প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে না থাকার বিষয়েও ভাবা হচ্ছে
রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একনায়কতন্ত্রের অবসানের বিষয়টি সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে বলে জানালেন এ সংক্রান্ত কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এ জন্য ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, নাগরিক অধিকার, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ব্যক্তির সুবিচার নিশ্চিত করা এবং বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ-সংবলিত প্রস্তাব তৈরি করছেন তারা। পাশাপাশি একই ব্যক্তি একাধিক পদ অধিকার করে যাতে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না পারেন, সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে না থাকার বিষয়েও ভাবা হচ্ছে।
সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক আলী রীয়াজ এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি জানান, সরকারের বেঁধে দেওয়া সময় আগামী ৭ জানুয়ারির মধ্যেই তারা সংস্কার প্রস্তাব ও সুপারিশের খসড়া জমা দেবেন।
গত মঙ্গলবার দেওয়া এ সাক্ষাৎকারে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ আরও জানান, এই সুপারিশ প্রণয়নের ক্ষেত্রে তারা অংশীজন হিসেবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২৮টি রাজনৈতিক দল, জোটসহ অন্যান্য দল ও সংগঠন লিখিত প্রস্তাব জমা দিয়েছে। কমিশনের নিজস্ব ওয়েবসাইট এবং বিবিএসের সহযোগিতায় জনমত জরিপের মাধ্যমে প্রায় এক লাখ মানুষের মতামত নিয়েছেন। সবার মতামতকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেই সংস্কার প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য কমিশন ১২১টি দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করে দেখেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যাকারী দল আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থক এবং গত ১৫ বছরে স্বৈরশাসনের সহযোগী ও বৈধতা দানকারী দল ও সংগঠনের কাছ থেকে কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। এই নীতি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রক্ত ও প্রাণ দেওয়া মানুষই তৈরি করে দিয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন সেই নীতিই অনুসরণ করেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। তারা রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রমের লক্ষ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। যার মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয়েছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী রীয়াজকে। সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কমিশনের কার্যক্রম ও তাদের প্রস্তাবের বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করেছেন আলী রীয়াজ।
সংস্কার প্রস্তাব তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেতে যাওয়া বিষয়গুলো তুলে ধরতে গিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা যেখানটায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি, যেটা আমাদের অংশীজনরা বলেছেন এবং আমাদের বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা থেকেও বেরিয়ে এসেছে, সেটা হচ্ছে, সংবিধানে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ না ঘটে। কারণ আমরা দেখেছি, বাহাত্তর সালের সংবিধান থেকেই এবং বিশেষত পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ ঘটেছে। আমরা একটা ব্যক্তিতান্ত্রিক একনায়কত্বের মধ্যে গত ১৫ বছরের বেশি সময় কাটিয়েছি। ফলে সাংবিধানিকভাবেই ক্ষমতার ভারসাম্য ও জবাবদিহির জন্য প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সংবিধানে নাগরিক অধিকারগুলোও সুনিশ্চিত করা দরকার। আমরা দেখেছি, বিগত সময়ে নাগরিক অধিকারগুলো বিভিন্নভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। সেই প্রক্রিয়াটাও আসলে বাহাত্তর সালের সংবিধান থেকেই দেখতে পাই। যতটা নাগরিক অধিকার ও মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে, তার ওপর তত বেশি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। তাতে সামগ্রিকভাবে এই অধিকারগুলো আর থাকেনি। কাজেই সংবিধানে নাগরিকদের অধিকার সুনিশ্চিত করার কৌশল ও পথ কী কী হতে পারে, সেগুলো আমরা বের করার চেষ্টা করছি।’
আলী রীয়াজ বলেন, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার মধ্যে কিছু প্রতিশ্রুতি ছিল– সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার। সেটাকে আমরা বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান বলব। কিন্তু মানুষের সুবিচার নিশ্চিত করা যায়নি। তার অন্যতম কারণ, বিচার বিভাগ আসলে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। যদিও বাহাত্তরের সংবিধান ও পরবর্তী সময়ে বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের একটা পার্থক্য ও দূরত্ব তৈরি করা এবং স্বাধীনতা দেওয়ার কথা বলা আছে। কিন্তু আবার সংবিধানের মধ্যেই সেটা বিভিন্নভাবে কার্যকর না করার ব্যবস্থা দেওয়া আছে। সেই কারণে যেভাবেই হোক, সুবিচার নিশ্চিত করতে হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বিচারের সুযোগটা (অ্যাক্সেস টু জাস্টিস) যতটা সম্ভব সবার কাছে নিয়ে আসতে হবে। তার মানে হচ্ছে, বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। আমরা এই জিনিসগুলো খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার মধ্যে নিয়েছি এবং সেভাবেই আমাদের সুপারিশগুলো তৈরি করার চেষ্টা করেছি।’
সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন মহলের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ক্ষমতার ভারসাম্যটা কেবল রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে হলেই হবে না। কেননা, আমরা এটাও দেখতে পাই, একই ব্যক্তি একাধিক পদ অধিকার করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন। যেমন প্রধানমন্ত্রী একাধারে দলের নেতা, দলের প্রধান, সংসদ নেতা ইত্যাদি হওয়ায় তাঁর হাতে যে ক্ষমতা যায়, সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করাটা খুব সহজেই সম্ভব হয়। তাতে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। এগুলোকেও বিবেচনায় নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘৭০ অনুচ্ছেদ থাকবে। কিন্তু ৭০ অনুচ্ছেদ যে আকার ও প্রকৃতিতে আছে এবং যেভাবে সংসদ সদস্যদের হাত-পা বেঁধে দিয়ে ব্যক্তির অধীন করে ফেলা হয়েছে, সেখান থেকে এটাকে বের করতেই হবে। কারণ ৭০ অনুচ্ছেদ যেভাবে আছে, সেভাবে রেখে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ এবং শক্তিশালী ও স্বাধীন সংসদ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আমরা এটাও দেখেছি, বিদ্যমান ৭০ অনুচ্ছেদ গণতান্ত্রিক সংবিধান এবং গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য সঠিক নয়। ফলে এখানে একটা বড় রকমের পরিবর্তন আসবে। কিন্তু ৭০ অনুচ্ছেদ থাকবে। এই অর্থে থাকবে– ৭০ অনুচ্ছেদ বলে একটা কিছু তো থাকবে।’
সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিধান থাকা-না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে বিভিন্ন রকম মত আমরা পেয়েছি। সেগুলো আমরা বিবেচনা করছি।’
সংবিধানের চার মূলনীতি প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে আদর্শগুলো চিহ্নিত হয়েছে কিংবা যে আদর্শগুলোর ভিত্তিতে একটা জনযুদ্ধ সম্পাদিত হয়েছিল, তার মর্মবস্তু বাহাত্তরের সংবিধানে যথাযথভাবে উল্লিখিত হয়নি। ফলে এই বিষয়টিও আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি এবং অংশীজনদের বক্তব্য নিচ্ছি। আর বিবেচনার ক্ষেত্রে আমরা শুধু দেশের অংশীজনদের বক্তব্যই নিচ্ছি না। আমরা বাংলাদেশসহ ১২১টি দেশের সংবিধানকে পর্যালোচনা করে দেখেছি। সেগুলোতে এসব জায়গা কীভাবে আছে, কতটা আছে, কেন আছে– সেগুলোও আমরা বিশ্লেষণ করেছি। তার আলোকে আমরা কিছু সুপারিশ দেব।’
তিনি বলেন, ‘সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে আমরা প্রস্তাব দেব, কিছু সুপারিশও করব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব প্রস্তাব ও সুপারিশের কতটা গৃহীত হবে, সেটা তো আমরা বলতে পারছি না। বলার সুযোগও নেই। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, আমরা সুপারিশের ক্ষেত্রে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা এবং দেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকেই প্রাধান্য দিয়েছি।’
News Courtesy: