বাংলাদেশে নতুন ইসলামপন্থী জনপরিমণ্ডল
সারসংক্ষেপ
বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবেই শক্তিশালী, গতিশীল এবং দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত একটি জনপরিমণ্ডলব্যবস্থা বা পাবলিক স্ফেয়ার উপস্থিত থেকেছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ এবং জনমানস সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ধারণাকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশে এই জনপরিমণ্ডলব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এ যাবত্ জনপরিমণ্ডলব্যবস্থার ধারণার ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ যৌক্তিকতা বা ধর্মীয় উদারনৈতিকতা। কিন্তু এখন একটি ইসলামি বা ইসলামপন্থী জনপরিমণ্ডলব্যবস্থা তৈরির প্রক্রিয়া বাংলাদেশে ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। এই নিবন্ধে এই ধরনের চেষ্টার দুটি উদাহরণের ওপরে আলোকপাত করা হয়েছে, যেগুলো জনপরিমণ্ডলের ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এগুলো হচ্ছে ইসলামি ফিকশন লেখা ও প্রকাশ এবং নারীদের মধ্যে ইসলামসম্পর্কিত পাঠচক্র প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, বহুত্ববাদিতার সম্ভাবনার বদলে ইসলামি জনপরিমণ্ডলব্যবস্থায় ইসলামের একটি ব্যাখ্যাই গৃহীত হচ্ছে, সেখানে প্রথাগত মূল্যবোধ ও চিন্তাধারা বিভিন্ন ইসলামপন্থী চিন্তাবিদের মতবাদ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। তদুপরি বিকাশমান ইসলামপন্থী জনপরিমণ্ডল এটা এখনো দেখাতে পারেনি যে এটি বাংলাদেশি সমাজের ইসলামি ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত। ইসলাম পন্থার বৈশ্বিক প্রবণতা এসব প্রচেষ্টার অনুপ্রেরণা বলেই মনে হয়।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ: জনপরিমণ্ডল, জনবলয়, বিরোধী বলয়, শরিয়া, ইসলামি ফিকশন, হালাকা, পাঠচক্র।
সূচনা
বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবেই শক্তিশালী, গতিশীল এবং দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত একটি জনপরিমণ্ডলব্যবস্থা বা পাবলিক স্ফেয়ার উপস্থিত থেকেছে। অন্য কথায় বললে, বাংলাদেশের জনজীবনে একটি যুক্তিনির্ভর এবং সমালোচনামূলক ভাব বিনিময়ের ব্যবস্থা দুর্লভ কোনো বিষয় নয়, কোনো বহিরাগত বিষয়ও নয়। বরং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ এবং জনমানস সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ধারণাকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশে এই জনপরিমণ্ডলব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। আর এই ব্যবস্থার মধ্যে সব সময়ই প্রতিদ্বন্দ্বী কিছু অসম কণ্ঠস্বরের উপস্থিতি ছিল। এক বিবেচনায় জনপরিমণ্ডলব্যবস্থার ধারণার ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ যৌক্তিকতা বা ধর্মীয় উদারনৈতিকতা।১ এসব ধারণার প্রতিনিধিত্বকারী কণ্ঠস্বরগুলো জনপরিমণ্ডলের আলোচনায় বা বিতর্কে, এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত, ধর্মীয় উপাদান যুক্ত করতে আগ্রহী ছিল না।
কিন্তু এখন পরিস্থিতির বদল ঘটছে। দেশের ভেতরে ইসলামপন্থী রাজনীতির ক্রমবর্ধমান শক্তি২ এবং বৈশ্বিকভাবে বিকাশমান প্রবণতার কারণে একটি ইসলামি বা ইসলামপন্থী জনপরিমণ্ডলব্যবস্থা তৈরির প্রক্রিয়া বাংলাদেশে ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। ইসলামি জনপরিমণ্ডল বলতে আমি যা বোঝাতে চাচ্ছি তা হচ্ছে, বিতর্ক এবং আলোচনার এমন একটি স্পেস তৈরি করা, যা ইসলামি গ্রন্থ এবং ইসলামি ধ্যানধারণা দিয়ে প্রভাবিত, যা দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রক্রিয়ায় ইসলামকে সামনে নিয়ে আসে এবং বর্তমান জনপরিমণ্ডলব্যবস্থার বিপরীতে ভিন্নধর্মী প্রভাববলয় সৃষ্টির প্রয়াসী। এই নিবন্ধে আমি এ ধরনের চেষ্টার দুটি উদাহরণের ওপরে আলোকপাত করব যেগুলো জনপরিমণ্ডলের ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এগুলো হচ্ছে প্রথমত, ইসলামি ফিকশন লেখা ও প্রকাশ, দ্বিতীয়ত, নারীদের মধ্যে ইসলামসম্পর্কিত পাঠচক্র প্রতিষ্ঠা। এসবের পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় বাংলাদেশের সমকালীন সমাজে ইসলামকে সামনে নিয়ে আসছে; সমাজে ও রাজনীতিতে ইসলামের সহজে দৃষ্টিগ্রাহ্য উপস্থিতি থেকে এই প্রচেষ্টাগুলো যেমন লাভবান হচ্ছে, তেমনি এগুলোও ইসলামকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তোলার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে।
জনপরিমণ্ডল এবং কাউন্টার পাবলিক (বিরোধী পরিমণ্ডল)
জনপরিমণ্ডলের ধারণা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক রয়েছে—এ কথা বিবেচনায় রেখেই এ প্রবন্ধে আমি জনপরিমণ্ডল ধারণাটিকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছি: পরিবার এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রভাববলয়ের বাইরে স্বাধীন সামাজিক তত্পরতার ক্ষেত্রকে আমি জনপরিমণ্ডল বলে বিবেচনা করেছি। জারগেন হেবারমাস জনপরিমণ্ডল ধারণাটির সূচনার বা প্রবর্তনের ব্যাপারে কৃতিত্বের অধিকারী।৩ তাঁর ধারণাটির সুনির্দিষ্ট প্রয়োগ বিষয়টি বোঝার ক্ষেত্রে আমাকে অনেকাংশে সাহায্য করেছে এবং এই প্রবন্ধে এই ধারণার ব্যবহার সেই প্রায়োগিক বিবেচনা দিয়ে প্রভাবিত। সেই সঙ্গে ধারণাটির সীমাবদ্ধতাকেও মেনে নেওয়া দরকার। এ ব্যাপারে আমার চিন্তা মিরিয়াম হেক্সটার৪ এবং রজার কার্টিয়ারের চিন্তা ও ব্যাখ্যার মোটামুটি কাছাকাছি। কার্টিয়ার জনবলয় বলতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত আলোচনা-সমালোচনা এবং ভাববিনিময়ের একটি ক্ষেত্রকে’ বুঝিয়েছেন।৫
জনপরিমণ্ডলকে এত ব্যাপকভাবে সংজ্ঞায়িত করার পরও বিষয়টি আরেকটু বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তাকে অগ্রাহ্য করা যায় না। হেবারমাসের ধারণা দ্বারা প্রভাবিত জনপরিমণ্ডলের এ ধরনের সংজ্ঞায়নের সঙ্গে অনেককেই দ্বিমত করতে দেখা যায়। যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট (অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের জার্মানি) বিবেচনায় নিয়ে তিনি তাঁর জনপরিমণ্ডল ধারণার সূচনা ঘটিয়েছেন তাতে কিছু উপাদানের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী কিংবা সম্পত্তির মালিক নন এমন গোষ্ঠীগুলো হেবারমাসের কথিত জনপরিমণ্ডলে স্থান পায়নি, যার ফলে এ শ্রেণিগুলোর মানুষেরা সমাজের প্রচলিত বিষয়ের আলোচনায় কিংবা ‘সমাজের সকলের জন্য ভালো’ বলে যা বিবেচিত সেই আলোচনায় স্থান করে নিতে পারেনি।৬ এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য যা দরকার তাকে ন্যান্সি ফ্রেজারের ভাষায় বলা যায়, ‘সমালোচনামূলক জিজ্ঞাসা (ক্রিটিক্যাল ইন্টারগেশন) এবং বিনির্মাণ’। এই চেষ্টা আমরা দেখতে পেয়েছি গত এক দশকে। বিরাজমান সমস্যার স্বীকৃতি হিসেবে এবং সেই সীমাবদ্ধতা অতিক্রমণের জন্য এখন সমাজে একাধিক জনপরিমণ্ডলের উপস্থিতির কথা বলা হয়ে থাকে।৭ এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, যেকোনো সময় এবং যেকোনো সংস্কৃতিতে জনপরিমণ্ডলব্যবস্থাকে বোঝার ক্ষেত্রে সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার মধ্যকার সম্পর্কটি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা জনপরিমণ্ডলে সমাজের সবার জন্য কোনটি ভালো (ইংরেজিতে যাকে বলে কমন গুড) সে প্রশ্নে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী, প্রবণতা এবং আন্দোলনের মধ্যে শুধু আন্তবিনিময়ই ঘটে তা নয়; বরং সমাজের জন্য ভালো বলতে কী বোঝানো হবে সেই প্রশ্নে এঁদের মধ্যে মধ্যস্থতা, বিরোধিতা, সংঘাত এবং একধরনের প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করতে চাই যে এই সংঘাত ও সহযোগিতা কোনটি প্রকৃতপক্ষে ভালো সেই বিষয়ে নয়, তার চেয়ে বরং ‘সকলের ভালো’ বলতে কী বোঝানো হবে সেই বিষয়ে। কমন গুডের সংজ্ঞা কে দিচ্ছে. সেটিই হলো মূল বিবেচ্য বিষয়। আইসেনস্ট্যাড বিষয়টিকে বলেছেন ‘ফ্রেমিং’ (সাজানো) বা ‘শ্রেণীকরণ’।৮ এ ক্ষেত্রে আমরা মিশেল ফুকোর ধারণার সাহায্য নিলে বলতে পারি যে, যেকোনো ধরনের আলাপ-আলোচনায় একটা প্রচলিত রীতি উপস্থিত থাকে, আর ওই রীতি আসলে বিদ্যমান ক্ষমতা সম্পর্কেরই প্রকাশ।৯ ফলে ‘সকলের জন্য ভালো’ বিষয়ে যখন ভিন্ন ভিন্ন মতের সংঘাত হয় তখন এই সংঘাতের প্রকৃতি পূর্বনির্ধারিত থাকে না, বরং তা নির্ধারিত হয় অনেক বিষয় দিয়ে যার মধ্যে রয়েছে স্থান, কাল এবং সামাজিক মূল্যবোধগুলো।
আমার মতে, জনপরিমণ্ডল কোনো রাজনীতিশূন্য আলোচনার জায়গা নয়, একে রাজনৈতিক সক্রিয়তার বাইরেও রাখা সম্ভব নয়। বরং জনপরিমণ্ডলব্যবস্থা হচ্ছে বাস্তব জীবনের রাজনৈতিক সক্রিয়তা পুনরুত্পাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য ক্ষেত্র। এটি এমন একটি স্থান যেখানে বিস্তৃত পরিসরে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদর্শ বহনকারী মানুষ তাদের নিজ নিজ মতামত প্রকাশের সুযোগ পায় এবং একই সঙ্গে বিরোধী মতের সমালোচনা এবং নিজ মতবাদের সপক্ষে তাদের নিজস্ব যুক্তি তুলে ধরে।১০
আর তাই জনপরিমণ্ডল এবং রাজনীতির মধ্যে কেবল যে একটি নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান তা-ই নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই এ দুটি বিষয়কে পৃথক করা অসম্ভব। যেহেতু জনপরিমণ্ডল কার্যত ভিন্নভাবে (প্রত্যক্ষ মুখোমুখি নয় এই অর্থে) মতবিনিময়ের প্রকৃতি নির্ধারণ করে, গ্রহণ ও বর্জনের মানদণ্ড নির্ধারণ করে এবং ‘অন্য’কে (বা আদার) স্বীকৃতি প্রদান করে সেহেতু একে ব্যাপক অর্থে রাজনীতিরই একটি অঙ্গ হিসেবে বিবেচনার সুযোগ রয়েছে।১১
জনপরিমণ্ডলসম্পর্কিত এ আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি ‘বিরোধী পরিমণ্ডল’ (কাউন্টার পাবলিক) সম্পর্কিত বিষয়টি আমরা আলোচনা না করি। বিরোধী পরিমণ্ডলের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর মধ্য দিয়ে জনপরিমণ্ডলব্যবস্থার বিপরীতে একটি সমান্তরাল বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র তৈরি হয়। বিপরীতমুখী মনে হলেও এ দুটি সমান্তরাল আলোচনার ধারার মাঝে একটি আন্তসম্পর্ক লক্ষ করা যায়। অন্য কথায়:
বিরোধী জনপরিমণ্ডল হলো জনপরিমণ্ডলেরই একটি অংশ, যাকে এ ব্যবস্থার বহুমাত্রিকতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। একটি সমন্বিত জনপরিমণ্ডলবিরোধী জনপরিমণ্ডলের উপস্থিতি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের ভিন্নধর্মী ক্ষমতার সম্পর্ককে নির্দেশ করে। যেসব মানুষ জনপরিমণ্ডলব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়, তাদের জন্য এ ব্যবস্থা একটি সুস্পষ্ট বিকল্প হিসেবে কাজ করে।১২
বিরোধী জনপরিমণ্ডলের দুই ধরনের ভূমিকা দেখতে পাওয়া যায়। এক. আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে আত্মপরিচয় গঠন এবং প্রচলিত জনপরিমণ্ডব্যবস্থার প্রভাব থেকে নিজস্ব স্বকীয়তা রক্ষার একটি জায়গা তৈরি করে নেওয়া। দুই. বৃহত্তর জনপরিমণ্ডলব্যবস্থায় সক্রিয়তার জন্য প্রশিক্ষণ এবং প্রতিরোধের একটি ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করা।১৩
