লবিস্ট: এদের কাজ কী, কেন নিয়োগ করা হয়, এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বাংলাদেশে কেন বিতর্ক করছে
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধীদল বিএনপি এখন বিতর্কে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের প্রশ্নে।
এই বিতর্কের পটভূমি হচ্ছে র্যাব এবং এর সাতজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা।
পুলিশের বিশেষ বাহিনী র্যাব এবং এর কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে।
এরপর লবিস্ট নিয়োগের প্রশ্ন ইস্যু হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে।
যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে প্রধান দুই দলের বিতর্ক সংসদ পর্যন্ত গড়িয়েছে।
কিন্তু কেন এই বিতর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের তাৎপর্য কী-এসব প্রশ্নেও চলছে নানা আলোচনা।
লবিস্টের কাজ কী
যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রণেতাদের কাছে তথ্য তুলে ধরার জন্য একজন লবিস্ট কাজ করে থাকেন।
লবিস্টরা কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং এমনকি কোন দেশের পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে প্রভাব বিস্তার করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের তথ্য দিয়ে থাকে।
এছাড়াও সাধারণ মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তারের জন্যও তথ্য তুলে ধরা এই লবিস্টদের কাজ।
এই পেশায় বাণিজ্যিকভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান বা ফার্ম রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, তিনি নিজে পরিসংখ্যান চালিয়ে দেখেছেন, গত বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ৪৮০টি লবিস্ট ফার্ম বা প্রতিষ্ঠান ছিল।
লবিস্ট প্রতিষ্ঠানকে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস এর কাছে নিবন্ধন করতে হয়।
এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড তদারকি করে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের ন্যাশনাল সিকিউরিটি ডিভিশন।
লবিংয়ের জন্য আইনী ভিত্তিও আছে
ফরেন লবিস্ট এবং অভ্যন্তরীণ লবিস্ট-এই দুই ধরনের লবিস্ট রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করে থাকে অভ্যন্তরীণ লবিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
আর যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অন্য যে কোন দেশের ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং দেশ নিয়োগ করতে পারে ফরেন লবিস্ট প্রতিষ্ঠানকে।
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেও কোন ব্যক্তি অন্য দেশের পক্ষে লবিস্ট নিয়োগ করতে পারেন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩৮ সাল থেকে ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট নামে একটি আইন আছে। এই আইনের অধীনে ফরেন লবিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে।
অভ্যন্তরীণ লবিস্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য পৃথক আইন রয়েছে।
স্বচ্ছতা রয়েছে কতটা
লবিস্ট প্রতিষ্ঠান যখন কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোন দেশের পক্ষ হয়ে কাজ করে, তখন ঐ প্রতিষ্ঠানকে তার কাজের বিস্তারিত প্রকাশ করার বিধান রয়েছে।
কারা কার হয়ে কী ধরনের কাজ করছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টকে জানাতে হয়।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, লবিস্ট প্রতিষ্ঠান যখন কাজ নেয়, তখন প্রতিষ্ঠানটি সংশ্লিষ্ট পক্ষের সাথে চুক্তি করে। প্রতিষ্ঠানটি কাজের বিনিময়ে কত অর্থ পাবে-সেটাও চুক্তিতে থাকে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরেকজন বিশ্লেষক অধ্যাপক মেহনাজ মোমেন মনে করেন, লবিস্ট ফার্মের কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজের ক্ষেত্রে অর্থের একটা অংশকে ননপ্রফিট হিসাবে দেখানোর সুযোগ রয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, প্রেসিডেন্ট বুশের সময় থেকে এই সুযোগ তৈরি হয়েছে।
প্রভাব বিস্তার করে যেভাবে
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে এবং বাইরের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সাধারণ লবিস্টের মাধ্যমে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে, যাতে তাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়, এমন কোন আইন তৈরি না হয়।
সেজন্য লবিস্ট প্রতিষ্ঠান তাদের চুক্তিবদ্ধ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পক্ষের তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের কাছে তুলে ধরে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, অন্য দেশ সাধারণ তাদের দেশে মানবাধিকার লংঘনের বিষয় বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুর্বলতা থাকলে যুক্তরাষ্ট্র লবিস্ট নিয়োগ করে থাকে।
তিনি জানিয়েছেন, লবিস্ট প্রতিষ্ঠান সেই দেশের অনুকূলে তথ্যাদি যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের কাছে তুলে ধরে। একইসাথে তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গণমাধ্যম বা নাগরিক প্রতিষ্ঠান এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো মানবাধিকার সংগঠনের কাছেও সংশ্লিষ্ট দেশের পক্ষে তথ্য দিয়ে থাকে।
অনেক লবিস্ট ফার্ম অনেক ক্ষেত্রে পিআর বা গনসংযোগ প্রতিষ্ঠান হিসাবেও কাজ করে থাকে।
অধ্যাপক রীয়াজ মনে করেন, কোন দেশ যখন তাদের সুশাসনের অভাব বা মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারে লবিস্টের মাধ্যমে তথ্য সরবরাহ করে, তখন সেই তথ্য কতটা সঠিক-সেই প্রশ্ন থাকে এবং অনেক সময় বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
যদিও কোন দেশের ব্যাপারে নীতিগত কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র্রর কর্তৃপক্ষ এবং আইন প্রণেতারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য যাচাই করে থাকেন। কিন্তু লবিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রতিনিধির অনুকূলে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।
অধ্যাপক মেহনাজ মোমেন বলেন যে, বিভিন্ন দেশের মধ্যে ইসরায়েলের লবিস্ট যুক্তরাষ্ট্র্রে খুব প্রভাবশালী-সেটা সাধারণ মানুষেরও অজানা নয়।
এছাড়া তিনি উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ঔষধ এবং ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর লবিস্টদের প্রভাবের কারণে ভাল স্বাস্থ্যনীতি গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশে কেন লবিস্ট বিতর্ক
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাব এবং এর সাতজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যখন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, এরপরই লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে বিতর্কে নেমেছে বাংলাদেশের প্রধান দুই দল।
আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম-তারা দু'জনই সংবাদ সম্মেলন করে বিরোধীদল বিএনপির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র লবিস্ট নিয়োগ করে দেশবিরোধী তথ্য তুলে ধরার অভিযোগ করেন।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও একই অভিযোগ করছেন।
অন্যদিকে বিএনপি পাল্টা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের করের টাকায় লবিস্ট নিয়োগের অভিযোগ তুলেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির ভূমিকা রয়েছে, এমন একটি ধারণা জানগণের সামনে তুলে ধরতে চাইছে আওয়ামী লীগ। সেজন্য বিএনপির বিরুদ্ধে লবিস্ট নিয়োগের অভিযোগ এখন আনা হচ্ছে।
লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আওয়ামী লীগ যেমন সেই নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে মানুষকে ভিন্ন ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে বিএনপি অভিযোগের জবাবে পাল্টা অভিযোগ করছে।
একইসাথে মি. আহমেদ মনে করেন, বিএনপি বিরোধী দল হিসাবে দেশের ভেতরে ভূমিকা রাখতে পারছে না। দলটি সেই ব্যর্থতা ঢাকার জন্যও লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ অব্যাহত রেখেছে।
এছাড়া মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, লবিস্ট যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ হলেও বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই সংস্কৃতি নেই।
বাংলাদেশে লবিং অর্থ তদ্বির হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ফলে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে বিদেশে তদ্বির করার বিষয় সাধারণ মানুষ ভিন্নভাবে দেখতে পারে। এমন চিন্তা থেকেও দল দু'টি এই বিতর্ক করছে বলে মি. আহমেদ মনে করেন।
দল দু'টির যুক্তি কী
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই দলের নেতারাই পরস্পরের বিরুদ্ধে লবিস্ট নিয়োগে কোটি কোটি টাকা খরচ করা এবং এই অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বিবিসিকে বলেছেন, বিএনপি গত তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্টের পেছনে সাড়ে ৩৭ লাখ ডলার খরচ করেছে, যা বর্তমান মূল্যে ৩২ কোটি টাকার মতো।
তিনি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র্রের তিনটি লবিস্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে বিএনপি ২০১৮ সাল থেকে তিন বছরের জন্য চুক্তি করেছিল। সেই চুক্তিপত্রে ঢাকায় নয়াপল্টনের বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা দেয়া হয়েছে। এসব চুক্তির কপি সরকারের হাতে এসেছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য হচ্ছে, লবিস্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় অংকের এই অর্থ বিএনপি কীভাবে বিদেশে নিয়েছে এবং এই অর্থের উৎস কী-এই বিসয়ে তারা তদন্ত চাইছেন।
সেজন্য তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে চিঠি দিয়েছেন।
এখানে মানিলন্ডারিং করা হয়েছে কীনা-বিএনপির বিরুদ্ধে সেটা খতিয়ে দেখার কথা সরকার বলছে।
শাহরিয়ার আলম অভিযোগ করেন, বড় অংকের অর্থ দিয়ে লবিস্ট নিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্র এবং দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করে দেশ ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার তথ্যপ্রমাণ তারা পেয়েছেন-সেজন্য তারা বিএনপির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সামনে এনেছেন।
কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধেও লবিস্ট নিয়োগের পাল্টা অভিযোগ যে এসেছে, সে ব্যাপারে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর অপপ্রচারমূলক প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদমাদ্যমে প্রতিবাদ ছাপানোর জন্য সরকার ২০১৫ সালে একটি পিআর ফার্ম নিয়োগ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানকে প্রতি মাসে ২৫ হাজার ডলার করে দেয়া হয়।
এদিকে বিএনপি নেতারা অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।
তারা পাল্টা অভিযোগ করেছেন, মানুষের করের টাকা থেকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সরকার যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছে।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তাদের দল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে কোন লবিস্ট নিয়োগ করা হয়নি।
তিনি অভিযোগ করেন, মানবাধিকার লংঘনের ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র র্যাব এবং এর কর্মকর্তাদের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে-সে বিষয়টি আড়াল করার জন্য আওয়ামী লীগ এবং সরকার তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করছে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপির বিরুদ্ধে তদন্তের কথা বলা হচ্ছে।
ফলে লবিস্ট ইস্যুতে এই বিতর্ক এখনই থামছে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
News Courtesy:
https://www.bbc.com/bengali/news-60134354?fbclid=IwAR1PDq4L8xfytuQNhzoiv9JPCPy4D7h7I4c5OaYpsj8FFu1ILWjmMKSEV4w