সংসদে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দিতে হবে: আলী রীয়াজ

জাতীয় সংসদের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পক্ষে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিজেদের যে অবস্থান জানিয়েছে সে বিষয়ে নিশ্চয়তা চেয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ, যিনি সংবিধান সংস্কার কমিশনেরও প্রধান ছিলেন।
সংস্কার বাস্তবায়ন বিষয়ে সবার মধ্যে সন্দেহপ্রবণতা আছে, এমন পর্যবেক্ষণ হাজির করে তা নিয়ে বিপদের আশঙ্কা থাকার কথাও বলেছেন তিনি।
বাংলাদেশে অধিকাংশ সংশোধনী বাতিল হয়েছে মনে করিয়ে দিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোকে এই প্রতিশ্রুতি, এই নিশ্চয়তা দিতে হবে। যেটাই হোক, একটা বিষয়ই হোক, আর ৫০টা বিষয় হোক, তাদের এই জায়গায় বাধ্যতামূলক জায়গাটা আপনাকে তৈরি করতে হবে।”
সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে যে সনদ তৈরি হবে সেটিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জনগণের চুক্তি হিসেবে দেখেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি। তার মতে, এই চুক্তি ভঙ্গ করলে জনগণ তার জবাব দেবে।
সংবিধান সংস্কারের প্রশ্নে জাতীয় সংসদের বিকল্প হিসেবে তিনি যেমন গণভোটকে দেখিয়েছেন, তেমনি সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব বলেও মত দিয়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড আউট’ এ অতিথি হয়ে এসেছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
সংস্কার প্রক্রিয়া, জুলাই সনদ, সংবিধান সংস্কার, কবে নাগাদ নির্বাচন নির্বাচন করা যাবে, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, ক্ষমতাচ্যুত দলটির সমর্থক ও ভোট বিষয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ ও মতামত তুলে ধরেছেন তার আলোচনায়।
বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়।
সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা কী?
গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলন ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে প্রায় দেড় দশক ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী সরকারকে। দেশ ছেড়ে পালাতে হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরে প্রথম ধাপে জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কারে উদ্যোগ নেয়।
এর মধ্যে পুলিশ সংস্কার বাদে বাকি পাঁচটি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশনের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম ধাপের আলোচনা শেষ পর্যায়ে। এরপর শুরু হওয়া কথা রয়েছে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ।
সংস্কার উদ্যোগের মধ্যেই বিএনপিসহ কয়েকটি দল দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে।
ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের একমাত্র পথ হিসেবে জাতীয় সংসদের কথা বলেছে দলগুলো। অন্যদিকে জুলাই আন্দোলনকে ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ কয়েকটি দল গণপরিষদ নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছে।
সবশেষ মঙ্গলবার বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বলেছে, সংস্কার প্রস্তাব নির্বাচিত সরকারের জন্য তৈরি করে রেখে দিয়ে দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া সংবিধান সংশোধনের সুযোগ নেই।
এই বিষয়টি তুলে ধরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোকে এই প্রতিশ্রুতি, এই নিশ্চয়তা দিতে হবে; যেটাই হোক একটা বিষয়ই হোক, আর ৫০টা বিষয় হোক। তাদেরকে এই জায়গায় বাধ্যতামূলক জায়গাটা আপনাকে তৈরি করতে হবে। সেটার মধ্যে যদি উনারা বলেন যে এই বিষয়গুলো এবং সংবিধান সংস্কারের বিষয়গুলো নির্বাচিত সংসদ করবে।
“এখন ওনারা যদি রাজি হয়, এগুলো সংসদ করবে। কিন্তু এইটা যে করবে এই নিশ্চয়তা আমাকে দিন। আমাকে বলতে, আমি বলছি জনগণকে দিন। কারণ এই সনদ যেন একটি চুক্তি হয়। এটা হচ্ছে জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর চুক্তি। তো আপনি চুক্তি ভঙ্গ করলে কী হবে? জনগণ তার উত্তর দেবে।”
