মানবাধিকারকর্মীদের বড় বাধা ‘রাষ্ট্রীয় সংস্থা’

মানবাধিকারকর্মীদের বড় বাধা ‘রাষ্ট্রীয় সংস্থা’

মানবাধিকারকর্মীদের কাজে ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে বাধা এসেছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও ক্ষমতাসীন দল থেকে। এর মধ্যে ৪১ শতাংশ ক্ষেত্রে কাজে বাধা দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তারা। নানা ধরনের বাধা ও হুমকির মুখে প্রতি ১০ জন মানবাধিকারকর্মীর ১ জনকে এলাকা ছাড়তে হয়েছে।

দেশের ৩৬টি জেলার তৃণমূল পর্যায়ের ৫০ জন মানবাধিকারকর্মীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) শনিবার এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। সাক্ষাৎকার দেওয়া ৪৬ শতাংশ মানবাধিকারকর্মী বলেছেন, দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে এবং ৬২ শতাংশ মানবাধিকারকর্মী বলেছেন, সামগ্রিক পরিস্থিতি তাঁদের কাজের জন্য ‘অনিরাপদ ও খুবই অনিরাপদ’।

রাজধানী ঢাকার একটি হোটেলে ‘প্রতিবাদীদের কে রক্ষা করবে, বাংলাদেশে মানবাধিকারকর্মীদের দুর্দশা’ শিরোনামে জরিপ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তারা মানবাধিকারকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। এই পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন অংশীদারের মধ্যে সংলাপ আয়োজনের ওপর জোর দেন তাঁরা।

জরিপটি পরিচালনা করা হয় এ বছরের গত ২৪ মে থেকে গত ২৫ জুনের মধ্যে। জরিপে অংশ নেওয়া মানবাধিকারকর্মীদের ৭৯ শতাংশের মানবাধিকারকাজে ১০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। ১৪ শতাংশ মানবাধিকারকর্মী ছিলেন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্য, ২০ শতাংশ ছিলেন নারী।

* ৫০ মানবাধিকারকর্মীর সাক্ষাৎকারের ওপর সিজিএসের প্রতিবেদন প্রকাশ।
* মানবাধিকারকর্মীদের কাজে ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে বাধা এসেছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও ক্ষমতাসীন দল থেকে।
* এর মধ্যে ৪১ শতাংশ ক্ষেত্রে বাধা দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তারা।

গবেষণা প্রতিবেদনে নেতৃত্ব দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এই জরিপের মাধ্যমে দেশে মানবাধিকারকর্মীদের কাজের চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো তুলে আনা হয়েছে। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় মানবাধিকারকর্মীরা ভয়ে কোনো কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি। এ থেকে বোঝা যায়, পরিস্থিতি আসলে কোন পর্যায়ে। ৪১ শতাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো থেকে মানবাধিকারকর্মীদের কাজে বাধা দেওয়া হয়েছে। এ থেকে রাষ্ট্রের আচরণও বোঝা যায়। রাজনৈতিক কারণে মানবাধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ছাড়তে হয়েছে এলাকা
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি বাধার মুখে পড়েন মানবাধিকারকর্মীরা। প্রায় ২৪ শতাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল, প্রায় ২১ শতাংশ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রায় ১২ শতাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও ৯ শতাংশ ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা বাধা দেন। এর বাইরে ১৩ শতাংশ ক্ষেত্রে ধর্মীয় কাজে যুক্ত ব্যক্তি, উগ্রপন্থী ও অপরাধীদের মাধ্যমে; ৯ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ও ব্যবসার স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী; ৬ শতাংশ ক্ষেত্রে বিরোধী দল এবং প্রায় ৭ শতাংশ ক্ষেত্রে অন্যান্য কারণে মানবাধিকারকর্মীরা কাজে বাধার মুখে পড়েন। কাজের কারণে মানবাধিকারকর্মীদের সবচেয়ে বেশি ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এ ছাড়া শারীরিক আঘাত, চাঁদাবাজি, হয়রানি, গ্রেপ্তার, শোষণের শিকার হতে হয়েছে তাঁদের। প্রতি ১০ জন মানবাধিকারকর্মীর ১ জনের পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরাও হয়রানির শিকার হয়েছেন। সামনাসামনি হুমকির শিকার হন প্রায় ৩২ শতাংশ মানবাধিকারকর্মী। একই সংখ্যক হুমকি এসেছে ফোনে। ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হুমকি দেওয়া হয়েছে। হুমকির কারণে ৩৭ শতাংশ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কাজটি বন্ধ করতে হয়েছে মানবাধিকারকর্মীদের। প্রায় ২১ শতাংশ মানবাধিকারকর্মী জানিয়েছেন, আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা না থাকার কারণে তাঁরা হুমকির বিষয়ে অভিযোগ করেননি। একই সংখ্যক মানবাধিকারকর্মী জানিয়েছেন, হুমকিদাতাদের প্রতিশোধ নেওয়ার ভয় থেকে অভিযোগ করেননি। তবে এত কিছুর পরও ৩০ শতাংশ মানবাধিকারকর্মী জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের কাজ অব্যাহত রেখেছেন। যদিও ২৯ শতাংশ মানবাধিকারকর্মী তাঁদের কাজের মাত্রা কমিয়ে ফেলার কথা বলেছেন। হুমকি ও বাধার মুখে এলাকা ছেড়েছেন প্রায় ১১ শতাংশ মানবাধিকারকর্মী।

অনুষ্ঠানে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন জেড আই খান পান্না বলেন, বিচারিক বিভাগের ওপর কারও কোনো আস্থা আছে বলে মনে হয় না। দেশ চলছে পুলিশের মাধ্যমে, আমলাদের মাধ্যমে। এখন টাকা থাকলে দলের মনোনয়ন কেনা যায়। রাজনীতি চলছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে। আইনের শাসনই মানবাধিকারকর্মীদের বাঁচাতে পারে।

সংলাপের আহ্বান
সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, কমিশন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পেলেই শোনে এবং সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে সুপারিশ করে। সরকার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেয়। এখন সাংবাদিকেরা মূল মানবাধিকারকর্মী। তাঁদের বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। জামালপুরে সাংবাদিক গোলাম রব্বানিকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, এখন ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন গড়ে উঠেছে, তারা কোনো কাজ করে না। অর্থের বিনিময়ে দুই পক্ষের সমঝোতা করে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব সংগঠনের দিকেও নজর রাখতে হবে।

ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ–এর সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, সরকারগুলো মানবাধিকারকর্মীদের ‘দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে’, ‘দেশের শত্রু’ বলে ‘আখ্যায়িত’ করে। ব্যক্তিদের ভয় দেখাতে তারা এটা করে। সরকারগুলো চায় না এই ব্যক্তিরা সত্য তথ্য ছড়াক। সংলাপের আয়োজন করে এসব নিয়ে কথা বলা দরকার।

বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) সম্মানসূচক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেন, অতীতেও বিভিন্ন সরকারের সময়ে মানবাধিকারকর্মীদের কাজে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে, বাধা দেওয়া হয়েছে। আগে অনেক মানবাধিকার সংস্থার বিদেশি সহায়তাও আটকে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। অতীতের সেসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়া উচিত নয়। এখন অনেক আইন হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে আইনি প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। বিচারিক হয়রানি হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়ে করতে হবে, তা পাওয়া যায় না। তিনি এই পরিস্থিতির মধ্যে সংলাপে বসার আহ্বান জানান।

কামাল উদ্দিন আহমেদ ও সারা হোসেন অতীতে অন্য সরকারগুলোর সময়ে দীর্ঘ সময় ধরে মানবাধিকারকাজে যুক্ত কর্মীদেরও জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন। এর জবাবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, জরিপে ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন এবং ১৫–২০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কয়েকজন মানবাধিকারকর্মীও রয়েছেন।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, দেশে ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে মানবাধিকারকর্মীরা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। জাতিসংঘ এ বিষয়ে কয়েকবার বাংলাদেশকে সতর্ক করেছে।

News Courtesy:

https://www.prothomalo.com/bangladesh/0gzu7fmddb?fbclid=IwAR3O1zeln4gdQW46xScASQo_IefVxl49nqfCEXGqsMKruOPVWeOyb4QfXdg

An unhandled error has occurred. Reload 🗙