অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই পারবে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি ও অর্থনীতি নিশ্চিত করতে
বাংলাদেশ বড় বিপদে আছে, বড় সংকটে আছে। এই সংকট সহসা তৈরি হয় নি। সমস্যাটা রাজনৈতিক। এটাই ছিল ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের অনিবার্য পরিণতি। দেশে কর্তৃত্ববাদের রাজনীতি, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম (স্বজনতোষী পুঁজিবাদ) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ থেকে বের হওয়ার জন্য কোনো যাদুকরী সমাধান নেই। উপায় একটাই- সকলকে নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করা, সকলকে নিজ নিজ ভোট দিতে দেওয়া। কেননা একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই পারবে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি এবং অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি নিশ্চিত করতে।
বৃহস্পতিবার (০৯ নভেম্বর) সকালে অনুষ্ঠিত "দমন, আন্দোলন ও অর্থনীতি: বাংলাদেশের পথরেখা" শীর্ষক ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ এর বিশেষ ওয়েবিনারের সমাপনী বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ এমন মন্তব্য করেছেন।
বিশিষ্ট সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারের আরেক আলোচক সাবেক ডিস্ট্রিক্ট জজ এবং সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার জেনারেল ইকতেদার আহমেদ বলেন, আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তারের ২৪ ঘন্টার মধ্যে অভিযুক্তকে আদালত বা মেজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করার কথা। এটা সংবিধানে আছে, ফৌজদারি কার্যবিধিতেও আছে। আগে আদালত ১০০ জনের মধ্যে ১ জনের রিমান্ড মঞ্জুর করতেন।
এখনতো প্রায় সবাইকে রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে, এমনকি রিমান্ডে নিয়ে মানসিক বা শারীরিক নির্যাতনের কথাও শোনা যাচ্ছে। আদালতে নিয়ে আসামিকে হাতজোড় করে রাখা হচ্ছে যা বেআইনি।
তিনি বলেন, আগে সব জায়গায় জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হতো। তা সুপ্রিম কোর্টের বিচারকই হোক কিংবা সচিবদের ক্ষেত্রেই হোক। দেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তা দিয়েই দেশের সব মেগা প্রজেক্ট সম্পন্ন করা যেতো বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, যারা নিজেদের নেত্রীর নির্দেশে লগি-বৈঠা নিয়ে এসে মানুষ পিটিয়ে হত্যা করে লাশের উপর নৃত্য করেছিল, সরকারি কর্মকর্তাদের উলঙ্গ করেছিল, এমনকি সরকারে ক্ষমতাসীন থাকাকালে যাদের ছাত্র বা যুব সংগঠনকে হরহামেশাই প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করতে দেখা গেছে সেই আওয়ামী লীগের নেতারা অন্য কোনো দলকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলার নৈতিক অধিকার রাখেন কি? সাম্প্রতিক সময়ে তদন্ত ছাড়াই পুলিশ বিএনপির উপর দোষ চাপিয়ে দিয়েছে।
আমরা কি রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানকে গায়েবি মামলার বিষয়ে পুলিশ কিংবা সরকারকে জবাবদিহি করতে দেখেছি? প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, বিগত ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে নি। তাহলে, দেশে গত ১০ বছর ধরে কি বৈধ সরকার রয়েছে? আমরা দেখেছি, নির্বাচন যতো বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, দেশে নৈরাজ্য-লুটপাট, দেশ থেকে অর্থপাচার ততো বেশি হয়। পুলিশ ক্রমাগতভাবে ট্রিগার-হ্যাপি বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। গত ১৫ মাসে ২৩-২৭ জন বিএনপি কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। নির্বাচনের পর পুলিশের দৌরাত্ম যেমন আরও বাড়বে তেমনি অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্মও আরও বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী সংসদে 'জানোয়ার' শব্দ উচ্চারণ করলেও স্পিকারকে আমরা শুনতে পাইনি এই ভাষাকে 'অসংসদীয়' বলতে। কোনো সংসদ সদস্যকেও কথা বলতে দেখিনি। সর্বব্যাপী দুর্নীতি এবং লুটপাটের মধ্যে আছে দেশ।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর নির্বাহী পরিচালক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর সাবেক ডিভিশন চীফ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমান অর্থমন্ত্রী দৃশ্যমান নন। সংকটের সমাধান তাকে দিয়ে হবে না। নতুন 'ডায়নামিক' কাউকে প্রয়োজন। অর্থমন্ত্রী কয়েক বছর আগে যে নয়-ছয় করেছিলেন, সেটা দেশের অর্থনীতির বড় ক্ষতি করে দিয়েছে। গভর্নরকে জিজ্ঞেস করলে বলবেন, আমার কিছু করার নেই। আর্থিক খাতে ভয়াবহ দুরবস্থা। অর্ধেক ব্যাংকই দেউলিয়া। অর্থনীতির এই সংকটের কারণ রাজনৈতিক। আর্থিক খাতে যে দুর্নীতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা রাজনৈতিক অবক্ষয়েরই ফসল। সরকার যদি একটা নির্বাচন করেও ফেলে তাহলে নির্বাচনের পর সব ঠিক হয়ে যাবে তাও নয়।
সরকার যাদের সাহায্যে ক্ষমতায় আসবে নির্বাচনের পর তাদের বিরুদ্ধে যাবে কিভাবে? প্রশ্ন করে তিনি বলেন, দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল ছাড়াও বেশিরভাগগুলোর মধ্যেও গণতন্ত্র নেই। তারা পরিবারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চা করছে। রাজনৈতিক কারণ বাদ দিলেও অর্থনৈতিক কারণে পশ্চিমা দেশগুলোতে তৈরি পোশাক রপ্তানি এমনিতেই কমে যাচ্ছে। সামনের মাসগুলোতে তা ২০% কমতে পারে। পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন প্রতিহত করতে সরকার অব্যবস্থাপনা করে ফেলেছে। সবমিলিয়ে দেশের এই সংকট থেকে উত্তরণে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সাথে নিয়ে প্রয়োজনে জেলে গিয়ে হলেও সরকারকে সমঝোতার উদ্যোগ নিতে হবে।
ওয়েবিনারে অংশগ্রহণকারী দেশের আরেক প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ড. আহসান এইচ মনসুরের সাথে একাত্মতা পোষণ করে বলেন, বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট রাজনৈতিক সংকটের সাথেই যুক্ত। এ থেকে উত্তরণে সঠিক ও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে যার জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ প্রয়োজন।
News Courtesy:
https://mzamin.com/news.php?news=82708&fbclid=IwAR0e4pnLJbBC5bipBXkYSVjKj3vIKCdeeSGi3JR9ZsQL4eS-eMI6v5isksM