ইরাক যুদ্ধে কল-কাঠি নাড়ানো ব্যক্তিরা এখন কে কোথায় রয়েছেন
বিশ বছর আগে যখন ইরাক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন বিশ্বের মানুষ হয়তো মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আর ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের নাম সবচেয়ে বেশি শুনেছেন। কিন্তু সেই যুদ্ধের পেছনে ভূমিকা ছিল আরও অনেক ব্যক্তির।
ইরাক যুদ্ধে সাড়ে চার হাজারের বেশি মার্কিন সেনা আর আনুমানিক এক লাখ বিশ হাজার ইরাকি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
বিশ বছর পার হলেও এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীলতা আসেনি ইরাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ-এর মতে, ইরাক যুদ্ধে যারা উস্কানি দিয়েছিলেন, যারা মনে করেছিলেন যে, ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা করা দরকার, তারা ছিলেন 'নিও কনজারভেটিভ।'
‘’তাদের উত্থান হয়েছিল নব্বুইয়ের দশক থেকে। তারা খুব জোরেশোরে চেষ্টা করছিলেন বিশ্বে নিজেদের একটা শক্তিমত্তা তুলে ধরার, ‘’ বলেন ড. রীয়াজ, যিনি বর্তমানে সুইডেনের ভ্যারাইটিস অফ ডেমোক্রেসি ইন্সটিটিউটের ভিজিটিং রিসার্চার।
‘’পরবর্তীতে রাজনৈতিকভাবে তারা এক অর্থে পরাজিত হয়েছে। তাদের আধিপত্য দেখানোর যে চিন্তাভাবনা, পরবর্তী পৃথিবীতে আর সেটা কাজ করেনি- না যুক্তরাষ্ট্রে, না বিশ্বে। পরবর্তীতে তারা নীতিনির্ধারণের অনেক বাইরে চলে গেছেন,’’ তিনি বলেন।
তিনি বলছেন, ইরাক যুদ্ধে বিপর্যস্ত হওয়া, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ- ইত্যাদি তাদের কোন সুবিধা দেয়নি। বরং রাজনৈতিকভাবে তাদের নানারকম সমস্যায় ফেলেছে।
ইরাক যুদ্ধের বিশ বছর পূর্তিতে বিবিসি জানার চেষ্টা করেছে, সেই যুদ্ধের পেছনে মূল ভূমিকা রাখা ব্যক্তিরা এখন কোথায় কেমন রয়েছে।
গণ বিধ্বংসী অস্ত্র
ইরাক যুদ্ধের মাত্র দুই বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই নাইন ইলেভেনের মুখোমুখি হতে হয় জর্জ ওয়াকার বুশ বা জর্জ ডব্লিউ বুশকে। সেই সময় মিত্র দেশগুলোর সাথে মিলে আফগানিস্তানে অভিযান চালিয়ে তালেবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন মি. বুশ।
এর প্রায় দেড় বছরের মাথায় তিনি ইরাকে অভিযান শুরু করেন।
তার আগে ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বুশ প্রশাসন নতুন জাতীয় নিরাপত্তা নীতি ঘোষণা করে, যেখানে বলা হয় যে, জৈবিক, রাসায়নিক বা পারমাণবিক অস্ত্র, গণ বিধ্বংসী অস্ত্রের অধিকারী কোন সন্ত্রাসবাদী বা দুর্বৃত্ত দেশ দ্বারা যুক্তরাষ্ট্র যদি হুমকি মুখোমুখি হয়, তাহলে সেটা ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনে সামরিক শক্তি ব্যবহার করবে।
দুই মাস পরেই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ নতুন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যেখানে অস্ত্র পরিদর্শকদের ইরাকে ফিরে যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়।
কিছুদিন পরেই যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনা মানছে না ইরাক এবং তাদের ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র আছে।
অবশেষে মার্চের ১৭ তারিখে সাদ্দাম হোসেনকে পরিবার নিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইরাক ছাড়ার সময়সীমা বেধে দেন প্রেসিডেন্ট বুশ।
তার ৪৮ ঘণ্টা পরেই শুরু হয় 'অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম'।
পরবর্তীতে ইরাকে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র না পাওয়া এবং ইরাক যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হয়ে ওঠায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন প্রেসিডেন্ট বুশ।
ইরাক যুদ্ধ নিয়ে নানারকম বিতর্ক এবং সমালোচনা থাকার পরেও ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জন কেরিকে হারিয়ে ২০০৪ সালের নির্বাচনে পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন বুশ।
তার মেয়াদ ২০০৯ সালে শেষ হওয়ার পর টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে ফিরে যান বুশ। সেখানে তিনি জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি তৈরি করেছেন। সেখানে জর্জ ডব্লিউ বুশ পলিসি ইন্সটিটিউট এবং অফিস অফ দি জর্জ ডব্লিউ বুশ ফাউন্ডেশন রয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছাড়ার পর থেকে প্রকাশ্যে খুব একটা আসেন না মি. বুশ।
'শয়তান' সাদ্দাম হোসেন
ইরাক যুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন স্যার অ্যান্টনি চার্লস লিনটন ব্লেয়ার, যিনি টনি ব্লেয়ার নামেই বেশি পরিচিত।
ইরাক যুদ্ধ নিয়ে পরবর্তীতে স্যার জন শিলকটের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘’২০০২ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর হাউজ অব কমন্সে টনি ব্লেয়ার ইরাকের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির সক্ষমতার যে প্রতিবেদন তুলে ধরেন, সেখানে তাদের সম্ভাব্য হুমকি হিসাবে তুলে ধরা হয়।
ভবিষ্যতের কোন একপর্যায়ে সেটা সত্যি হয়ে উঠতে পারে।‘’
শিলকট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শান্তিপূর্ণভাবে ইরাককে নিরস্ত্র করার পদক্ষেপ বিবেচনা না করেই ব্রিটেন ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছে।
তবে ওই প্রতিবেদনের সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করে পরবর্তীতে টনি ব্লেয়ার একটি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, কোন অজুহাত না দিয়েই ইরাক যুদ্ধের পরিণতি তিনি মেনে নিয়েছেন।
কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন, ‘শয়তান’ সাদ্দাম হোসেনের কবল থেকে যেন ইরাকের জনগণ মুক্তি পায় এবং কোনরকম জাতিগত সহিংসতার শিকার না হয়।
যুদ্ধে কিছু ভুলের জন্য তিনি দুঃখ, অনুশোচনা ও ক্ষমা চাইলেও তিনি মনে করেন, সাদ্দাম হোসেনকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
যুদ্ধের পরেও আরও চার বছর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন টনি ব্লেয়ার। তিনি হলেন যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে এই পদে দায়িত্ব পালনকারী কোন ব্যক্তি।
ইরাক যুদ্ধে সরকারের নীতি নিয়ে নানারকম সমালোচনার পরেও তাঁর নেতৃত্বে ২০০৫ সালের মে মাসের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে লেবার পার্টি।
তবে সে সময় দলের ভেতর নানারকম সমালোচনা এবং বেশ কয়েকজন জুনিয়র মন্ত্রীর পদত্যাগের পর ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ঘোষণা করেন যে, তিনি এক বছরের মধ্যেই পদত্যাগ করবেন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলছেন, সেই সময় যারা মিত্র হিসাবে কাজ করেছেন, তাদের অনেকেই পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে রাজনৈতিকভাবে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার দিকে বেশি এগিয়েছেন।
''তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমেছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের এই ভূমিকার জন্য তাদের দলগুলো পরবর্তী নির্বাচনে বড় রকমের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে গেছে,‘’ তিনি বলেন।
স্কটিশ পার্লামেন্টে ২০০৭ সালের মে মাসে বড় ধরনের পরাজয় এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে স্থানীয় জোটের কাছে ক্ষমতা হারানোর পর প্রধানমন্ত্রী পদ এবং হাউজ অব কমন্সের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন টনি ব্লেয়ার।
এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া আর জাতিসংঘ মিলে গঠিত ‘কোয়েট’ এর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ দূত হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তিনি ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই পদে ছিলেন।