তবে এই চুক্তি ভঙ্গ করলে আইন আদালত দিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে সেটিও মনে করেন না তিনি। তার মতে, “এটা রাজনীতি নয়।”
আলী রীয়াজ বলেন, “কিন্তু আপনি এটা যে বাস্তবায়ন করবেন। সকলেই তো আপনারা সন্দেহপ্রবণ, সেটা বুঝি। এই বাধ্যতামূলক জায়গাটা কীভাবে তৈরি করা যায়? একটা বিপদ থেকে যায়।”
বাংলাদেশে অধিকাংশ সংশোধনীর পরে আদালত থেকে বাতিল হয়েছে মনে করিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “তাহলে এমন কিছু করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে সেটা আর না হয়। যদি এটাকে আপনি বলেন, যেটা গণপরিষদ এবং সংসদ কেউ কেউ এই প্রস্তাবটা দিচ্ছেন, আমি কিন্তু এই প্রস্তাবটা দিচ্ছি না।”
‘জুলাই ঘোষণাপত্রের সঙ্গে জুলাই সনদের কোনো সম্পর্ক নেই’
অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে একটি ‘জুলাই প্রক্লেমেশন’ বা ঘোষণাপত্র প্রকাশের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। গত ২৯ ডিসেম্বর ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে সামনে আনে তারা। বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর ওই ঘোষণাপত্র প্রকাশের কর্মসূচিও দেয় তারা।
প্রথমে সরকার এর সঙ্গে যুক্ত না হলেও পরে এ প্রক্রিয়া শুরুর কথা জানায়। তখন ৩১ ডিসেম্বর ঘোষণাপত্র প্রকাশের কর্মসূচি বদল করে সরকার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর একীভূত সুপারিশ চূড়ান্ত করার পাশাপাশি এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরির জন্য কাজ করছে ঐকমত্য কমিশন।
সংলাপ শেষে রাজনৈতিক দল ও আগ্রহী জনগণের মতামতের ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশ করা হবে। এই জুলাই সনদকে কমিশন জাতীয় সনদও বলছে।
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে মন্তব্য করে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেছেন, কমিশনের জুলাই সনদের সঙ্গে এর পার্থক্য আছে।
রাজনীতি ও সরকার বিষয়ের এই শিক্ষক বলেন, “‘জুলাই সনদ’ বলতে যেটা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটা হচ্ছে জুলাই প্রক্লেমেশন। আপনাদের মনে আছে, গত বছরের শেষ দিকটাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা একটা জুলাই প্রক্লেমেশনের কথা বলেছিলেন সেটা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনাও হয়েছিল। অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিল। পরে যে কোনো কারণেই হোক সেটা শেষ পর্যন্ত ঘোষিত হয়নি।
“অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার বিষয়ের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কোনো যোগাযোগ নেই। তার কারণ হচ্ছে যে, ওটা (জুলাই প্রক্লামেশন) শুরু হয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রতিষ্ঠার অনেক আগে। ফলে তারা যেটা বলছে এটা প্রক্লামেশনের কথা বলছে। প্রক্লেমেশন শব্দটা যথাযথ বাংলা পাওয়া যাচ্ছে না বলে সনদ বলছেন।
“আমরা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন থেকে যে উদ্যোগটা নিয়েছি, যে দায়িত্বটা আমরা পেয়েছি সেটা হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন রকম সুনির্দিষ্ট সুপারিশ, সেগুলোর একটা সনদ তৈরি করা। ফলে এটা যদি, এটাকে আমরা জুলাই সনদ বলবো কিনা সেটা নির্ভর করছে আমরা জুলাই মাসে শেষ করতে পারছি কিনা। এটা দুটো দুই জিনিস, দুটাকে নিয়ে একটু ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে কোথাও কোথাও, আমি বুঝতে পারছি।”
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক। ফাইল ছবি
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক। ফাইল ছবি
‘সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখনের বিকল্প পথ গণভোট’
সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ ছাড়া সংশোধনের কোনো সুযোগ না থাকা না থাকা নিয়ে বিতর্ক চলছে। কেউ কেউ গণপরিষদের কথা বলছেন, কেউ সংবিধান সংস্কার পরিষদের কথা বলছেন, আর বিএনপিসহ কয়েকটি দল বলছে জাতীয় সংসদের কথা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, “সংবিধান সংশোধন বলেন, সংযোজন বলেন, বিয়োজন বলেন, পুনর্লিখন, যাই বলেন, আপনি যেকোনো শব্দ পছন্দ করুন। সেটা নাগরিকদের কাছ থেকে যেহেতু ম্যান্ডেট নিয়ে করতে হবে এখন সে ম্যান্ডেটটা আপনি কীভাবে নেবেন। বিভিন্ন পথ পদ্ধতি আছে।
“অধ্যাদেশ দিয়ে সংবিধান সংশোধনের ঘটনা এই দেশে ঘটেছে, তাই না? পরে এটা আবার সংসদ দিয়ে কিন্তু অনুমোদন হইতেছে। তো পথের দিক থেকে অনেক রকম পথ আছে।
“ধরুন গণভোট একটা পদ্ধতি হতে পারে। আবার ধরুন, এটা হইতে পারে যে গণভোট এবং সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে হল। গণভোটেই এই সনদ গৃহীত হল অথবা গৃহীত হল না। গৃহীত হলে এটা দায়িত্ব হয়ে পড়লো, যারা সংসদে যাচ্ছেন তাদের।”
সংবিধান সংস্কার জনগণ চায় কি চায় না সেটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জানা সহজ, এমন মত দিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, নির্বাচনে জনগণের সামনে এ বিষয়টি তুলে ধরা হল। জনগণ সেটির পক্ষে ভোট দিয়ে বলে দিল, এটাই আপনারা করবেন। শুধু এটাই নয়, রাজনৈতিক দলগুলো অন্য অনেক বিষয়েই কাজ করবে।
‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার নির্বাচনের আগেই সম্ভব’
বিএনপির দাবি, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার। তারা নির্বাচনের একটি পথনকশাও দাবি করছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, কম সংস্কার করে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে এ বছর ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। আর যদি সংস্কার পুরোপুরি শেষ করার পক্ষে মত দেয়, তাহলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।
আলী রীয়াজ মতে, যে সংস্কার প্রক্রিয়া চলছে, সেটা এর আগে শেষ করে ডিসেম্বর বা এই সময়ে কাছাকাছি নির্বাচন করা সম্ভব।
“সবচেয়ে বড় জিনিস হচ্ছে সংস্কার প্রক্রিয়া যেগুলো চলছে এটা কালকে শেষ হবে, পরশু দিন শেষ হবে, ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ শেষ হবে, এভাবে নির্ধারণ করতে পারবেন না। সংস্কারের প্রক্রিয়াটা চলমান। কিছু হচ্ছে রাষ্ট্র কাঠামো, খুব জরুরি পরিবর্তন, সংশোধন, সংযোজন দরকার হয়ে পড়েছে।”
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থায় কিছু কিছু সংস্কার করা খুবই জরুরি দাবি করে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, “আমরা চাই সকলে যাতে নির্ভয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে। ফলে কিছু হয়ত আগে হবে, এগুলো কিছু কিছু পরিবর্তন তো দেখতেই পাচ্ছেন। কিছু কিছু করা হচ্ছে সংস্কার, তাই না?
“এখন থেকে সংস্কার কিছু না হলে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হয়ে যাবে, এরকম আমি মনে করি না। কিছু কিছু আশু কাজ হচ্ছে, প্রতিশ্রুতি সামাজিক চুক্তি, সনদ যেভাবে বলেন। সেটা নিশ্চিত করতে হবে।”
নির্বাচন প্রক্রিয়া ঐকমত্য কমিশনের কাজ নয়, বরং এটা যে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কাজ সেটি তুলে ধরে তিনি বলেন, “তারা ঠিক করতে পারবেন। কবে করতে (নির্বাচন) পারবেন।”
আওয়ামী লীগের ‘ভোটার নিয়ে সন্দেহ’
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থকরা আওয়ামী লীগেই স্থির আছেন কি না তা নিয়ে ‘সন্দেহ’ প্রকাশ করেছেন ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
তিনি বলেন, “২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল। তারপর তো আর নির্বাচন হয়নি দেশে। ওই ৩০ শতাংশ ওখানেই বসে আছে? আমি নিশ্চিত না কিন্তু।
“একটা রাজনৈতিক দল সন্ত্রাসী তৎপরতায় যুক্ত হয়েছে। ১৬ বছর ধরে এ দেশের মানুষকে নিপীড়ন করেছে। গুম খুনে যুক্ত থেকেছে। আওয়ামী লীগের সব কর্মী সেটাকে মেনে নিয়েছে? সেটার প্রতি অনুগত থেকে গেছে?”
সেই নবম সংসদ নির্বাচনের পর লাখ লাখ তরুণ যারা ভোটার হয়েছে তাদের প্রসঙ্গ টেনে আলী রীয়াজ বলেন, “এই ৩০ শতাংশকে ৫০ শতাংশ বলছেন না কেন? হইতে পারে যে তারা সবাই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে, হতে পারে আবার এই ৩০ শতাংশ ২৯ শতাংশে চলে গেছে, ১৫ শতাংশ ইত্যাদি।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা ‘যৌক্তিক’
জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের দাবির মুখে শনিবার আওয়ামী লীগের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। সোমবার নিষেধাজ্ঞার প্রজ্ঞাপন আসার পর রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত যৌক্তিক কিনা?
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজে মতে, এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পেছনে ‘যথেষ্ট যৌক্তিক’ কারণ আছে।
তিনি বলেন, “দায়টা আগে আমাকে বুঝতে হবে, যে কোনো রাজনৈতিক দল হিসেবে তার দায়টা। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অন্যান্য সহযোগী রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করে বেরিয়ে এসে সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং দেখা মাত্র গুলির ঘোষণা দিয়েছেন।
“উনি তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন না। তাহলে কীসের যোগ্যতায়? উনি তো মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে বেরিয়ে এসে বলেননি। উনি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বলেছেন। তাহলে এই দায় কেন আওয়ামী লীগকে দেব না?”
জাতীয় নির্বাচনের পথনকশা চেয়ে ১৬ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বিএনপি নেতারা বলেছেন তারা একেবারেই ‘সন্তুষ্ট’ নন।
জাতীয় নির্বাচনের পথনকশা চেয়ে ১৬ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বিএনপি নেতারা বলেছেন তারা একেবারেই ‘সন্তুষ্ট’ নন।
নির্বাচনের সঙ্গে সংস্কারের ‘সম্পর্ক নেই’
সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির অবস্থানের বিরোধিতা করে বিএনপির তরফে এ দুটি বিষয়টি মুখোমুখি দাঁড় করানোর অভিযোগ ওঠে।
তবে এ দুটি বিষয়ের মধ্যে সম্পর্কের জায়গাটি স্পষ্ট করে আলী রীয়াজ বলেন, অনেকেই নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংস্কারকে গুলিয়ে ফেলছেন।
“একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে, সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলে প্রশাসনকে ওইরকম জায়গায় নিতে হবে। তার সক্ষমতাটা তৈরি করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ওই জায়গায় নিতে হবে। তাই না? তার কিছু সংস্কার না করে সে জায়গায় যাবে না। প্রশাসন কিছু সংস্কার না করে সেখানে যাবে না। তার অর্থ বলছি না যে সব করে তারপরে নির্বাচনে যেতে হবে।
“এরকম নয় যে এক দুই তিন চারটা হইলে নির্বাচন করা যাবে। পাঁচ নম্বর হলে এইটা হবে, ছয় নম্বর হলে ওটা হবে।”
রাজনৈতিক দল ও অন্তর্বর্তী সরকার সবাই মিলিয়ে যখন বুঝতে পারবে নির্বাচন করলে জনমতের প্রতিফলন ঘটবে, নাগরিকরা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন তখন নির্বাচন করবে। আর এগুলো যে করতে হবে সেটি জোর দিয়েই বলেন তিনি।
তবে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংস্কারকে এভাবে গুলিয়ে ফেলায় তার আপত্তির কথাও বলেছেন আলী রীয়াজ।
তিনি বলেন, “সংস্কারের প্রক্রিয়ার কিছু অংশ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট। কিন্তু এটা না হলে নির্বাচন হবে না বা সংস্কারের জন্য নির্বাচন ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে বা নির্বাচনের জন্য সংস্কার শেষ করতে হবে। এভাবে জড়িয়ে ফেলার দরকার নেই।”
‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার কীভাবে, দলগুলো বলুক’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে ২০০৬ সাল থেকে অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি, পরবর্তী সময় সংবিধান সংশোধন করে এই ব্যবস্থা বাতিলের প্রসঙ্গও এসেছে আলী রীয়াজের আলোচনায়।
সংবিধান সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়ে যে প্রস্তাব দিয়েছে সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও কীভাবে এ সরকার করা যায় তার ভার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি।
তিনি বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার। এ বিষয়ে সবাই একমত, কারো কোনোরকম দ্বিমত নেই। কারো কোনো দ্বিমত নেই, তত্ত্বাবধায়ক সরকার লাগবে। তাহলে বলুন যে তত্ত্বাবধক সরকার আমরা কীভাবে করতে পারি?”
‘সংসদের চার বছর মেয়াদ নিয়ে আপত্তি দলগুলোর’
সংবিধান সংস্কার কমিশন একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করেছে। একটি নিম্নকক্ষ (জাতীয় সংসদ) এবং একটি উচ্চকক্ষ (সিনেট)। উভয় কক্ষের মেয়াদ হবে চার বছর।
বর্তমানে সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর।
আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা প্রস্তাব করেছিলাম যাতে করে সময়ের স্বল্পতার কারণে (কর্তৃত্বাদী) প্রবণতাটাকে যদি কোনো না কোনোভাবে একটু সীমিত করে দেওয়া যায়। বলতে পারি, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল আপত্তি করেছেন।”
সংসদের মেয়াদ চার বছর হলে তাতে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোনোরকম বাধা হবে না বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, “ইতিহাস বিবেচনায় আমরা দেখেছি যে রাজনৈতিক দল যারা ক্ষমতায় যান তাদের আসলে শেষ বছরে এসে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা তৈরি হয় এবং প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়ে নিজের মত করে নির্বাচন করার চেষ্টা হয়। আমরা আশা করছি এগুলি থাকবে না।”
তবে এই প্রস্তাবের বিষয়ে আপত্তির বিষয়টিও মাথায় রাখছেন ঐকমত্য কমিশনের সহপ্রধান।
আলী রীয়াজ বলেন, “জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কখনোই চাইছে না যে আমরা যা বলেছি সেটাই শেষ কথা। আমরা বলছি যে একটা প্রস্তাব থাকলো, অন্যরা যদি ভিন্ন বলেন তো ঠিক আছে সেটাও আমরা বিবেচনা করব। পাঁচ বছর থাকে তো থাকবে। আর যদি সকলে বলেন অধিকাংশ দল প্রধান দলগুলো বলে চার বছর। ঠিক আছে, চার বছর হবে।”
একই ব্যক্তি দুটো পদে নয় যে কারণে
প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না, এমন সুপারিশ এসেছে সংস্কার কমিশনের কাছ থেকে।
বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতি চালু থাকার উদাহরণ টেনে আলী রীয়াজ বলেন, “আমাদের যুক্তিটা হচ্ছে এই সংসদ নেতা ক্ষমতাসীন দল থেকে আসেন। কিন্তু তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন আইনসভাকে। প্রধানমন্ত্রী যদিও তিনি আইনসভার অংশ কিন্তু তিনি নির্বাহী।”
‘ওয়েস্টমিনস্টার’ ব্যবস্থার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সংসদের দায়িত্বটা হচ্ছে নির্বাহীর উপর নজরদারি করা। তাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করা। তাকে জবাবদিহিতার জায়গায় নেওয়া।
“একই ব্যক্তি যদি দুটোই হন তাহলে হবে কি করে? সেই বিবেচনা থেকে আমরা বলেছি এটা।”
‘এনসিসির লক্ষ্য ক্ষমতার এককেন্দ্রিকতা রোধ’
নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি, জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ-এনসিসি, প্রধানমন্ত্রী ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিভিন্ন রূপরেখা প্রস্তাব করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্নকক্ষের স্পিকার, উচ্চকক্ষের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার এবং প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকে উভয়কক্ষের কোনো একজন সংসদ সদস্যকে নিয়ে এনসিসি হবে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতা ভারসাম্যের জন্য বলিনি। আমাদের বিবেচনাটা হচ্ছে নির্বাহী বিভাগে যাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ না হয়, সেজন্য একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তৈরি করা।”
তার মতে, দ্বাদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির ‘সমস্ত ক্ষমতা’ প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ‘অভাবনীয় ক্ষমতাশালী’ করে ফেলা হয়েছে।
“প্রশ্ন হচ্ছে যে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আপনাকে কাঠামো তৈরি করতে হবে। আমরা এনসিসির যে প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম সেটার বিবেচনার বিষয়টা হচ্ছে, রাষ্ট্রের প্রশ্নে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে যেন ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল ও বিচার বিভাগের এক জায়গায় বসার একটা জায়গা হয়।”
News Courtesy: