বাররূপে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে পৌঁছার জন্য নিজের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির অংশ হিসেবে দেখছে।
বাংলাদেশও ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল উন্মুক্ত করতে ভারতের সাথে কাজ করছে - যা চীনের সীমান্তবর্তী। জাপানও এমন একটি অঞ্চলের উন্নয়ন কাজ করতে আগ্রহী।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পয়েন্টকে বেইজিং স্বাগতম জানায় নি যারা বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করে। স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে চীনা অস্ত্রের শীর্ষ তিন ক্রেতার মধ্যে ঢাকা ছিল একটি।
ভারতের সামরিক মহল এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে, ভারত ও মিয়ানমারের সাথে বঙ্গোপসাগরের অংশীদার বাংলাদেশের বন্দরগুলো চীনা যুদ্ধজাহাজ এবং সাবমেরিনগুলোর ঘাট হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ভারতীয় নৌবাহিনী জানিয়েছে, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নিকটবর্তী অঞ্চলে তারা অধিক সংখ্যক চীনা জাহাজ শনাক্ত করেছে।
এ প্রসঙ্গে সিবাল বলেন, বেইজিং সতর্ক ছিল যে, বাংলাদেশ তার সাথে বন্দর প্রকল্পে কাজ করতে দ্বিধা করছে কারণ তা হবে ভারতের জন্য সংবেদনশীল। এটা শ্রীলঙ্কার মতো বিষয় নয় যারা "ভারতকে অধিকমাত্রায় প্রতিহত করেছে" এবং যেখানে চীন অধিকতর "সম্পৃক্ত" ছিল।
উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কা ২০১৭ সালে চীনকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ু থেকে মাত্র ১০০ মাইলেরও কম দূরত্বে অবস্থিত হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের ইজারা দেয়ার প্রস্তাব দেয় যা ভারতীয় মহলে নিরাপত্তা উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে। অতি সম্প্রতি, কলম্বো বন্দরের ইস্ট টার্মিনাল উন্নয়নের জন্য ভারত-জাপানের যৌথ প্রস্তাব শ্রীলঙ্কা প্রত্যাখ্যান করেছে যা চীনের নির্দেশে করা হয়েছে বলে অনেকে সন্দেহ করেন।
সিবাল বলেন, "শ্রীলঙ্কা যেমনটি করেছে বাংলাদেশ চীনের সাথে তেমন কোন বন্দরের সহযোগিতায় না গেলে সেটাই ভারতের জন্য যথেষ্ট"।
আলী রীয়াজ (যিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংক আটলান্টিক কাউন্সিলের একজন অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো-ও বটে) বলেন, চীনা রাষ্ট্রদূতের কোয়াড ইস্যু নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলাটা অবাক হওয়ার মতো হলেও তা ছিল গেলো মাসে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ওয়েই ফিংগের করা মন্তব্যের 'ফলো আপ'।
চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঢাকা সফরে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদকে বলেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় "সামরিক জোট" প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা এই অঞ্চলের বাইরের শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে দুই দেশের যৌথ প্রচেষ্টা চালানো উচিত।
তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান জানান যে, তিনি চীনা রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যকে হুমকিস্বরূপ দেখেননি। তার মতে, বেইজিং ঢাকার অবস্থান জানতো এবং ঢাকা "স্পষ্টতই কোনো আঞ্চলিক সামরিক জোটের অংশ হওয়ার প্রতি নিজের অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিল"।
তবে রীয়াজ বলছিলেন, বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে কোন প্রতিশ্রুতি দেয়নি কারণ সে চীনের সাথে নিজ সম্পর্ক বিপন্ন করতে চায় না। ঢাকা আসলে দুই কূল রক্ষা করে চলছিল। কোন একটা পক্ষ নেয়া একেবারে প্রয়োজনীয় না হওয়া পর্যন্ত (শেখ হাসিনা) সরকার ভারসাম্য রক্ষা করে চলবে।
রীয়াজের মতে- করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের জন্য বেইজিংয়ের উপর ঢাকার নির্ভরশীলতার সময়টাতেই চীনা রাষ্ট্রদূত ওই মন্তব্য করা উপযুক্ত বলে মনে করেছেন।
ভারত নিজেই করোনা পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত এবং ভ্যাকসিন সরবরাহে ঘাটতির কারণে প্রতিবেশীদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ডোজ সরবরাহ করতে অক্ষম৷ বাংলাদেশ ও নেপালের মতো দেশগুলো এখন চীনের সাহায্যপ্রার্থী। বুধবার চীনা সংস্থা সিনোফার্ম উৎপাদিত ভ্যাকসিনের (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিরাপদ এবং কার্যকর হিসেবে অনুমোদিত করেছে) পাঁচ লক্ষ ডোজ বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে।
এ নিয়ে সিবাল বলেন, ভারতের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি চীনকে একটি সুবিধা দিয়েছে কারণ ঢাকা নয়াদিল্লির উপর নির্ভর করতে পারছে না, যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের পরও জনসাধারণের নিকট চীনা ভ্যাকসিন গ্রহণযোগ্য হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। কারণ সংস্থাটির উপর চীনের অযাচিত প্রভাব রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
News Courtesy:
https://mzamin.com/article.php?mzamin=274117