ইসলামপন্থীদের কাছ থেকে ইসলামি জনপরিমণ্ডলের যে চিত্র আমরা পাই, তাতে যে মূলধারার বিপরীতে একটি বিপরীতমুখী ধারা সৃষ্টি ও তার প্রচলনের চেষ্টাই কেবল নিহিত থাকে তা নয়, বরং হারসকিন্ডের মতে, একটি ধর্মীয় অনুভূতি ও ধর্মীয় আবেগভিত্তিক একটি নৈতিক ক্ষেত্র বা স্পেস রচনা করে।১৪ মুসলিম সমাজে জনপরিমণ্ডলব্যবস্থা কী ধরনের ভূমিকা পালন করেছে, সেটা বোঝার জন্য ইসলামি সমাজব্যবস্থার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকানো দরকার। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় খুব সহজেই উঠে আসে। প্রথমত, সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে পার্থক্য সত্ত্বেও ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ইসলামি জনপরিমণ্ডল (বা জনপরিমণ্ডলগুলো) ইসলামি ধ্যানধারণা ও ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল।১৫
দ্বিতীয়ত, উলামা বা ইসলামি চিন্তাবিদ, শরিয়া বা ইসলামি আইন, সমাজের বিভিন্ন স্তরের জনগণ এবং শাসকগোষ্ঠীর পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এ ধরনের ইসলামি জনপরিমণ্ডলব্যবস্থা সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করত। তাঁদের এই পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া ঘটত যে কাঠামোর অধীনে তা হলো শরিয়া, যা হচ্ছে নৈতিক এবং ধর্মীয় চিন্তার নিয়ন্ত্রক, মুসলিম সমাজের ঐক্যের এবং সমাজের ভালো-মন্দ নির্ধারণের মানদণ্ড।১৬
যদিও অনেকেই এই কথা স্বীকার করতে চান না তথাপি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে দেখা যায় যে ইসলামি সমাজব্যবস্থায় প্রাণবান জনপরিমণ্ডলব্যবস্থা উপস্থিত ছিল, তবে এটাও দেখা যায় যে ওই জনপরিমণ্ডল ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং তার সীমারেখা নির্ধারিত ছিল ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা।
বাংলাদেশে একটি নতুন জনপরিমণ্ডল সৃষ্টির প্রচেষ্টা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। আমি মনে করি, এই নতুন বা বিকাশমান জনপরিমণ্ডলব্যবস্থা কোনো পূর্বনির্ধারিত, অনিবার্য বিষয় নয়; বরং একে একটি সচেতন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেখাই যুক্তিযুক্ত। একটি নতুন জনপরিমণ্ডল সৃষ্টির প্রক্রিয়া কখনোই সহজসাধ্য কোনো বিষয় ছিল না এবং বর্তমানেও তা একটি কঠিন প্রক্রিয়ার অংশবিশেষ। অনেকগুলো বিষয় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। সমাজের নতুন ধ্যানধারণা গ্রহণ করার প্রবণতা, নতুন সৃষ্ট ধারণা বোঝার সক্ষমতা এবং প্রতিদিনকার জীবনযাত্রায় সেসবের প্রতিফলন ঘটানো—এমন বিভিন্ন বিষয় এ প্রক্রিয়াকে সুগঠিত রূপদানের ক্ষেত্রে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম সহজে দৃষ্টিগ্রাহ্য ইসলামপন্থী জনপরিমণ্ডল তৈরির কাজে সহায়তা করছে। এসব কাজ এই অর্থে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র যে সেগুলো কোনো একটি একক উত্স থেকে পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে না, কিন্তু তা সত্ত্বেও এগুলো একটি ব্যাপক প্রচেষ্টার অংশ এই অর্থে যে তারা একই ধরনের অভীষ্ট অর্জন করতে চাইছে।
ইসলামপন্থী উপন্যাস (ফিকশন): ধর্মানুভূতি এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম
হেবারমাসের মতে, দুই ধরনের জনপরিমণ্ডলব্যবস্থা রয়েছে। একটি সাহিত্যিক এবং অপরটি রাজনৈতিক। তিনি মনে করেন, পত্রলিখনের মধ্য দিয়ে যা সাহিত্যিক ধারার সূচনা হয়, তা কালপরিক্রমায় উপন্যাসের সূচনা করে এবং এর মাধ্যমে সাহিত্যিক জনপরিমণ্ডল ধারণারও সূচনা হয়। তাঁর মতে, ব্যক্তিমানসের সঙ্গে সাহিত্যের যে সম্পর্ক, তা উপন্যাসের মধ্য দিয়ে পুনর্জন্ম লাভ করে। মূলত আঠারো শতকের ইউরোপীয় উপন্যাসের মধ্য দিয়ে এ সম্পর্কের উত্থান, যাকে পরবর্তীকালে ‘মানব অস্তিত্ব বিকাশের নিরাপদ আশ্রয়স্থল’১৭ হিসেবে অভিহিত করা হতো। তার মানে হলো উপন্যাসের মতো আপাতনির্দোষ সাহিত্যিক ধারা জনপরিমণ্ডলব্যবস্থা গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে এবং রেখে চলেছে।
বুর্জোয়া জনপরিমণ্ডলব্যবস্থার বিকাশে উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বর্তমানেও নতুন জনপরিমণ্ডলব্যবস্থা বিকাশের ক্ষেত্রে কিংবা প্রতিষ্ঠিত জনপরিমণ্ডলব্যবস্থার বিপরীতে ভিন্ন কোনো জনপরিমণ্ডল সৃষ্টির সক্ষমতা উপন্যাসের রয়েছে। আর তাই বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপটে জনপরিমণ্ডলব্যবস্থা সৃষ্টি বা পুনর্গঠনের পেছনে উপন্যাসের ভূমিকা নানাভাবে আলোচনায় আসে। এ বিষয়ে সিংহলা ভাষায় রচিত উপন্যাস বিষয়ে ভিমল দেশানায়েকের এবং আফ্রিকান উপন্যাস বিষয়ে এম এস সি ওকোলোর গবেষণা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।১৮
‘সেক্যুলার’ ধারণা দ্বারা প্রভাবিত বিদ্যমান জনপরিমণ্ডলব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপনের লক্ষ্যে ইসলামপন্থীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক পণ্য তৈরি করা হচ্ছে, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে উপন্যাস বা ফিকশন, বিশেষ করে রোমান্স এবং থ্রিলার।১৯ গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফিকশন প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলোকে আমরা ইসলামি ফিকশন বলে চিহ্নিত করতে পারি।২০ এ ধরনের লেখকের সংখ্যা খুব কম এবং প্রচলিত সেক্যুলার ঘরানার তুলনায় এগুলোর পাঠকসংখ্যা এখনো কম, তবে এ ধরনের উপন্যাসের পাঠক ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।২১ এ ধরনের উপন্যাসের পাঠক কারা, সে সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য বা উপাত্ত পাওয়া দুর্লভ। তবে মায়মুনা হকের মতে, ‘সমাজের উচ্চবিত্ত অংশ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী অংশ এবং ক্ষুদ্র বা বড় ব্যবসায়ীদের অনেকেই এ ধরনের ইসলামি ফিকশনের পাঠক।’২২
এ ধরনের ইসলামি ফিকশন রচনার মূল কারণ হলো সেক্যুলার লেখকদের, যাঁদের ইসলামপন্থীরা মনে করেন অধঃপতিত, লেখার প্রভাবকে স্তিমিত করা। হক সঠিকভাবেই বলেছেন, ‘আকর্ষণীয় প্রচ্ছদে শোভিত রোমান্স উপন্যাস ছিল সেক্যুলার সাহিত্যের এক শক্তিশালী ভিত্তি, যাকে এই এক দশক আগেও ইসলামপন্থীরা গ্রহণযোগ্য বিশেষত ইসলামীকরণের জন্য যথাযথ বলে কল্পনাও করতে পারত না।’২৩ কিন্তু এখন এই মত ধীরে ধীরে, কিন্তু অবিচলিতভাবেই, পরিবর্তিত হচ্ছে এবং ‘কিছু ইসলামি প্রকাশক মনে করেন যে অদূর ভবিষ্যতে উপন্যাস ইসলামি সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারা হয়ে উঠবে।’২৪ এই ধারায় প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা দীর্ঘ হওয়া এই আশাবাদকে সমর্থন করে।
বাংলাদেশে ইসলামি সাহিত্যের সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই।২৫ সেটি অন্যত্রও আমরা লক্ষ করে থাকি। বাংলাদেশের বাইরের একটি পুস্তক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, যেটি মূলত ইংরেজি ভাষার ইসলামি ফিকশন বিক্রয় করে থাকে, যার নাম হচ্ছে ‘ইসলামিক ফিকশন বুকস’, তাদের মতে:
সৃজনশীল, কল্পনানির্ভর ফিকশন বই যা মুসলমান সাহিত্যিক দ্বারা রচিত এবং মুসলমান পাঠকদের মধ্যে বিক্রির উদ্দেশ্যে বিপণন করা হয়, তাই ইসলামি ফিকশন। এসব ফিকশনের কাহিনি খানিকটা ধর্মীয় উপাদান বা ধর্মীয় বিষয়বস্তুকে অন্তর্ভুক্ত করে রচিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে এসব বইয়ে ফিকশনবহির্ভূত ঐতিহাসিক বা সত্য ধর্মীয় প্রেক্ষাপট বা ধর্মীয় বিষয়বস্তু উপস্থিত থাকে। এগুলো কখনো কোরআন ও হাদিস থেকে সরাসরি উদ্ধৃত করে এবং কিছু ক্ষেত্রে তা ব্যতিরেকেই ঘটনা বর্ণিত হয়। এসব কাহিনিতে আধুনিক বাস্তব জীবন, নৈতিকতার সংকটও তুলে ধরা হয়।২৬
এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা দরকার যে এই ধরনের উপন্যাসের শুভানুধ্যায়ীরা ‘সেক্যুলার উপন্যাসের’ সঙ্গে সুস্পষ্ট পার্থক্য তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়। পূর্বোক্ত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে এর ব্যাখ্যা মেলে এভাবে—
মুসলিম লেখকদের যেসব ফিকশন ইসলামি ফিকশনের মানদণ্ড বজায় রাখতে অক্ষম সেগুলোই সেক্যুলার ফিকশন। এসব সেক্যুলার ফিকশনে মুসলিম চরিত্র থাকলেও কাহিনির কেন্দ্রবিন্দু ইসলাম নয় এবং চরিত্রগুলোর কর্মকাণ্ড ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। সেক্যুলার ফিকশনে ইসলাম ধর্মের বিষয় নেই এবং এগুলো লেখা হয় সেক্যুলার বাজারের ভোক্তাদের কাছে আবেদন তৈরির জন্য।
বাংলাদেশের ইসলামি সাহিত্যের প্রকাশ ও রচয়িতাদের মধ্যেও এ ধরনের মনোভাব দেখতে পাওয়া যায়।
নব্বইয়ের দশকে যখন ইসলামপন্থীরা সামাজিক ও রাজনৈতিক জগতে লক্ষণীয় হয়ে উঠল তখনই ইসলামি ফিকশনের এই ঘরানার সূচনা হয়। এটি তাঁদের পূর্বসূরিদের থেকে ভিন্ন এক প্রচেষ্টা, তাঁদের পূর্বসূরিরা চেষ্টা করেছেন প্রচারণামূলক সাহিত্য এবং জীবনযাপনের পদ্ধতিবিষয়ক বইপত্রের মধ্য দিয়ে তাঁদের বক্তব্যকে পৌঁছে দিতে। কিন্তু তরুণ ইসলামপন্থীরা চান, তাঁদের সমসাময়িকদের কাছে পৌঁছাতে, তাঁরা চান তাঁদের কল্পনার কাছে আবেদন করতে। ফিকশনের যে একটি আবেগপূর্ণ গুরুত্ব রয়েছে, সেটা সবাই স্বীকার করেন:
ফিকশন এমনভাবে মানব হূদয় এবং আবেগকে স্পর্শ করে যা নন-ফিকশন, এমনকি সত্য জীবন কাহিনিও করতে পারে না। এটি আমাদের আবেগাপ্লুত করে, আমাদের কল্পনাকে ধারণ করতে পারে, এবং আমাদের নিজের সম্পর্কে ও আমাদের বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বিবেচনাগুলোকে সত্যায়ন করে। এটি আমাদের জীবনের অনেক বিষয়কে মোকাবিলা করার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু তার জন্য আমাদের কোনো রকম ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয় না। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অন্য সংস্কৃতিকে দেখার একটি সুযোগ এর মধ্য দিয়ে তৈরি হয়। ফিকশন কখনো কাঁদায়, কখনো হাসায়, কখনো আমাদের ভেতরে তৈরি করে কম্পনের অনুভূতি, কখনো আমাদের আনন্দে ভাসিয়ে দেয়। মোট কথা, আবেগের দ্বার খুলে দিয়ে আমাদের উত্তেজনা ও চাপ থেকে মুক্তি দেয়। এ জন্যই গল্প বলার বিষয়টি প্রতিটি সংস্কৃতিরই একটি অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ।২৭
জনপরিমণ্ডল সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় ইসলামপন্থীদের রোমান্স ও থ্রিলারকে বেছে নেওয়ার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। এর লক্ষ্য হচ্ছে পাঠকদের উত্সাহী করা, যেন তাঁরা ইসলামি চেতনার আয়নায় নিজেদের এবং অন্যদের জীবনকে কল্পনা করতে পারেন।২৮ অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে একটিমাত্র টেক্সট বা একটি ঘরানাই জনসাধারণকে উত্সাহিত করতে সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে; কেননা:
একটি লেখা [বা একটি টেক্সট] কখনো জনপরিমণ্ডল সৃষ্টি করে না। এমনকি একটি কণ্ঠস্বর, একটি ঘরানা কিংবা একটি নির্দিষ্ট মাধ্যমকে দিয়েও এ উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। সবগুলো মিলেও একটি কার্যকারণ সূত্র তৈরি করতে পারে না, যাকে আমরা জনপরিসর বলে বর্ণনা করতে পারি; কেননা জনপরিসর বললে বুঝতে হবে বিভিন্ন মতের মধ্যে নিরন্তরভাবে বিনিময়ের একটি জায়গাকে। আর তাই একটি লেখা বিচ্ছিন্নভাবে জনপরিসর সৃষ্টিতে অল্পই ভূমিকা রাখে। বরং একই ধরনের লেখা সমন্বিতভাবে জনপরিমণ্ডল গঠনপ্রক্রিয়ায় অংশ নেয়।২৯
আমাদের আলোচনার জন্য তাই এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে বিভিন্ন ধরনের ফিকশন যেমন উপন্যাস, থ্রিলার এবং ইতিমধ্যে জনপ্রিয় জীবনযাপনবিষয়ক পুস্তক মিলে সমন্বিতভাবে একটি টেক্সট তৈরি হচ্ছে। ইসলামি সাহিত্য কেবল যে এ ঘরানার লেখকদের সৃষ্টিশীলতার বহিঃপ্রকাশ তা নয়, বরং এসব লেখার উদ্দেশ্য ইসলামপন্থী রাজনীতির বার্তাকে ছড়িয়ে দেওয়াও। ইসলামি ফিকশন সম্পর্কে পামেলা টেলরের বক্তব্যে বিষয়টিকে আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায়:
ফিকশন ‘দাওয়া’র [ইসলামের পথে আসার আমন্ত্রণ] জন্য একটি শক্তিশালী উপকরণ হতে পারে। যদিও গল্পগুলো সত্য নয়, তবু ফিকশনের বিষয় প্রকৃত ঘটনা, প্রকৃত আবেগ আর পাঠকেরা এসব চরিত্রের সঙ্গে এমনভাবে নিজেদের সংশ্লিষ্ট ভাবে যেন এই চরিত্রগুলো তাঁদের নিজেদের পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধব। এভাবে ব্যক্তির অনুভূতি, চিন্তা ও বিশ্বাসের ওপরে ফিকশন নন-ফিকশনের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব ফেলতে পারে। এগুলো তাঁদের নিজেদের মূল্যবোধ এবং অভ্যাসের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলতে উদ্দীপিত করতে পারে, যা মুসলিম ও অমুসলিম উভয়ের ক্ষেত্রেই ইতিবাচক পরিবর্তনের পথ সুগম করে।...তাই জীবনকে বদলে দেওয়ার সক্ষমতা ফিকশনের রয়েছে।৩০
আপাতদৃষ্টিতে ইসলামি ঘরানার উপন্যাসগুলোর কাহিনি সেক্যুলার ফিকশন থেকে ভিন্ন কিছু মনে হবে না। প্রেম, বিরহ, আশা, নিরাশা—এই ধারণাগুলোই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। উদাহরণ হিসেবে আমরা কাসেম আবু বকর, আবদুস সালাম মিতুল ও মোশাররফ হোসেনের ফিকশনগুলো উল্লেখ করতে পারি। আবু বকর ও সালাম মিতুলের দুটি জনপ্রিয় উপন্যাস হচ্ছে প্রতীক্ষা (১৯৯৪) এবং গোলাপের কাঁটা (১৯৯২)। এ দুটো উপন্যাসেই তরুণদের সামাজিক জীবনকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, কিন্তু সেগুলোতে প্রত্যক্ষভাবেই লেখকদের বিবেচনায় যা অনৈতিক মেলামেশা তাকে নিরুত্সাহিত করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে এসব উপন্যাসে রয়েছে ইসলামি নৈতিকতার শিক্ষা। অনৈতিক কার্যকলাপের খারাপ দিকগুলো তুলে ধরে এসব উপন্যাস: বিপরীতক্রমে, ইসলামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নৈতিক শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করার প্রয়াস এসব উপন্যাসের মধ্যে সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য। চরিত্রগুলো কোনো রাজনৈতিক কর্মী নয়, আর তাই কোনো আদর্শিক ঝান্ডা তুলে ধরা তাদের কাজ নয়, তার পরও তাদের জীবনপদ্ধতি ইসলামি জীবনযাপনের ইতিবাচক দিকগুলোর পরিচায়ক।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এ ধরনের ফিকশনে অমার্জিত ভাষা, দৃশ্যমান যৌন সম্পর্ক কিংবা অনৈসলামিক বলে বিবেচিত আচরণসমূহ এবং ইসলামের নেতিবাচক উপস্থাপনা সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। মায়মুনা হক যেমনটি উল্লেখ করেছেন, এসব লেখকের মধ্যে মোশাররফ হোসেন সাগরের উপন্যাসে রাজনৈতিক ইসলামের উপস্থিতি স্পষ্ট। যেমন অবুঝ হূদয়।৩১ উপন্যাসটিতে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে উপন্যাসের নায়ক একজন সাধারণ মানুষ থেকে সক্রিয় ইসলামি রাজনৈতিক কর্মীতে পরিণত হয় এবং ‘ইসলামি মুক্তি সংঘ’ নামক সংগঠনের এক স্তর থেকে অন্য স্তরে নিজের অবস্থানকে সংহত করে।৩২
ইসলামি রোমান্টিক উপন্যাসগুলো এখনো জনপ্রিয়তা অর্জনের পথে রয়েছে কিন্তু ইসলামি থ্রিলারগুলো ইতিমধ্যে জনপ্রিয়তার বিচারে অনেকটাই এগিয়ে আছে।৩৩ ইসলামি থ্রিলারের অন্যতম জনপ্রিয় লেখকদের মধ্যে আছেন আবুল আসাদ, আসাদ বিন হাফিজ, তৌহিদুল ইসলাম বাবু এবং হাশেম রনি। বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত এসব থ্রিলারের চারটি সিরিজ ইতিমধ্যে পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। এসব সিরিজ হলো সাইমুম, ক্রুসেড, অপারেশন এবং স্পাই। এর মধ্যে সাইমুম সবচেয়ে পুরোনো সিরিজ। আবুল আসাদ রচিত এবং বাংলা সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত সাইমুম সিরিজের ইতিমধ্যেই (২০০৭ সাল পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী) ৪৪টি বই প্রকাশিত হয়েছে। লেখক আবুল আসাদ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের একজন সদস্য এবং জামায়াতের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত দৈনিক সংগ্রাম-এর সম্পাদক। সেই সঙ্গে তিনি বাংলা সাহিত্য পরিষদেরও সভাপতি। একটি ইসলামি ওয়েবসাইটের তথ্যমতে,
আবুল আসাদ সাইমুম সিরিজের থ্রিলারের জন্য অনেক বেশি পরিচিত এবং প্রশংসিত। এ সিরিজের বইগুলো বাংলাদেশের সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। লেখক বইগুলোর মধ্য দিয়ে ঐতিহ্য, আকাঙ্ক্ষা ও মতাদর্শকে এক সুতোয় বাঁধতে পেরেছেন। এর কাহিনিগুলো পাঠককে ইসলামের সেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগে অনুপ্রাণিত করে।৩৪
এ সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্র আহমেদ মুসা। মধ্য এশিয়ার মুসলিম পরিবার থেকে উঠে আসা এক বীর সেনানী। মুসা একপর্যায়ে কমিউনিস্টদের দ্বারা বিতাড়িত ও নির্যাতিত হন। পরবর্তীকালে তিনি ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ‘সাইমুম’ নামের একটি আন্তর্জাতিক ইসলামি বিপ্লবী সংগঠনের একজন নেতা। নিপীড়িত মুসলমানদের রক্ষায় তিনি পৃথিবীর দেশে দেশে ঘুরে তাদের হয়ে লড়াই করেন। যেমন এ সিরিজের অপারেশন তেল আবিব-১ এবং অপারেশন তেল আবিব-২-এ তাঁকে ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মুসলমানদের পক্ষ হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে দেখা যায়। সিরিজের ৪৩তম বইয়ে তাঁকে দক্ষিণ থাইল্যান্ডের সুলতানগড় নামক এলাকায় যুদ্ধ করতে দেখা যায়। সেখানে তিনি মুসলমানদের প্রতিনিধি শাহ পরিবারের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করেন। পাত্তানির সবুজ অরণ্য শিরোনামের এ বইয়ে অমুসলিমদের বিরুদ্ধে রাজকীয় এ পরিবারের সংগ্রামের চিত্র ফুটে উঠেছে। জনপ্রিয় মুসলিম রাজকীয় এ পরিবারকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে নানাভাবে নিপীড়িত ও নির্যাতন করছে ক্ষমতাসীন অমুসলিম শাসকগোষ্ঠী। তাঁর যোদ্ধারা মুসলিম সন্ত্রাসী হিসেবে অমুসলিমদের কাছে পরিচিত। মুসা আবিষ্কার করেন, মুসলিম ছদ্মবেশে যারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেই যোদ্ধারা যে সমরাস্ত্র ব্যবহার করে থাকে সেগুলো হিব্রু ভাষায় নামাঙ্কিত।৩৫
জনপ্রিয়তার বিচারে সাইমুমের পরেই আসে ক্রুসেড সিরিজের নাম। আসাদ বিন হাফিজ রচিত ‘ক্রুসেড’ শিরোনামে এ সিরিজের ৩০টি বই ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রীতি’, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এর সম্পৃক্তির কথা জানা যায়। এই সিরিজের কাহিনি ক্রুসেডের ইতিহাসিক চরিত্র সালাউদ্দিনের বীরত্ব, রোমান্টিক আখ্যান এবং ঘৃণার মধ্য দিয়ে ক্রুসেডের ‘ইতিহাস’ তুলে ধরা হয়। অপরদিকে অপারেশন সিরিজের থ্রিলারগুলোর পটভূমি ‘বিশ্বব্যাপী মুসলিম শক্তির পুনর্জাগরণ’ এবং ‘মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিশ্বব্যাপী ষড়যন্ত্র’। তবে এর মূল কাহিনি আবর্তিত হয়েছে চীনের প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে। লেখকের মতে, চীনের মুসলমানরা নিপীড়ন, নির্যাতন ও হত্যার শিকার। তাঁর ভাষায়, এ অন্যায় ও অবিচারকে রুখে দেওয়ার প্রত্যয়ে সেখানে চলছে মুসলিমদের ‘মুক্তির লড়াই’। লেখক তৌহিদুল ইসলামের বর্ণনায় পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে মুসলিমদের নিপীড়নের জন্য যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলমান এই সংগ্রাম তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই সিরিজের আটটি বই প্রকাশিত হয়েছে।৩৬
ইসলামি থ্রিলারের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যান্য তরুণ অনেক লেখকও এ ধরনের লেখায় এগিয়ে আসছেন। উদাহরণ হিসেবে ২০০৬ সাল থেকে প্রকাশিত স্পাই সিরিজের কথা বলা যেতে পারে। হাশেম রনি রচিত এ সিরিজের প্রথম বই সিক্রেট জোন লেখক আসাদ বিন হাফিজ ও আবুল আসাদকে উত্সর্গ করা হয়েছে।৩৭ প্রারম্ভিক বক্তব্যে লেখক তাঁর লেখার পেছনে সাইমুম এবং ক্রুসেডের অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করেছেন। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, লেখক নিজেকে মাসুদ রানা সিরিজের মতো সেক্যুলার ঘরানার থ্রিলারের একজন একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।৩৮ তাঁর থ্রিলারগুলোতেও বিশ্বব্যাপী মুসলমান জনগোষ্ঠী, যাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং ভৌগোলিক অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন, তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্রের একটি চিত্র ফুটে ওঠে।
যদিও সমসাময়িক প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে রচিত হয় এসব থ্রিলার, রোমান্টিক উপন্যাস কিংবা ফিকশন, কিন্তু তাতে নীতি-নৈতিকতা ও সমাজে ব্যক্তির ভূমিকা বিষয়ে একটি বার্তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। এসব বার্তা সবচেয়ে স্পষ্ট হয় এসব লেখার নারী চরিত্রগুলো চিত্রণে এবং তাদের ভূমিকা রূপায়ণে। যেমন সাইমুম সিরিজে জোসেফিন নামক নারী চরিত্রটি সেসব নারীর প্রতিনিধিত্ব করেন যাঁরা ঐতিহ্যের ধারক ও অভিভাবক। জোসেফিন তাঁর স্বামীকে উত্সর্গ করেছেন মহত্ দায়িত্বে, তা হলো সব ধরনের অন্যায় থেকে বিশ্বের মুসলিমদের রক্ষা করা। জোসেফিনের স্বামী আহমেদ মুসা কর্তব্যের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। জোসেফিনের ব্যক্তিগত অবদান হলো এই যে মুসলমানদের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া মুসার স্ত্রী হিসেবে জোসেফিন বরণ করেছেন একাকিত্বের কষ্ট। অধিকাংশ ইসলামপন্থী নারীদের দেখতে চান এভাবে। পারিবারিক দায়িত্ব পালন এবং পরিবারের সদস্যদের দেখাশোনাই তাঁদের কাজ, যাতে করে তাঁরা স্ত্রী ও জননী হিসেবে এক নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারেন, যাঁরা মুসলিম উম্মাহ গঠনের দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নিতে পারবেন। জোসেফিন সে কাজটিই করেছেন, মুসার সন্তান আহমদ আবদুল্লার প্রতিপালনের সব দায়দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এই কাঠামোয় নারীদের বাইরের জগতে অংশগ্রহণ ঐতিহ্য এবং এমন ব্যাখ্যা দ্বারা সীমিত, যা নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতার ধারণা পরিপন্থী। এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন একজন আদর্শ নারী নাগরিক তৈরি যার দায়িত্ব হচ্ছে ইসলামি সংস্কৃতির ‘শুদ্ধতা’ নিশ্চিত করা।৩৯ অর্থাত্ পরোক্ষভাবে নারীর অবস্থান সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি এখানে ফুটে উঠেছে। ‘হালাকা’: একটি বিরোধী জনপরিমণ্ডল? (কাউন্টার পাবলিক স্ফেয়ার)
সাম্প্রতিক কালে নারীবিষয়ক গবেষণায় গবেষকদের মনোযোগ আকর্ষিত হয়েছে দুটি দিকে। এক দিকে রয়েছে নারী অধিকার, নারী-পুরুষ সমতা, নারীর ক্ষমতায়নের মতো বিষয়; অন্যদিকে মুসলিম সংখ্যাগুরু ও মুসলিম সংখ্যালঘু উভয় সমাজেই মুসলিম নারীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ধর্মপরায়ণতাবোধের বিষয়। প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ, বিশেষত সমতার সেক্যুলারপন্থী লিবারেল ব্যাখ্যা এবং নারীর ক্ষমতায়নের কথিত পথরেখা, অসম্পূর্ণ এবং এগুলো দাবি করে নিবিড় পর্যালোচনা। সমালোচকেরা বলছেন যে আধুনিকতা (মডার্নিটি) এবং ধর্মের মধ্যে কঠোর দ্বিমূল (বাইনারি) বিভাজন এবং তার ভিত্তিতে ইসলাম ও নারীর সম্পর্ককে পশ্চাত্মুখী ও সেকেলে বলে ব্যাখ্যা নারীদের আত্মনিষ্ঠা (সাবজেকটিভিটি), কর্তৃত্ব (এজেন্সি) এবং আধুনিকতা (মডার্নিটি) বোঝার ক্ষেত্রে মোটেই সহায়ক নয়। ধর্মপরায়ণতাকে ধর্মীয় কুসংস্কার বা পশ্চাত্পদতার সঙ্গে এক করে দেখার যে প্রবণতা সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গিতে স্পষ্ট, তা শুধু তীব্র সমালোচনার মুখেই পড়েছে তা নয়, বরং তার বিপরীতে ‘ইসলামি নারীবাদ’৪০ এবং ‘ইসলামপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি’ হিসেবে দুটি নারীবাদী চিন্তাধারাও গত এক দশকে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত এবং তাদের যুক্তিগুলোকেই হাজির করে, যদিও এগুলোর প্রচারক হচ্ছেন নারীরাই। অন্যদিকে প্রথমোক্তটি উপস্থাপন করে নারীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইসলামি টেক্সটের সমালোচনা এবং পুনর্ব্যাখ্যা। উল্লিখিত দুটি দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়াও নারীর ক্ষমতায়ন এবং আত্মনিষ্ঠা বিষয়ে আলোচনার আরেকটি ধারা গড়ে উঠেছে, যাকে আমি বলতে চাই ‘ধর্মানুরাগী’ (ইংরেজিতে যাকে বলা হয় পাইয়েটি) ধারা।৪১ মিসরের নারীদের মসজিদভিত্তিক কার্যক্রমের ওপর সাবা মাহমুদের ‘ধর্মানুরাগের রাজনীতি: ইসলামি পুনর্জাগরণ ও নারীবাদী বিষয়’ (পলিটিকস অব পাইয়েটি: দি ইসলামিক রিভাইভেল অ্যান্ড দ্য ফেমিনিস্ট সাবজেক্ট)৪২ এবং লারা দিবের বৈরুতের শিয়া নারীসমাজের ওপর গবেষণাগ্রন্থ ‘মোহময় আধুনিকতা: শিয়া লেবাননে জেন্ডার এবং জনপ্রকাশ্য ধর্মানুরাগ’ (অ্যান এনচানটেড মডার্ন: জেন্ডার এবং পাবলিক পাইয়েটি ইন শিয়া লেবানন) প্রকাশিত হওয়ার
পর সামাজিক নৃবিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করছেন কেন নারীরা সক্রিয়ভাবে ধর্মানুরাগী আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন। অনেক গবেষকের মতে, আলোচনার সূচনার জায়গাটা হচ্ছে—
কেন...মুসলিম বিশ্বে নারীদের বিরাট একটি অংশ এমন একটি ব্যবস্থাকে সমর্থন জোগাচ্ছে, যা তাদের নিজেদের স্বার্থের পরিপন্থী, বিশেষত বর্তমান সময়ে যেখানে তাদের সামনে বন্ধনমুক্তির বিভিন্ন রকমের বিকল্প সুযোগ রয়েছে।৪৪
এসব ধর্মানুরাগী আন্দোলন সাধারণত অনানুষ্ঠানিক ছোট ছোট গ্রুপ বৈঠকের আকারে সংগঠিত, প্রায়ই এদের বলা হয়ে থাকে হালাকা, তালিম বা পাঠচক্র।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মায়মুনা হক, সামিয়া হক, ইলোরা শেহাবুদ্দিন ও সারাহ হোয়াইট এ ধরনের গোষ্ঠীসমূহের কার্যক্রমের ওপর গবেষণা চালিয়েছেন।৪৫ আমি ব্যক্তিগতভাবে ২০১০ সালে ঢাকা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এ ধরনের গোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি।৪৬ তাদের সম্পর্কে আমার বিশ্লেষণ এসব গোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে আমার আলোচনা এবং প্রকাশিত গবেষণাসমূহের ওপরে নির্ভর করে তৈরি।
প্রাথমিকভাবে সমাজের মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত শ্রেণির কাছে পৌঁছানোর জন্য এ ধরনের গোষ্ঠী গড়ে তোলা হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রান্তিক এবং সাক্ষরতাহীন গ্রামীণ নারীসমাজের মধ্যেও এসব গোষ্ঠীর কার্যক্রম চোখে পড়ে। বর্তমান এই প্রবণতা ২০০০ দশকের দিকে বিস্তার লাভ করতে শুরু করে এবং পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে, এ ধরনের গোষ্ঠীভিত্তিক কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে। একজন সাংবাদিক, যিনি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ভ্রমণ করেছেন এবং বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছেন, তিনি জানান যে এসব পাঠচক্র বর্তমান সময়ের একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।৪৭ গ্রামীণ জনসমাজে এ ধরনের অধ্যয়নগোষ্ঠীর কার্যক্রমকে তালিম নামে অভিহিত করা হয়। তালিম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এমন দুজন নারীর কার্যক্রমের ওপরে গবেষণা করেছেন সারাহ হোয়াইট। এঁদের একজন তাবলিগ জামাতের সদস্য এবং অপরজন সাংগঠনিকভাবে নিরপেক্ষ। ইলোরা শেহাবুদ্দিন ২০০১ ও ২০০৩ সালে মাঠপর্যায়ে গবেষণা চালানোর সময় শহরের বস্তি এলাকায় মহিলাদের জন্য আয়োজিত এ ধরনের বৈঠকে যোগ দেন, যেখানে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মীরা কোরআনবিষয়ক আলোচনা করেন এবং এ রকম ধারণা দেন যে তা রাজনৈতিকভাবে দলনিরপেক্ষ ও এগুলোকে ধর্ম প্রচারকর্ম হিসেবে অভিহিত করেন।৪৮ মায়মুনা হকের গবেষণার উত্তরদাতারা জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রী সংস্থার সদস্য। প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে এসব পাঠচক্রের কিছু সংগঠিত হয় ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের, বিশেষত জামায়াতে ইসলামীর, রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে আর কিছু গড়ে ওঠে ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কিন্তু মোটা দাগে দেখলে বলা যায় যে এসব পাঠচক্রের সূত্রপাত হয়েছে, এবং অংশত এখনো উপস্থিতি রয়েছে, ইসলামপন্থী দল বিশেষত জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের। তবে নারীদের জন্য আয়োজিত এসব পাঠচক্রকে দলের সদস্য বৃদ্ধির চেয়ে ধর্মানুরাগের চর্চা হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে।
এসব পাঠকেন্দ্রে দেখা যায় যে দলগতভাবে আলাপ-আলোচনার চেয়ে একজন গোষ্ঠীনেত্রী কোরআনের ব্যাখ্যা প্রদান করছেন। অংশগ্রহণকারীদের ইসলামি জ্ঞান সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করা তৃণমূল পর্যায়ের এ ধরনের পাঠচক্রের প্রধান বিষয় নয়, বরং তাদের লক্ষ্য নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় (এবং নির্দিষ্ট সামাজিক-অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর) ব্যক্তি ও পরিবারে নৈতিকতার পুনর্জাগরণ তৈরি করা। সেটা করা হয় কোরআনে বর্ণিত করণীয় বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান প্রদানের মধ্য দিয়ে এবং তার জন্য [বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে দেওবন্দী আলেম আশরাফ আলী থানভী রচিত] বেহেশতি জেওর-এর মতো জনপ্রিয় পরামর্শমূলক বই নয়, গুরুত্ব দেওয়া হয় মূল উেস, অর্থাত্ কোরআনে প্রত্যাবর্তনকে।৪৯
এ যাবত্ আমি যেসব গবেষণা উদ্ধৃত করেছি তাতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে এসব গোষ্ঠী হলো নারীদের মধ্যে ধর্মানুভূতির প্রকাশ। কিন্তু এসব গবেষণায় ধর্মানুভূতির কোনো সংজ্ঞা কিংবা তার বিস্তারিত অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়নি। সাবা মাহমুদের গবেষণার প্রশ্নে বিষয়টি তুলে ধরেছেন আমিনা ওয়াদুদ, যেখানে তিনি বলেছেন যে এসব গবেষণায় রাজনীতি বা ধর্মানুভূতি (যা কোরআনে বিস্তারিতভাবে তাকওয়া, এই পদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং যার অর্থ ইসলামের মিস্টিক্যাল আন্দোলনের ইতিহাসে আলোচিত হয়েছে) বিষয়ে যথেষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।৫০
লারা দিবের গবেষণার মধ্যেও এ ধরনের দুর্বলতা চোখে পড়ে, বিশেষ করে প্রণিধানযোগ্য হলো পঞ্চম অধ্যায়। সেখানে উপর্যুপরিভাবে ‘ধার্মিক’ শব্দটির ব্যবহার করা হয়েছে, যদিও তিনি অন্যত্র বলেছেন যে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য রয়েছে এবং ‘ধার্মিক’ শব্দটিতে এই বৈচিত্র্যকে ধারণ করা যায় না।৫১ জামায়াতে ইসলামীর নারী কর্মীদের মধ্যে পরিচালিত পাঠচক্র বিষয়ে মায়মুনা হকের গবেষণায় উঠে আসে যে এ ধরনের পাঠচক্র কেবল কোরআন ও হাদিসকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় না। ‘প্রচলিত ইসলামি চিন্তাবিদদের, যার মধ্যে সমসাময়িক বা সাম্প্রতিক কালের চিন্তাবিদেরাও আছেন, কোরআনের পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা এবং ধর্মতাত্ত্বিক বক্তব্যও’ আলোচিত হয়।৫২ সামিয়া হক এবং অন্য গবেষকেরা যেসব পাঠচক্র পর্যবেক্ষণ করেছেন সেখানেও এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।
তবে মায়মুনা হক লক্ষ করেন যে ইসলামি পাঠচক্রগুলো ‘এক বিশেষ ধরনের ইসলামি আত্মনিষ্ঠা (সাবজেকটিভিটি) তৈরির’ সূতিকাগার।৫৩ তবে যে বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো:
এ ধরনের পাঠচক্র বাংলাদেশে ইসলামি আন্দোলনের টিকে থাকা এবং বিকাশের ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। এটা তারা করে কর্মীদের আত্মবোধ, ধর্মীয় দায়িত্ব এবং অন্যদের সম্পর্কে তাদের ধ্যানধারণাকে ঢেলে সাজানোর মধ্য দিয়ে। এই ঢেলে সাজানোর কাজ সম্পাদিত হয় কথাবার্তার একটি ধরন ব্যবহার করে, যেখানে ধার্মিকতা ও ধর্মীয় পরিচয়, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র, বিশ্ব মুসলিম সমাজ বা উম্মাহ এবং বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট একধরনের চিন্তা তুলে ধরা হয়।৫৪
সামিয়া হক ও সাবিনা ফায়েজ রশিদ ঢাকার উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যে পরিচালিত পাঠচক্র বিষয়ে গবেষণার উপসংহারে বলেন যে নতুন ইসলামি আত্মনিষ্ঠা নারীদের বিভিন্নভাবে ক্ষমতায়ন করে।৫৫ তাঁরা যে গোষ্ঠীটির ওপর গবেষণা চালান, সে পাঠচক্রটি ২০০২ সালে একজন বিদেশি কূটনীতিকের স্ত্রীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০০৪ সালে উদ্যোক্তা মহিলা বাংলাদেশ ত্যাগ করার পর সেটি যে শুধু কার্যক্রম জিইয়ে রেখেছে, তা-ই নয়, বরং নতুন নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে এর কলেবর ও কার্যক্রমও অনেক বেশি বেগবান হয়েছে। তাঁদের গবেষণা দেখায় যে এই ধরনের পাঠচক্রে অংশগ্রহণকারীদের বিরাজমান এবং পরিচিত স্পেসকে বদলে দেয়, যাতে করে তারা তাদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর খুঁজে পায় এবং তাঁদের কর্তৃত্ব (এজেন্সি) প্রকাশ করতে পারে, এর মধ্য দিয়ে এসব পাঠচক্র জনপরিমণ্ডলের ইসলামীকরণে এক বড় ভূমিকা পালন করে। এই পাঠচক্রগুলো দুই দিক থেকে ব্যতিক্রমী। প্রথমত, আপাতদৃষ্টে এসব পাঠচক্র দুটো পরস্পরবিরোধী প্রবণতার মধ্যে একধরনের টানাপোড়েন তুলে ধরে। এই দুই প্রবণতা হলো ঐতিহ্যবাহী বা প্রথাগত চিন্তাভাবনা (কোরআন এবং হাদিসের আক্ষরিক অনুবাদ অনুসরণ) এবং ইসলামি ‘সংস্কারবাদ’। এসব পাঠচক্র, বিশেষ করে হক এবং রশিদ যে ধরনের গোষ্ঠীর কথা বলছেন, সেগুলোর লক্ষ্য হচ্ছে প্রচলিত ধর্মসম্মত টেক্সটগুলোর বিষয়ে নারীদের ধারণা সুস্পষ্ট করা, যাতে করে প্রথাসিদ্ধ জেন্ডার ভূমিকাকে আরও বেশি শক্তিশালী করা যায়।৫৬ দ্বিতীয়টি হলো, এসব গোষ্ঠীর লক্ষ্য হচ্ছে, ‘নিজেদের জন্য স্বাধীন এবং স্ব-কর্তৃত্বাধীন বিভিন্ন রকম জায়গা তৈরি করা’।
এই লক্ষ্য প্রথাসিদ্ধ ব্যাখ্যার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ধরনের পাঠচক্রে অংশগ্রহণকারী মহিলারা নিজেদের এমন আধুনিক চিন্তাশীল নারী হিসেবে দেখে থাকে, যারা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ইসলামের আরও গুরুত্বপূর্ণ ও দৃশ্যমান ভূমিকা নিশ্চিত করতে নিজেকে, পরিবারকে এবং নিজ সমাজকে নতুন করে ঢালাই করতে সংকল্পবদ্ধ।৫৭
তবে এখানে উল্লেখ করা দরকার যে ক্ষমতায়ন এবং কর্তৃত্বের (এজেন্সি) প্রশ্ন সমস্যার ঊর্ধ্বে নয়। হক এবং রশিদ বলছেন, ‘নতুন করে খুঁজে পাওয়া জ্ঞান, ঐশ্বরিক নির্দেশনা এবং আত্মসমীক্ষা এই নারীদের এমন সব পরিস্থিতিতে তাদের কর্তৃত্ব প্রয়োগের সুযোগ করে দেয় অতীতে যেসব পরিস্থিতিতে তারা কোনো রকম প্রতিবাদ করেনি (অথবা তারা ভেবেছে তারা প্রতিবাদের জন্য প্রস্তুত নয়)’, কিন্তু এই ‘প্রতিবাদ এবং কর্তৃত্ব সমাজে বিদ্যমান জেন্ডার সম্পর্ককে বদলে দেয়নি।’৫৮
যদিও সাধারণত বলে হয়ে থাকে ব্যক্তিগত ধর্মচর্চা বা ধর্মানুরাগ এ ধরনের গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠার কারণ, কিন্তু ধীরে ধীরে নিজ সম্প্রদায় ও সমাজের বদল এবং দাওয়া কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া এ ধরনের গোষ্ঠীর লক্ষ্য হয়ে ওঠে। মায়মুনা হক, সামিয়া হক ও সাবিনা ফায়েজ রশিদ যেসব পাঠচক্র পর্যবেক্ষণ করেছেন তাদের পথরেখা দেখলেই তা স্পষ্ট হয়। পাঠচক্রে নিয়মিত অংশগ্রহণকারী একজনের ভাষ্যমতে, ‘আমাদের কী করতে হবে এই নিয়ে আমরা বহু বছর ধরে গবেষণা করেছি এবং শুনেছি। এখন আরও কাজ করা দরকার, আমাদের কাজ হলো অন্য সবার মাঝে একে ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা যদি অন্যদের নিজেদের দলভুক্ত না করি তবে স্রষ্টার প্রকৃত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করলাম না।’৫৯ শুধু আত্মোপলব্ধি বা ব্যক্তিগত ধর্মচর্চার ধারণা থেকে এ ধরনের স্পৃহা প্রকাশ পায় না, বরং আমরা দেখতে পাই যে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাইরে এই ধরনের পাঠচক্রে যারাই অংশ নিচ্ছে তাদের পথপরিক্রমা প্রায় একই রকম। বলা প্রয়োজন যে এ ধরনের পাঠচক্র ছড়িয়ে পড়েছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং মুসলিম সংখ্যালঘু উভয় ধরনের দেশে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের গোষ্ঠীর উপস্থিতি ও কার্যক্রম দেখতে পাওয়া যায়।৬০ ইয়েমেনের সানার মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে এ ধরনের পাঠচক্র রয়েছে,৬১ পাকিস্তানে ‘আল হুদা’ ইসলামি স্কুল হিসেবে পরিচিত প্রতিষ্ঠান আরও সংগঠিতভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে,৬২ মালয়েশিয়ায় এ ধরনের কার্যক্রম ‘সিস্টার্স অব ইসলাম’৬৩ এবং ‘মজলিস-এ-দোয়া’৬৪ নামে পরিচালিত হচ্ছে। থাইল্যান্ডে ‘বানাতুল হুদা’ যথেষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।৬৫ ইন্দোনেশিয়ায় ধর্মানুভূতি এবং নারীদের সংগঠনের প্রশ্ন ব্যাপকভাবে আলোচিত।৬৬ শ্রীলঙ্কায়, বিশেষত কলম্বোতে, ১৯৯০ সাল থেকে ‘আল মুসলিমাত’ নামে নারীদের এ ধরনের গোষ্ঠীর কার্যক্রম রয়েছে। আল মুসলিমাতের লক্ষ্য ‘দাওয়া কার্যক্রম পরিচালনা, যার বিশেষ লক্ষ্য নারীদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং সামগ্রিকভাবে সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম।’৬৭ আমি আগে যেসব সংগঠনের কথা উল্লেখ করেছি তাদেরও এই ধরনের কাজ প্রধান লক্ষ্য বলে বিবেচিত। মিসরে সাবা মাহমুদ, বাংলাদেশে সামিয়া হক বা শ্রীলঙ্কায় ফারজানা হানিফার গবেষণায় যখন এটা স্পষ্ট হয় যে এসব গোষ্ঠীর লক্ষ্য এ ধরনের তখন সেগুলোকে কেবল ধর্মানুরাগের আন্দোলন বলে বিবেচনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। কেননা তাঁদের বিশ্লেষণে দাওয়ার মর্মবস্তুই উপেক্ষিত হচ্ছে।
সাবা মাহমুদের গবেষণার সমালোচনায় সামেহ সালিম যে কথাগুলো বলেন সেগুলো অন্য গবেষণাকাজগুলোর সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সমভাবে প্রযোজ্য। সালিম বলছেন যে সাবা মাহমুদের গবেষণায় ধারণা এবং আন্দোলন হিসেবে দাওয়া বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। কেননা দাওয়া রাজনীতি ও ক্ষমতার এক বিশেষ সম্পর্ক প্রকাশ করে, যা কেবল নিজের আত্মিক বিষয় হিসেবে নিজের শরীরের ওপরে নিয়ন্ত্রণ নয়, অন্যদের শরীরের ওপরও নিয়ন্ত্রণের কথা বলে। সালিম বলছেন, দাওয়ার মধ্যে অন্যদের কাছে আবেদনের যে বিষয় রয়েছে (সলিসিটেশন) যাকে সাবা মাহমুদ বলছেন ‘প্রণোদনার শিক্ষা’ (পেডাগোজি অব পারসুয়েশন) তাকে ধর্মান্তরীকরণ (কনভারশন) বলেও বোঝা যেতে পারে। এটি বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ যখন এসব আন্দোলনের ব্যাপকতর লক্ষ্যের কথা যদি আমরা বিবেচনা করি। সালিম এই বলে সাবা মাহমুদের সমালোচনা করেন যে এখানে একটি ব্যাপকতর দৃষ্টিভঙ্গি অনুপস্থিত। এসব ধর্মানুরাগী আন্দোলনের প্রাতিষ্ঠানিক এবং শিক্ষাসম্পর্কিত কার্যক্রমের কোনো রকম সমালোচনামূলক পাঠ নেই। তিনি বিশেষভাবে যেসব কার্যক্রমের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেন তা হলো স্থানীয় মসজিদ নির্মাণ, সামাজিক কল্যাণের প্রতিষ্ঠান তৈরি, ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা এবং ছাপাখানা স্থাপন। তা ছাড়া রয়েছে ব্যক্তিগত কথোপকথন বা প্রচারণার মাধ্যমে মুসলিমদের প্রতি আরও বেশি ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের জন্য আহ্বান জানানো। এগুলোকে সাবা মাহমুদ দেখেছেন নারীদের ধর্মানুরাগ আন্দোলনের নির্ভেজাল নৈতিক এবং ব্যক্তিগত জীবনের ইতিবাচক দিক হিসেবে। কিন্তু সালিম বলছেন এগুলোর মধ্যে যে রাজনৈতিক নির্দেশনার দিক রয়েছে সাবা মাহমুদ তা উপেক্ষা করেছেন।৬৮ যদিও মায়মুনা হক তাঁর গবেষণায় দাবি করেন যে এগুলো সবই ধর্মানুরাগী আন্দোলন, কিন্তু তাঁর গবেষণার জন্য নির্ধারিত গোষ্ঠী ইসলামি ছাত্রী সংস্থা (জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন) অন্য রকম প্রমাণ হাজির করে।৬৯ হক স্পষ্ট করেই বলেছেন যে তাঁর গবেষণার অধীত বিষয় ছাত্রী সংস্থা মনে করে, ‘বর্তমান সময়ে রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার মধ্যে বিদ্যমান নিবিড় সম্পর্ক এবং সমাজের ওপর রাষ্ট্রের ক্ষমতার কারণে নিজ নিজ ঘরে ধর্ম প্রতিষ্ঠার কাজে সাফল্যের জন্য জনপরিমণ্ডলের ইসলামীকরণ অত্যাবশ্যকীয়।’৭০
তর্কের খাতিরে অনেকে বলতে পারেন, কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সুস্পষ্ট পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এসব পাঠচক্র বিস্তার লাভ করেনি। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে সমাজে নারীদের ভূমিকা নিয়ে চলমান বিতর্কের প্রেক্ষাপটেই এসব পাঠচক্রের উদ্ভব ঘটেছে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও এ দেশের গ্রামীণ প্রান্তিক পর্যায়ে মহিলাদের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উন্নয়ন পরিকল্পনার ধারা অনুযায়ী নারীসমাজকে উন্নয়ন কার্যক্রমের কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। ইসলামপন্থীরা প্রথমে এসব প্রকল্পের বিরোধিতা করে এবং সহিংসভাবে এসব এনজিওর মোকাবিলা করে। পরবর্তী পর্যায়ে তারা তাদের কৌশলের পরিবর্তন আনে, নিজেরাই এনজিও প্রতিষ্ঠা করে এবং সমাজকল্যাণ ও উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে।৭১ এসব প্রতিষ্ঠান তারপর সমাজে জেন্ডার এবং জনসমক্ষে নারীদের ভূমিকাকে ভিন্নভাবে নির্ধারণের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হয়।
পাঠচক্রে অংশগ্রহণকারীদের সামাজিক অবস্থানের ভিন্নতা সত্ত্বেও কোরআন ও হাদিস ছাড়াও সমাজে নারীর ভূমিকা নিয়ে লেখা মাওলানা মওদুদীর বিভিন্ন বই এসব পাঠচক্রের অন্যতম পাঠ্যবিষয় হিসেবে ব্যবহূত হয়। মওদুদীর মতে, ‘নারীরা ইসলামি সংস্কৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী দুর্গ’ আর তাই যেকোনো মূল্যে একে রক্ষা করতে হবে। কোরআন এবং হাদিসের যে ব্যাখ্যা মওদুদী প্রদান করেন তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে নারী ও পুরুষের এক নির্ধারিত পদসোপান এবং নারীর পৃথক্করণ। তাঁর মতে, আদর্শ নারীর প্রতিমূর্তি হচ্ছে অন্তঃপূরবাসিনী নারী এবং মাতৃত্ব যার চূড়ান্ত লক্ষ্য।৭২
এসব পাঠচক্রে যেহেতু কেবল নারীর ভূমিকা আলোচিত হচ্ছে তা নয়, আলোচিত হচ্ছে অন্যান্য সামাজিক রীতিনীতি ও অনুশীলনের বিষয়ও, সেহেতু এসব আলোচনা ইসলাম বিষয়ে আলাপ-আলোচনা এবং প্রকাশ্য বিতর্কের পথও উন্মুক্ত করছে। এসব বিতর্ক কেবল ‘সেক্যুলার’ চিন্তা ও প্রবণতার ধারা দিয়েই প্রভাবিত হচ্ছে তা নয়, বরং এসব বিতর্কে উপস্থিত থাকছে কোরআন ও হাদিসের পাঠনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিও। কিন্তু আমাদের এটা অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে যে কেবল এসব টেক্সট পুনর্পাঠ বা চিরায়ত টেক্সটের আলোচনা নারীদের মধ্যে ভিন্ন ধরনের আত্মনিষ্ঠা তৈরির জন্য যথেষ্ট নয়। এগুলো নিজে নিজেই সমাজে জেন্ডারের সমতা বা নারীর ভূমিকা বিষয়ে নতুন ধারণা তৈরি করে না। এসব পাঠ বড়জোর সংস্কার (রিফরমেশন) কিন্তু টেক্সটের পুনর্গঠন (রিকন্সট্রাকশন) নয়।