তবে টনি ব্লেয়ার আলোচনায় ফিরে আসেন ২০১৭ সালের মার্চ মাসে, যখন তিনি 'দ্য টনি ব্লেয়ার ইন্সটিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জ' নামের একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের ঘোষণা দেন।
বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান হিসাবে রয়েছেন।
রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ২০২১ সালে টনি ব্লেয়ারকে নাইটহুড উপাধি দেন।
ডিক চেনি
বুশ প্রশাসনের জ্বালানি নীতি এবং মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণে মূল ভূমিকা রেখেছেন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি।
ডিক চেনি গণমাধ্যমের সামনে হাজির হয়ে ২০০৩ সালের ১৬ই মার্চ দাবি করেছিলেন যে, ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে।
পরবর্তীতে অবশ্য তার সেই তথ্য ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়।
আমেরিকান গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর ডিক চেনির সাবেক প্রতিষ্ঠান হ্যারিবার্টন ইরাক পুনর্গঠনের একাধিক লোভনীয় কাজ পায় আমেরিকান সরকারে কাছ থেকে।
ড. আলী রীয়াজ বলছেন, ইরাক যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনার অন্যতম একটা বিষয় ছিল তেল সম্পদের ওপর তাদের আধিপত্য তৈরি করা, এবং মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিকভাবে এক ধরনের আধিপত্য তৈরি করা।
''কিন্তু সেটা তো হয়নি, বরং উল্টোটা হয়েছে,'' তিনি বলছেন।
'' সাদ্দাম হোসেনের পতনের পরে ইরাকে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হলো, শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে মতপার্থক্য, ইরানের প্রভাব বেড়ে যাওয়া, এই প্রভাব অনেকে ভাবতে পারেননি।‘’
‘’ফলে আর্থিকভাবে যে ক্ষতি যুক্তরাষ্ট্রের হয়েছে, তার চেয়েও রাজনৈতিকভাবে তারা অনেক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে,‘’ ড. রীয়াজ বলেন।
ডিক চেনি ২০০৯ সালে অফিস ছাড়ার পর মাঝে মাঝে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় এসেছেন।
বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে ওবামা প্রশাসনের নীতি নিয়ে তিনি অনেক সমালোচনা করেছেন।
ডিক চেনি ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।
কংগ্রেসে ডিক চেনির সাবেক আসনে পরের বছর তার মেয়ে লিজ নির্বাচিত হলে ডিক চেনি বলেন, প্রয়োজনে যেকোনো পরামর্শ দিয়ে তিনি পাশে থাকবেন।
পরবর্তীতে তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন।
ডোনাল্ড হেনরি র্যামসফিল্ড
তিনি ছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। ফলে পদের কারণেই আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানে তাকে প্রধান ভূমিকা রাখতে হয়েছে।
তার দপ্তর এমন তথ্য উপস্থাপন করেছিল যে, আল-কায়েদার সঙ্গে সাদ্দাম হোসেনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।
ফ্রান্স ও জার্মানি ইরাক যুদ্ধে বিরোধিতা করায় তাদের ‘ওল্ড ইউরোপ’ বলে বর্ণনা করেছিলেন র্যামসফিল্ড।
যুক্তরাষ্ট্র ও নেটো মিলিয়ে আটজন জেনারেল মিলে ২০০৬ সালে সামরিক পরিকল্পনা এবং কৌশলের বিষয়ে অদক্ষ দাবি করে হেনরি র্যামসফিল্ডের পদত্যাগের দাবি জানান।
নভেম্বরে পদত্যাগ করেন র্যামসফিল্ড।
এরপর হেনরি র্যামসফিল্ড বেশ কয়েকটি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ও চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন।
অবসর জীবন কাটানোর সময় ২০২১ সালে তিনি মারা যান।
News Courtesy:
https://www.bbc.com/bengali/articles/c039zlge5nro?mibextid=Zxz2cZ&fbclid=IwAR2Pdq_d5tiABa06xLjYDNexAeqDuzZGoHJKHxkiBO7MYG6_1FPrcVu3Ieg%5C