আমার উপরিউক্ত বক্তব্য খানিকটা ব্যাখ্যা দাবি করে। আমি এ ক্ষেত্রে ইহুদি ও খ্রিষ্টান নারীবাদী চিন্তার ধারা এবং তাদের ইতিহাসকে বিবেচনায় রাখছি এবং সেই কাঠামোর আলোকেই এ বক্তব্য উপস্থাপন করেছি। খ্রিষ্টান ও ইহুদি নারীবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে মূল প্রশ্নটি হলো: ধর্মীয় পবিত্র পাঠের কাছে প্রত্যাবর্তনের মূল উদ্দেশ্য কী? এর উত্তর হলো হয় সংস্কার, নতুবা পুনর্গঠন। সংস্কারের মূল বক্তব্য হলো, যে কেউ যখন ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করবেন তিনি শুরু করবেন এই বিবেচনা থেকে এসব টেক্সট ইতিহাসের প্রেক্ষাপট দিয়ে সীমিত, এর কিছু কিছু অংশ আছে যেগুলো সর্বজনীন বা অনিবার্য, আর অন্য কিছু অংশ আছে আপেক্ষিক। পুনর্গঠন ধারা এই অবস্থান থেকে সরে গিয়ে তার অবস্থান তৈরি করে; তাঁরা বিবেচনা করে যে ‘এসব পবিত্র টেক্সট মানুষকেন্দ্রিক (এন্ড্রোসেন্টিক) এবং সেগুলো মানুষের প্রয়োজনে মানুষের তৈরি।’ এন সোফি রোয়াল্ডের ভাষায়, ‘সংস্কারের পরোক্ষ বিষয় হলো বিদ্যমান চিন্তাগুলোকে আংশিকভাবে গ্রহণ করা, অন্যদিকে পুনর্গঠনের পরোক্ষ বিষয় হলো ওই চিন্তাগুলোকে পুরোপুরি খণ্ডন করা’৭৩ শেষোক্ত ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ধর্মীয় জ্ঞান তৈরি এবং তার প্রচারের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোকে সম্পূর্ণভাবে পুনর্বিবেচনা করা। সুনির্দিষ্টভাবে বললে এই দৃষ্টিভঙ্গি জ্ঞানের উত্স বিষয়ে প্রশ্ন তোলে।
কোরআন পাঠচক্র বিষয়ে এ যাবত্কালের গবেষণাগুলোতে এটাই বলার চেষ্টা করা হয়েছে যে এগুলো নারীদের ইসলামসম্পর্কিত টেক্সট পুনর্বিবেচনার (বা পুনরায় সংজ্ঞায়নের) সুযোগ তৈরি করে, কিন্তু তাঁদের এ দাবি বিষয়ে সমর্থন মেলে না যখন আরও ঘনিষ্ঠভাবে পর্যালোচনা করে আমরা দেখতে পাই যে এসব পাঠচক্রে মওদুদীর মতো পুরুষ লেখকদের রচিত তফসির (কোরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা) পাঠ্যতালিকায় প্রাধান্য পাচ্ছে। রাজনৈতিক ইসলামের পুরুষতান্ত্রিক দীক্ষাগুরুদের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করার ফলে এসব আলোচনা ও পাঠচক্রের শৃঙ্খলমুক্তির সম্ভাবনা দূরপরাহতই থেকে যাচ্ছে।
উপসংহার
জনপরিমণ্ডল সেক্যুলার, সমপ্রাকৃতিক এবং উদার গণতান্ত্রিক একটি স্থান বলে যে ধারণা বাংলাদেশে বিদ্যমান ছিল ইসলামপন্থী জনপরিমণ্ডল তৈরি সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। বাংলাদেশের জনপরিমণ্ডলব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের কণ্ঠস্বরের উপস্থিতি থাকলেও ধর্মীয় ভাবধারা দ্বারা প্রভাবিত কণ্ঠস্বর সেখানে অনুপস্থিত ছিল। ফলে এই নতুন ও বিকাশমান কণ্ঠস্বর জনপরিমণ্ডলে বহুত্ববাদিতাকে যুক্ত করছে। কিন্তু প্রশ্ন থাকছে যে এই জনপরিমণ্ডল বৃহত্তর জনপরিমণ্ডলব্যবস্থাকে বিচূর্ণ/বিভক্ত করে ফেলবে কি না৭৪ এবং প্রথাসিদ্ধ ধর্মীয় যে কর্তৃত্ব ও কাঠামো আছে তাকে চ্যালেঞ্জ করার গণতান্ত্রিক সম্ভাবনা এর মধ্যে আছে কি না।
গত এক দশকে মার্কিন গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এ বিষয়ে জোরদার বক্তব্য ছিল এই যে একটি উদীয়মান মুসলিম জনপরিমণ্ডল আরও ব্যাপক ও বৈচিত্র্যময় অংশগ্রহণকারীদের অংশগ্রহণের পথ তৈরি করছে এবং ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। মধ্যপ্রাচ্যে বিকাশমান জনপরিমণ্ডলের অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক গবেষক এই যুক্তি উপস্থাপন করেন যে এই জনপরিমণ্ডল জাতিরাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত মুসলিম অথরিটির সঙ্গে সমালোচনামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম। সহজ করে বললে এই জনপরিমণ্ডল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। ডেল আইকেলম্যান ১৯৯৯ সালে বলেন, কোনো ধরনের দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রতিক্রিয়া ছাড়াই ইসলাম যে সামাজিক আলোচনার ও বিতর্কের বিষয় হতে পারে সেই ধারণা শক্তিশালী হচ্ছে। ইসলামের প্রতীকী [ও পরিচিত] ভাষার ব্যবহার নিয়ে প্রকাশ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে এই নতুন জনপরিসর (পাবলিক স্পেস) আকার লাভ করছে। তদুপরি, আইকেলম্যান বলেন যে, নতুন [সামাজিক] মাধ্যমে এবং নতুন অংশগ্রহণকারীদের কারণে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয়ে চলমান বিতর্ক এই ধারণা দিচ্ছে যে ভিন্ন ভিন্নভাবে ইসলামকে বোঝা যায় এবং ইসলামি মূল্যবোধ তৈরি করা যায়। এতে করে জনপরিসর সম্পর্কে এই ধারণা জোরদার হচ্ছে, জনপরিসর আলোচনার জায়গা এবং তা অংশগ্রহণমূলক আর জনপরিসর রাষ্ট্রস্বীকৃত কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান নয়।৭৫
এ ধরনের আশাবাদী মনোভাব অবশ্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কিছুদিন পরই বিশ্লেষকেরা এই দিকে অঙ্গুলি সংকেত করতে থাকেন যে নতুন ব্যবস্থা তাত্ত্বিকভাবে যতটা প্রতিনিধিত্বশীল হবে বলে আশা করা হয়েছিল বাস্তবে ততটা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই পুরোনো কর্তৃত্বের বদলে নতুন কর্তৃত্বের সৃষ্টি হয়েছে, আর সেগুলো আগের চেয়ে মোটেই কম নিয়ন্ত্রণমূলক নয়। এই নতুন বাস্তবতা মোটেই বিস্ময়কর বলে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়, কেননা এই আশঙ্কার কথা এমনকি যারা বিরোধী জনপরিসরের উত্থানের বিষয়ে উত্সাহী ছিলেন তাঁরাও নাকচ করে দেননি। ন্যান্সি ফ্রেজার বিরোধী জনপরিসর উত্থানের প্রেক্ষাপটে সুস্পষ্টভাবে এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন যে এগুলো সব সময়ই যে সুনীতিসম্পন্ন হবে তা তিনি মনে করেন না। তিনি বলেছিলেন, ‘হা ঈশ্বর! এসবের কিছু কিছু সুস্পষ্টভাবে অগণতান্ত্রিক এবং সমতার ধারণার বিরোধী। এমনকি যেগুলোর গণতান্ত্রিক এবং সমতার উদ্দেশ্যও রয়েছে সেগুলো অন্যদের বাইরে রাখার ও প্রান্তিকীকরণের নিজস্ব ধরনের পদ্ধতি অনুশীলন করে থাকে।’৭৬
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ইসলামি জনপরিমণ্ডলব্যবস্থায় যেখানে ইসলামের একটি ব্যাখ্যাই গৃহীত হচ্ছে, সেখানে প্রথাগত মূল্যবোধ ও চিন্তাধারা মাওলানা মওদুদীর মতো বিভিন্ন ইসলামপন্থী চিন্তাবিদের মতবাদ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। আমার মতে, এটি সার্বিক ইসলামীকরণের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যে ইসলামীকরণের ধারণা তৈরি হয়েছে তাদের হাতে যারা বিদ্যমান সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও মূল্যবোধ বদলে দেওয়ার রাজনৈতিক কর্মসূচি দ্বারা পরিচালিত। ইসলামীকরণ বলতে কেবল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বোঝায় না, বরং সংস্কৃতি, ধর্ম এবং তত্সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় এ প্রক্রিয়ার অংশ। ইসলামপন্থীদের বিবেচনায় ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনের প্রশ্ন আসে সমাজের ইসলামীকরণের পরে।৭৭ আপাতদৃষ্টে এখন যে ইসলামপন্থী জনপরিমণ্ডল বিকাশমান তাতে জনপরিমণ্ডলের মৌলিক দিকসমূহ—নিয়ন্ত্রণহীন, গণতান্ত্রিক এবং সমালোচনামূলক—অনুপস্থিত।
নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। নতুন জনপরিমণ্ডল মুসলিম নারীদের ভিন্ন প্রতিকৃতি এবং পাঠচক্রগুলো সমাজে নারীদের নতুন ধরনের দৃশ্যমানতা দেয়, কিন্তু তাদের ওপরে এই নিয়ন্ত্রণও চাপিয়ে দেয় যে তাদের বলা হয় সমাজে তাদের ভূমিকা বিষয়ে ইসলামের ব্যাখ্যার একধরনের কর্তৃত্বকে (অথরিটি) মেনে নিতে। ইসলাম পন্থার এটি একটি অন্তর্নিহিত স্ববিরোধিতা বলে মনে করেন নিলুফার গোলে:
ইসলামপন্থী রাজনীতি (ইসলামইজম) নারীদের কর্তৃত্বের (এজেন্সি) কথা বলে এবং তাঁদের ব্যক্তিয়ানের (ইনডিভিজুয়ালাইজেশন) ওপরে জোর দেয়, কিন্তু তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ইসলামপন্থী রাজনীতি নারীদের জনজীবনে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করে, কিন্তু সেই সুযোগ সীমিত কেবল নিজ সম্প্রদায়ের অভিন্ন কাজে অবদানের জন্য। ‘ইসলামি জীবনের’ রাজনীতিকীকরণের মধ্যে সম্ভাব্য আশঙ্কা থেকে গেছে যে তা নারীর ব্যক্তিগত জীবন, পেশাগত কৌশল এবং ব্যক্তিগত মনোভাব প্রকাশের পথে বাধা হবে। ইসলামপন্থী রাজনীতি মুসলিম নারীকে আধুনিক জীবনের সুযোগ দেয়, কিন্তু আধুনিকতার (মডার্নিটি) এক অস্পৃশ্য রূপ।৭৮
যেকোনো জনপরিমণ্ডলের অকৃত্রিমতা ও স্থায়িত্ব নির্ভর করে সমাজের সঙ্গে তার সংযুক্তির ওপরে। এটি এমনকি বিরোধী জনপরিমণ্ডলের জন্যও প্রযোজ্য। এ কথা বলা বাহুল্য, একেবারে স্থানীয় না হলে কোনো জনপরিমণ্ডল বেঁচে থাকতে পারে না। বিশ্বায়ন নিঃসন্দেহে বিদ্যমান জনপরিমণ্ডলে নতুন কণ্ঠস্বর তৈরি বা যুক্ত হওয়া এবং তাদের চরিত্র-প্রকৃতির ওপরে প্রভাব ফেলবে, কিন্তু সেসব কণ্ঠস্বরের শিকড় প্রোথিত হতে হবে স্থানীয় সমাজে এবং তার বেঁচে থাকার উপাদান আসতে হবে স্থানীয় ঐতিহ্যের মধ্য থেকেই। বিকাশমান ইসলামপন্থী জনপরিমণ্ডল এটা এখনো দেখাতে পারেনি যে এটি বাংলাদেশি সমাজের ইসলামি ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত। ইসলাম পন্থার বৈশ্বিক প্রবণতা এসব প্রচেষ্টার অনুপ্রেরণা বলেই মনে হয়। এই ধরনের উদ্যোগে বাংলাদেশের স্থানীয় সমন্বয়মুখী (সিনক্রেটিস্টিক) ঐতিহ্যের উল্লেখের অনুপস্থিতির কারণে এই নতুন ধারার অকৃত্রিমতা প্রশ্নবিদ্ধ। এ যাবত্, ঐতিহ্যিক ধারা ও সাম্প্রতিক প্রবণতার মধ্যে সৃজনশীল সংশ্লেষ ঘটানোর প্রচেষ্টার উদাহরণ খুবই সীমিত।
টীকা ও তথ্যসূত্র
১. সাধারণভাবে বলা যায়, হেবারমাস এক জনপরিমণ্ডলের একটি নির্ধারক বৈশিষ্ট্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন। জারগেন হেবারমাস, দ্য স্ট্রাকচারাল ট্রান্সফরমেশন অব দ্য পাবলিক স্ফেয়ার: এন এনকোয়ারি ইনটু এ ক্যাটাগরি অব বুর্জোয়া সোসাইটি, অনুবাদ থমাস বার্গার (কেমব্রিজ, ম্যাসাচুসেটস; দ্য এমআইটি প্রেস, জার্মান ১৯৬২, ইংরেজি অনুবাদ ১৯৮৯)।
২. ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার
জন্য দেখুন, আলী রীয়াজ, ‘দ্য পলিটিকস অব ইসলামাইজেশন ইন বাংলাদেশ’, রিলিজিয়ন অ্যান্ড পলিটিকস ইন সাউথ এশিয়া, সম্পাদনা আলী রীয়াজ , (লন্ডন; রাউটলেজ, ২০১০), পৃ. ৪৫-৭০।
৩. হেবারমাস, দ্য স্ট্রাকচারাল ট্রান্সফরমেশন অব দ্য পাবলিক স্ফেয়ার, হেবারমাসের বইয়ের দুটি প্রধান বিষয় রয়েছে: একটি হচ্ছে ‘বুর্জোয়া জনপরিমণ্ডলের’ ঐতিহাসিক উত্স এবং অপরটি হচ্ছে সমকালে জনপরিমণ্ডলের কাঠামোগত পরিবর্তনের সমালোচনামূলক বর্ণনা, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের উত্থান, সংস্কৃতি শিল্প ও জনজীবনে ক্রমশ অর্থনৈতিক করপোরেশনগুলোর ও বৃহত্ বাণিজ্যের শক্তিশালী অবস্থান।
৪. মিরিয়াম হোয়েক্সটার, ‘দি ওয়াকফ অ্যান্ড দ্য পাবলিক স্ফেয়ার’, দ্য পাবলিক স্ফেয়ার ইন মুসলিম সোসাইটিস, সম্পাদনা মিরিয়াম হোয়েক্সটার, স্যামুয়েল এন, আইসেনস্টাড ও নেহেমিয়া লেভটজিয়ন (নিউইয়র্ক; স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক প্রেস, ২০০২), পৃ. ১১৯।
৫. রজার কার্টিয়ার, দ্য কালচারাল অরিজিনস অব দ্য ফ্রেঞ্চ রেভল্যুশন, অনুবাদ এল জি কোকরেন (ডারহাম, নর্থ ক্যারোলাইনা ও লন্ডন; ডিউক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯১), পৃ. ১৭।
৬. তালাল আসাদ, ফরমেশনস অব দ্য সেক্যুলার (স্ট্যানফোর্ড, সানফ্রানসিসকো; স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৩, পৃ. ১৮৩, ন্যান্সি ফ্রেজার, ‘রিথিংকিং দ্য পাবলিক স্ফেয়ার: এ কনট্রিবিউশন টু দ্য ক্রিটিক অব অ্যাকচুয়ালি একজিসটিং ডেমোক্রেসি’, সোশ্যাল টেক্সট, নং ২৫/২৬ (১৯৯০); পৃ. ৫৬-৮০।
৭. দেখুন শীলা বেনহাবিব, ‘টুয়ার্ড এ ডেলিভারেটিভ মডেল অব ডেমোক্রেটিক লেজিটিমেসি’, ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডিফারেনসেস: কনটেসটিং দ্য বাউন্ডারিস অব দ্য পলিটিক্যাল, সম্পাদনা, শীলা বেনহাবিব (প্রিন্সটন, নিউজার্সি, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৬), পৃ. ৬৭-৯৪; চার্লস টেইলর, ফিলসফিক্যাল আর্গুমেন্টস (কেমব্রিজ, ম্যাসাচুসেটস: হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৫), টেইলর, ‘গ্রন্থিত জনপরিমণ্ডলের’ একটি নমুনা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, যেখানে বড় আকারের জনপরিমণ্ডলের মধ্যে ছোট আকারের জনপরিমণ্ডলগুলো গ্রন্থিত হয়ে জাতীয় জনপরিমণ্ডলের এজেন্ডায় অংশ নেয়। হেবারমাসও তাঁর মূল ধারণায়নে বাদ দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। (জারগেন হেবারমাস, ‘দ্য পাবলিক স্ফেয়ার: এন এনসাইক্লোপেডিয়া আর্টিকেল’, ক্রিটিক্যাল থিওরি অ্যান্ড সোসাইটি—রিডার, সম্পাদনা স্টিফেন এরিক ব্রোনার এবং ডগলাস কেলনার (নিউইয়র্ক: রাটলেজ, ১৯৮৯), পৃ. ১৩৬-১৪২; জারগেন হেবারমাস, ‘ফারদার রিফ্লেকশনস অন দ্য পাবলিক স্ফেয়ার’, হেবারমাস অ্যান্ড দ্য পাবলিক স্ফেয়ার, সম্পাদনা, ক্রেইগ ক্যালহুন (কেমব্রিজ: এমআইটি প্রেস, ১৯৯২), পৃ. ৪২১-৪৬১।
৮. স্যামুয়েল এন আইসেনস্ট্যাড, ‘কনক্লুডিং রিমার্কস: পাবলিক স্ফেয়ার, সিভিল সোসাইটি অ্যান্ড পলিটিক্যাল ডাইনামিকস ইন ইসলামিক সোসাইটিজ’, দ্য পাবলিক স্ফেয়ার ইন মুসলিম সোসাইটিজ, পৃ. ১৪০।
৯. মিশেল ফুকো, ‘টু লেকচারস’ পাওয়ার/নলেজ: সিলেকটেড ইন্টারভিউস অ্যান্ড আদার রাইটিংস, ১৯৭২-১৯৭৭, সম্পাদনা সি. গর্ডন (নিউইয়র্ক: প্যানথিয়ন, ১৯৮০), পৃ. ৭৮-১০৮।
১০. মুহাম্মদ আই আইয়স, দ্য নিউ আরব পাবলিক স্ফেয়ার (বার্লিন, ফ্রাঙ্ক অ্যান্ড টিম, ২০০৮), পৃ. ২৫।
১১. আইসেনস্ট্যাড, ‘কনক্লুডিং রিমার্কস’, পৃ. ১৪০।
১২. রবার্ট এসেন, ‘সিকিং দ্য ‘কাউন্টার’ ইন কাউন্টারপাবলিকস’, কমিউনিকেশন থিওরিস ১০, নং ৪ (নভেম্বর ২০০০), পৃ. ৪২৫।
১৩. রবার্ট এসেন অ্যান্ড ড্যানিয়েল ব্রাউয়ার সম্পাদিত, কাউন্টারপাবলিকস অ্যান্ড দ্য স্টেট (নিউইয়র্ক: স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক প্রেস, ২০০১), পৃ. ১৬১-৮৬।
১৪. চার্লস হারস্কিনড, দ্য এথিক্যাল সাউন্ডস্কেপ: ক্যাসেট সারমনস অ্যান্ড ইসলামিক কাউন্টারপাবলিকস (নিউইয়র্ক: কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৬)।
১৫. আইসেনস্ট্যাড, ‘কনক্লুডিং রিমার্কস’, পৃ. ১৪৮।
১৬. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৭।
১৭. এন্ড্রু এডগার, দ্য ফিলসফি অব হেবারমাস (মন্ট্রিল: ম্যাকগিল-কুইনস ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৫), পৃ. ৩৭।
১৮. ভিমাল দেশানায়েকে, সিনহালা নভেল অ্যান্ড দ্য পাবলিক স্ফেয়ার: থ্রি ইলাসট্রেটিভ মোমেন্টস (কলম্বো: ভিসিডুনু প্রকাশাকায়ো (প্রাইভেট) লি., ২০১০) এমএসসি ওকোলো, ‘কনটেস্টিং দি আফ্রিকান পাবলিক স্ফেয়ার: এ ফিলসফিক্যাল রিইমেজিং অব পাওয়ার অ্যান্ড রেসিস্ট্যান্স ইন গুগি’স উইজার্ড অব দ্য ক্রো’, আফ্রিকা ডেভেলপমেন্ট ৩৪, নং ২ (২০০৯); পৃ. ৫৯-৮০।
১৯. ফিকশন শব্দটি পুরো প্রবন্ধে ব্যবহূত হয়েছে একটি কল্পনামূলক সৃষ্টি অথবা একটি সাহিত্যিক কাজ হিসেবে, যার মূলকথা তৈরি হয় কল্পনা দ্বারা, যা সত্যের ওপর ভিত্তি করে হতে হবে এমন নয়। মেরিয়াম ওয়েবস্টারের অভিধানে ফিকশনকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে কল্পনা দ্বারা উদ্ভাবিত কোনো কিছুকে, নির্দিষ্ট করে বললে, একটি উদ্ভাবিত গল্পকে।
২০. যথাযথ পদ বা শব্দ না থাকায় ‘ইসলামিস্ট ফিকশন’ শব্দটি এখানে ব্যবহূত হয়েছে। মায়মুনা হক এসব ফিকশনকে ইসলামকেন্দ্রিক টেক্সট অর্থে বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে এসব উপন্যাসের উত্পাদক ও পাঠক এগুলোকে ইসলামি কাজ হিসেবে বিবেচনা করে। মায়মুনা হক, ‘ফ্রম পাইয়েটি টু রোমান্স: ইসলাম ওরিয়েন্টেড টেক্সট ইন বাংলাদেশ’,
নিউ মিডিয়া ইন দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড: দি ইমার্জিং পাবলিক স্ফেয়ার, সম্পাদনা ডেল ইকেলম্যান, জে ডব্লিউ এন্ডারসন এবং মার্ক টেসলার (ক্লমিংটন, ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৩), পৃ. ১২৯।
২১. এসব বইয়ের বিক্রেতারা ডিসেম্বর ২০০৫ এবং জানুয়ারি ২০০৮ সালে ব্যক্তিগত আলোচনায় আমার কাছে স্বীকার করেন যে তাঁরা প্রায়ই একই ক্রেতা বারবার পেয়ে থাকেন। এসব উপন্যাসের লেখকদের লেখা প্রতি সংস্করণের হাজার হাজার কপি বিক্রি হয় এবং প্রতি উপন্যাস এক বছরে কয়েকবার পুনর্মুদ্রিত হয়।
২২. হক, ‘ফ্রম পাইয়েটি টু রোমান্স’, পৃ. ১৫৫।
২৩. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪১।
২৪. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪২।
২৫. যেমনটি আগেও বলা হয়েছে অনেকে এগুলোকে ইসলামপন্থী না বলে ইসলামিক বলে আখ্যায়িত করেছেন।
২৬. ইসলামিক বুক ফিকশন, ‘সংজ্ঞা’ www.islamicfictionbook.com/defintions.html
২৭. পামেলা টেইলর, ‘কল ফর ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ইসলামিক ফিকশন’, Pettionspot.com, july 21 2006, www.petiyionspot.com/petitions/islamicfiction
২৮. হক, ‘ফ্রম পাইয়েটি টু রোমান্স’, পৃ. ১৪১।
২৯. মিশেল ওয়ার্নার, পাবলিকস অ্যান্ড কাউন্টারপাবলিকস (নিউইয়র্ক: জোন বুকস, ২০০২), পৃ. ৯০।
৩০. টেইলর, ‘কল ফর ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ইসলামিক ফিকশন’।
৩১. প্রথম সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৫; দ্বিতীয় সংস্করণ, জানুয়ারি ১৯৯৬।
৩২. হক, ‘ফ্রম পাইয়েটি টু রোমান্স’, পৃ. ১৪৭।
৩৩. নিয়মিত আকারে এসব থ্রিলার প্রকাশিত হওয়া দেখলে এদের জনপ্রিয়তা বোঝা যায়। ঢাকার বইবিক্রেতারা উত্সাহসহকারে এসব থ্রিলারের বহুল বিক্রির কথা বলেন। (২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় বইয়ের দোকানের কর্মচারীর সঙ্গে আলাপচারিতা)।
৩৪. islam-bd.org. 'Abul Asad', www.islam-bd.org/personalities/AbulAsad/ AbulAsad.html.
৩৫. আবুল আসাদ, পাত্তনির সবুজ অরণ্যে, সাইমুম সিরিজ ৪৩ (ঢাকা: বাংলা সাহিত্য পরিষদ, ২০০৬) পৃ. ৭৭।
৩৬. তৌহিদুল ইসলাম বাবু, অপারেশন সিরিজ (ঢাকা: প্রীতি প্রকাশন)। এটি উল্লেখ্য, এই বইগুলোর প্রকাশক আসাদ বিন হাফিজ।
৩৭. হাশেম রনি, সিক্রেট জোন (ঢাকা, খেয়া প্রকাশনী, ২০০৬)।
৩৮. মাসুদ রানা হচ্ছে কাজী আনোয়ারের একটি ফিকশন চরিত্র। এই প্রকাশনার শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে জেমস বন্ডের অনুকরণে, চরিত্রটি পরিপক্ব ও পরিবর্তিত হয়েছে তাত্পূর্যপূর্ণভাবে। এই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের শেষ পর্যন্ত ৩৭২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভবত এটি বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘ এবং বহুল পঠিত গোয়েন্দা থ্রিলার। প্রতি মাসে একটি নতুন বই প্রকাশিত হয়। এতে যৌনতার বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত থাকায় এটি একটি প্রাপ্তবয়স্ক সিরিজ হিসেবে পরিচিতি পায়। সিরিজটি তরুণ পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়, বিশেষ করে যাদের পক্ষে ইংরেজি থ্রিলার পড়া সহজ নয়। অনেক ইসলামপন্থী মনে করেন, এটি ক্ষয়িষ্ণু সাহিত্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ এবং অভিযোগ করেন যে এ সিরিজ অধার্মিকতাকে এবং উচ্ছৃঙ্খলতাকে উত্সাহিত করে। এই সিরিজবিষয়ক পরিচিতিমূলক আলোচনার জন্য দেখুন মাহমুদ রহমান, ‘মাসুদ রানা: সুপার স্পাই অব ট্রান্সপ্ল্যান্ট ফিকশন’, ডেইলি স্টার, ১০ মার্চ ২০০৭।
৩৯. আবুল আসাদের সাইমুম থ্রিলার সিরিজের বেশ কিছু উপাখ্যান থেকে এই বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো সুস্পষ্টভাবে চিত্রায়িত হয়েছে আহমেদ মুসা ও জোসেফিনের মধ্যকার টেলিফোন আলোচনায়, যা রয়েছে সিরিজের ৪২তম বই ডুবো পাহাড়-এ। আবুল আসাদ, ডুবো পাহাড় (ঢাকা: বাংলা সাহিত্য পরিষদ, ২০০৬), পৃ. ৬-৯।
৪০. ইসলামি নারীবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে এর সংজ্ঞা নিয়ে উল্লেখযোগ্য মতপার্থক্য থাকলেও এটি একটি বিকাশমান গবেষণা ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। মূল কাঠামো ও প্রধান যুক্তিগুলোর জন্য দেখুন, আমিনা ওয়াদুদ, কোরআন অ্যান্ড উইমেন: রি-রিডিং দ্য সেক্রেড টেক্সট ফর আ উইম্যানস পারসপেকটিভ (নিউইয়র্ক: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৯), পৃ. ৬৯-৭৮; আজিজাহ আল হিবরি, অ্যান ইনট্রোডাকশন টু মুসলিম উইমেনস রাইটস, উইন্ডোস অব ফেইথ: মুসলিম উইমেন স্কলার—অ্যাকটিভিস্ট ইন নর্থ আমেরিকা, সম্পাদনা গিসেলা ওয়েব (সিরাক্যুস, নিউইয়র্ক: সিরাক্যুস ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০০) পৃ. ৬৩-৬৫; রিফাত হাসান, ‘মুসলিম উইমেন অ্যান্ড পোস্ট-পেট্রিয়ার্ক্যাল ইসলাম’, আফটার পেট্রিয়ার্কি: ফেমিনিস্ট ট্রান্সফরমেশনস অব দ্য ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়নস, সম্পাদনা পলা এম কোইই, উইলিয়াম আর একিন এবং জে বি ম্যাকড্যানিয়েল (ম্যারিনল, নিউইয়র্ক; অরবিস বুকস, ১৯৯১), পৃ. ৫৪-৫৭; আসমা বারলাস, ‘বিলিভিং উইমেন’, ইসলাম: আনরিডিং পেট্রিয়ার্ক্যাল ইন্টারপ্রিটেশনস অব দ্য কোরআন, (অস্টিন: ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস প্রেস, ২০০২), পৃ. ১৮৪-১৮৯; কেসিয়া আলী, সেক্সুয়াল এথিকস অ্যান্ড ইসলাম: ফেমিনিস্ট রিফ্লেকশনস অন কোরআন, হাদিস অ্যান্ড জুরিসপ্রুডেন্স (অক্সফোর্ড, ওয়ানওয়ার্ল্ড, ২০০৬), পৃ. ১১৭-১২৬; সা’দিয়া শেখ, ‘এক্সেগেটিক্যাল ভায়োলেন্স: নুসুজ ইন কোরআনিক জেন্ডার আইডিওলজি’, জার্নাল ফর ইসলামিক স্টাডিজ ১৭ (১৯৯৭), পৃ. ৪৯-৭৩; ফাতিমা মারনিসি, ‘ফেমিনিটি এজ সাবভারসন: রিফ্লেকশনস অন দ্য মুসলিম কনসেপ্ট অব নুসুজ,’ স্পিকিং অব ফেইথ: উইমেন, রিলিজিয়ন অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ, সম্পাদনা ডায়না এল ইক (ফিলাডেলফিয়া: নিউ সোসাইটি পাবলিশার্স, ১৯৮৬)।
৪১. যদিও মূল কাঠামোটি এখনো একটি শিরোনাম দ্বারা চিহ্নিত করা যায়নি, কিন্তু বিকল্প শব্দ না থাকায় আমি এই শব্দটি ব্যবহার করেছি; সচরাচর গবেষণাগুলো এই দিকটির ওপর জোর দেয়, যদিও আমি মনে করি ধর্মানুরাগের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়।
৪২. সাবা মাহমুদ, পলিটিকস অব পাইয়েটি: দি ইসলামিক রিভাইভাল অ্যান্ড দ্য ফেমিনিস্ট সাবজেক্ট (প্রিন্সটন, নিউজার্সি; প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৫।
৪৩. লারা দিব, অ্যান এনচানটেড মডার্ন: জেন্ডার অ্যান্ড পাবলিক পাইয়েটি ইন শিয়া লেবানন (প্রিন্সটন, নিউজার্সি; প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৬)।
৪৪. মাহমুদ, পলিটিকস অব পিয়েটি, পৃ. ২।
৪৫. মায়মুনা হক, ‘রিডিং দ্য কোরআন ইন বাংলাদেশ: দ্য পলিটিকস অব ‘বিলিফ’ অ্যামং ইসলামিস্ট উইমেন’, মডার্ন এশিয়ান স্টাডিজ ৪২, নং ২/৩ (২০০৮), পৃ. ৪৫৭-৪৮৮; মায়মুনা হক, ‘টকিং জিহাদ অ্যান্ড পাইয়েটি: রিফরমিস্ট এক্সারশনস অ্যামং ইসলামিস্ট উইমেন ইন বাংলাদেশ’, জার্নাল অব দি রয়্যাল এনথ্রোপলজিক্যাল ইনস্টিটিউট ১৫, স্পেশাল ইস্যু: ইসলাম, পলিটিকস, এনথ্রোপলজি, অতিথি সম্পাদনা, ফিলিপ ওসেলা এবং বেঞ্জামিন সোর্স, ইস্যু সাপ্লিমেন্টস ১ (মে ২০০৯): এস১৬৩-৮২; সামিয়া হক এবং সাবিনা ফায়েজ রশিদ, ‘রিফ্যাশনিং ইসলাম: এলিট উইমেন অ্যান্ড পিয়েটি ইন বাংলাদেশ,’ কনটেম্পরারি ইসলাম ২ (২০০৮): ৭-২২; সামিয়া হক এবং সাবিনা ফায়েজ রশিদ, ‘নেগোশিয়েটিং ইসলাম: কনজারভেটিজম, স্পিলন্টার্ড অথরিটি অ্যান্ড এম্পাওয়ারমেন্ট ইন আরবান বাংলাদেশ,’ আইডিএস বুলেটিন ৪১, নং ২, স্পেশাল ইস্যু: নেগোশিয়েটিং এম্পাওয়ারমেন্ট (মার্চ ২০১০): ৯৭-১০৫; ইলোরা শেহাবুদ্দিন, রিশেপিং দ্য হলি: ডেমোক্রেসি, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড মুসলিম উইমেন ইন বাংলাদেশ (নিউইয়র্ক: কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৮; সারাহ সি. হেয়াইট, ‘ডোমেইনস অব কনটেস্টেশন: উইমেনস এম্পাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড ইসলাম ইন বাংলাদেশ, উইমেনস স্টাডিজ ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ৩৩ (২০১০): ৩৩৪-৪৪)।
৪৬. ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গ্রামীণ এলাকায় এ রকম একটি দলের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তারা তাদের পরিচয় দেয় তালিম গ্রুপ হিসেবে। আমাদের কথোপকথনে মহিলা জানায় যে তারা একটি দলের সদস্য, যেখানে একটি শিক্ষিত কিন্তু ‘সাধারণ’ নারী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে প্রতি মাসে আসেন। তাঁরা ইসলাম ও নারীদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন এবং ওই মহিলা সেই আলোচনায় নেতৃত্ব দেন। ২০১০ সালের শুরুর দিকে ঢাকায় আমি মধ্যবিত্ত শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষিত মহিলার সঙ্গে কথা বলি, এঁদের সবারই পরিবার রয়েছে। এসব মহিলা আমাকে জানান যে তাঁরা নিয়মিত একটি পাঠচক্রে অংশগ্রহণ করেন। এই পাঠচক্র মাসে কমপক্ষে একবার মিলিত হয়, কখনো কখনো দুবারও বৈঠক হয়। একজন ‘জ্ঞানী মহিলা’ তাঁদের আলোচনা ‘এগিয়ে নেন’। আর যাঁদের সঙ্গে আমি কথা বলি তাঁর মধ্যে ছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। তাঁদের একটি গ্রুপ রয়েছে, যাঁরা নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্র হন, যাঁরা একজন তরুণ মুসলিম মহিলা বাংলাদেশের মতো সমাজে কী ভূমিকা রাখতে পারেন তা নিয়ে চিন্তাভাবনা ও আলাপ-আলোচনা করেন। তাঁরা জানান যে এটি শুধু স্রেফ প্রশ্ন-উত্তরের বৈঠক নয়, বরং অংশগ্রহণকারীরা কোরআন, হাদিস ও ইসলামি চিন্তাবিদদের টেক্সট পড়ে তাঁদের মতামত দেন ও আলোচনায় অংশ নেন। পাঠ্যসূচিতে আবুল আলা মওদুদীর বইও রয়েছে। ছাত্রীরা, বিশেষ করে তাঁদের মধ্যে একজন, বারবার জোর দিয়ে বলেন যে তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রী সংস্থার সদস্য নন।
৪৭. প্রথম আলোর প্রদায়ক, কুর্রাতুল-আইন-তাহিমনার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনা, এপ্রিল ২৪, ২০০৯। তাহিমনা প্রথম আলোতে এ ঘটনার রিপোর্ট করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি যশোর জেলার শার্শা উপজেলার ডিহি ইউনিয়নের এ ধরনের একটি গ্রুপের ওপর রিপোর্ট করেন।
৪৮. ইলোরা শেহাবুদ্দিন, রিশেপিং দ্য হলি, পৃ. ১৯৩-১৯৫, ২০৪-২০৬।
৪৯. হক, ‘রিডিং দ্য কোরআন ইন বাংলাদেশ,’ ৪৬০, আশরাফ আলী থানভীর লেখা বেহেশতি জেওর, হেভেনলি অর্নামেন্টস (নিউ দিল্লি, তাজ পাবলিশার্স, ২০০২) বইটি দাবি করে যে এটি ধর্মীয় জীবনের একটি নির্দেশিকা। যদিও আশরাফ আলী থানভী যুক্তি দেখান যে নারীদের শিক্ষিত হওয়া দরকার, কিন্তু তিনি তীব্রভাবে নারীদের জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষার বিরোধিতা করেন। তিনি উপদেশ দেন যে মুসলমানদের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ব্যক্তিকে বিয়ে করতে দেওয়ার বদলে তাঁদের কন্যাদের বেশ্যালয়ে পাঠানো উচিত।
৫০. আমিনা ওয়াদুদ, ‘পলিটিকস অব পাইয়েটি: দি ইসলামিক রিভাইভাল অ্যান্ড দ্য ফেমিনিস্ট সাবজেক্ট’, জার্নাল অব দি আমেরিকান একাডেমি অব রিলিজিয়ন ৭৪, নং ৩ (সেপ্টেম্বর ২০০৬); পৃ. ৮১৫-৮১৮।
৫১. এই বইটির রিভিউ এবং এ বিষয়ের ওপর আলোচনার জন্য দেখুন, উসামা মাকদিসি,
‘রিয়েল মুসলিমস, রিয়েল লাইভস;’ এমআরজাইন, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৮; www.mrzine.monthlyreview.org/2008/makdisil60208.html
৫২. হক, ‘রিডিং দ্য কোরআন ইন বাংলাদেশ’ পৃ. ৪৫৭।
৫৩. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৯।
৫৪. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৯।
৫৫. হক অ্যান্ড রশিদ, ‘রিফ্যাশনিং ইসলাম’।
৫৬. যদিও এই দলটি দাবি করে যে এটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রচেষ্টা এবং তাদের কোনো রাজনৈতিক ঝোঁক নেই, কিন্তু ব্যবহূত পাঠ্যপুস্তক জামায়াতে ইসলামীর প্রতি দলটির ঝোঁক নির্দেশ করে। এ দলে পঠিত ও আলোচিত বইগুলো আবুল আলা মওদুদীর লেখা। হক ও রশিদ বলেন, ‘যদিও অংশগ্রহণকারীরা তাদের পছন্দমাফিক কোরআনের অনুবাদ নিয়ে আসতে পারেন, কিন্তু শিক্ষক এবং অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর ‘দি মিনিং অব কোরআন’ শীর্ষক অনুবাদ ও ব্যাখ্যা অনুসরণ করেন। (হক অ্যান্ড রশিদ, ‘রিফ্যাশনিং ইসলাম,’ পৃ. ৯)।
৫৭. হক অ্যান্ড রশিদ, ‘রিফ্যাশনিং ইসলাম’, পৃ. ৮।
৫৮. হক অ্যান্ড রশিদ, ‘রিফ্যাশনিং ইসলাম’, পৃ. ২০।
৫৯. উদ্ধৃত প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫।
৬০. হালাকা অথবা পাঠচক্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে এবং সম্ভবত উত্তর আমেরিকার অন্য মুসলমানদের কাছেও নিয়মিত বিষয় হয়ে উঠছে। এ ধরনের অনেক গ্রুপ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে তৈরি। এসব অনেক গ্রুপ জেন্ডার অনুযায়ী ভাগ হয়ে মিলিত হয়, আবার অনেকগুলোতে নারী ও পুরুষেরা একসঙ্গে বৈঠক করে।
৬১. জেনিন ক্লার্ক, ‘ইসলামিক উইমেন ইন ইয়েমেন: ইনফরমাল নোডস অব অ্যাকটিভিজম’, ইসলামিক অ্যাকটিভিজম: এ সোশ্যাল মুভমেন্ট থিওরি অ্যাপ্রোচ, সম্পাদনা, কুইন্টান উইকটোরউজ (ব্লুমিংটন: ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৪), পৃ. ১৬৪-১৮৪।
৬২. সাদাফ আহমেদ, ‘আইডেনটিটি ম্যাটারস, কালচার ওয়ারস: অ্যান অ্যাকাউন্ট অব আল হুদা, (রি) ডিফাইনিং আইডেনটিটি অ্যান্ড রিকনফিগারিং কালচার ইন পাকিস্তান’, কালচার অ্যান্ড রিজিয়ন ৯, সংখ্যা ১ (২০০৮); পৃ. ৬৩-৮০।
৬৩. ইয়াসমিন মোল, ‘পিপল লাইক আস’ ইন পারসুট অব গড অ্যান্ড রাইটস: ফেমিনিস্ট ডিসকোর্স অ্যান্ড সিসটারস ইন ইসলাম ইন মালয়েশিয়া’, জার্নাল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ ১১, সংখ্যা ১ (২০০৯); পৃ. ৪০-৫৫।
৬৪. সিলভিয়া ফ্রিস্ক, ‘ক্লেইমিং রিলিজিয়াস স্পেস: মালয় উইমেন অ্যান্ড দ্য ট্রান্সফরমেশন অব রিচুয়ালস ইন আরবান কনটেক্সট’, এনআইএএস-নিট এশিয়া ইনসাইট (নরডিক ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ), নং ৪ (২০০৪): পৃ. ১০-১১।
৬৫. এমপ্রোন মারড্যান্ট, ‘জেন্ডারিং পাইয়েটি অব মুসলিম উইমেন ইন থাইল্যান্ড’, Silapatsamnuk, ৭ম বর্ষ, ১৯ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ৩৭-৪৩, ২০০৭।
৬৬. র্যাইচেল রিনাল্ডো, ‘দ্য ইসলামিক রিভাইভাল অ্যান্ড উইমেনস পলিটিক্যাল সাবজেকটিভিটি ইন ইন্দোনেশিয়া’, উইমেনস স্টাডিজ ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ৩৩ (২০১০): পৃ. ৪২২-৩১।
৬৭. আল-মুসলিমাত: শ্রীলঙ্কার মুসলিম নারী সমিতি এবং আল মুসলিমাত উদ্বোধন প্রকল্পের সুভেনির। ‘মুসলিম উইমেন ইন দ্য মিডস্ট অব চেঞ্জ’, ৩০ নভেম্বর ১৯৯১ উদ্ধৃত হয়েছে, ফারজানা হানিফা, ‘পাইয়েটি এজ পলিটিকস অ্যামং মুসলিম উইমেন ইন কনটেম্পরারি শ্রীলঙ্কা’, মডার্ন এশিয়ান স্টাডিজ ৪২, নং ২/৩ (২০০৮); পৃ. ৩৫৩।
৬৮. সামাহ সেলিম, ‘বুক রিভিউ: পলিটিকস অব পাইয়েটি: দ্য ইসলামিক রিভাইভাল অ্যান্ড দ্য ফেমিনিস্ট সাবজেক্ট’, জাদালিয়া, ১২ নভেম্বর ।
৬৯. হক স্বীকার করেন যে তাঁর পর্যবেক্ষণ করা দলটির সদস্যদের ধারণা, অন্যান্য ধর্মানুরাগী আন্দোলন যেমন তাবলীগ কিংবা সাবা মাহমুদের গবেষণার বিষয় মসজিদ আন্দোলনের চেয়ে ভিন্ন। হক, ‘টকিং জিহাদ অ্যান্ড পাইয়েটি’, এস ১৭৭।
৭০. প্রাগুক্ত, এস ১৭৬।
৭১. এনজিও এবং তাতে নারীদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে ইসলামপন্থীদের বিরোধিতা নিয়ে প্রচুর আলোচনা রয়েছে। আমি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি গড উইলিং: দ্য পলিটিকস অব ইসলামিজম ইন বাংলাদেশ গ্রন্থে (লেনহাম, মেরিল্যান্ড: রোওম্যান অ্যান্ড লিটলফিল্ড, ২০০৪); আরও দেখুন তাজ আই হাশমী, উইমেন অ্যান্ড ইসলাম ইন বাংলাদেশ, রিয়ন্ড সাবজেকশন অ্যান্ড টাইরানি (নিউইয়র্ক: প্যালগ্রেভ ম্যাকমিলান, ২০০০), পৃ. ১৩৪-১৭৯; ইলোরা শেহাবুদ্দিন, রিশ্যাপিং দ্য হলি: ডেমোক্রেসি, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড মুসলিম উইমেন ইন বাংলাদেশ (নিউইয়র্ক, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৮), পৃ. ১১১-১১৫।
৭২. মওদুদীর দৃষ্টিতে নারীদের অবস্থানের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, লামিয়া রুস্তম শেহাদেহ, দ্য আইডিয়া অব উইমেন আন্ডার ফান্ডামেন্টালিস্ট ইসলাম, (গেইনেসভিল: ইউনিভার্সিটি প্রেস অব ফ্লোরিডা, ২০০৩), পৃ. ২৩-৪৮; রয় জ্যাকসন, মাওলানা মওদুদী অ্যান্ড পলিটিক্যাল ইসলাম (লন্ডন, রাটলেজ, ২০১১), পৃ. ১৩৩-১৩৯।
৭৩. অ্যান সোফি রোয়াল্ড, ‘ফেমিনিস্ট রিইন্টারপ্রিটেশন অব ইসলামিক সোর্সেস: মুসলিম ফেমিনিস্ট থিওলজি ইন দ্য লাইট অব দ্য ক্রিশ্চিয়ান ট্র্যাডিশন অব ফেমিনিস্ট থট’, উইমেন অ্যান্ড ইসলামাইজেশন: কনটেম্পরারি ডাইমেনশনস অব ডিসকোর্স অন জেন্ডার রিলেশনস, সম্পাদনা করিম আসক এবং মারিট টমসল্যান্ড (অক্সফোর্ড এবং নিউইয়র্ক: বার্গ, ১৯৯৮), পৃ. ১৮-১৯।
৭৪. আমি এই পয়েন্টটা নিলুফার গোলের কাছ থেকে নিয়েছি। নিলোফার গোলে, ‘স্ল্যাপশটস অব ইসলামিক মডার্নিটি’, ম্যাল্টিপল মডার্নিটিজ, সম্পাদনা সুমেল এন আইসেনস্ট্যাড (নিউ ব্রন্সউইক, নিউজার্সি: ট্রান্সজেকশন পাবলিশার্স, ২০০২), পৃ. ১১১।
৭৫. ডেল এফ আইকেলম্যান, ‘দ্য কামিং ট্রান্সফরমেশন অব দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড’, ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট ওয়্যার (ফিলাডেলফিয়া, পেনসিলভানিয়া) ৭, সংখ্যা ৯ (আগস্ট ১৯৯৯),
৭৬. ফ্রেজার, ‘রিথিংকিং দ্য পাবলিক স্ফেয়ার’, পৃ. ৬৭।
৭৭. শেহাদেহ, দ্য আইডিয়া অব ওমেন আন্ডার ফান্ডামেন্টালিস্ট ইসলাম, পৃ. ২৯।
৭৮. গোলে, ‘স্ন্যাপশটস অব ইসলামিক মডার্নিটি’, পৃ. ১০১।
এই লেখার ইংরেজি ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছে ২০১৩ সালে গ্লোবাল চেঞ্জ, পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি জার্নালে; বাংলা ভাষ্য তৈরিতে সহযোগিতার জন্য লেখক সিফাত বিন সাদেকের কাছে কৃতজ্ঞ।
Content Courtesy: