সামরিক আইন জারি রুখে দিয়ে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার যে শিক্ষা দিল দ. কোরিয়া
দক্ষিণ কোরিয়ায় যা ঘটছে, তা আমাদের সবার মনোযোগ দাবি করে বিভিন্ন কারণে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এ ঘটনা প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল এবং পার্লামেন্টের মধ্যে ক্ষমতার বিরোধকে স্পষ্ট করে তুলেছে। গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সাধারণ নাগরিকেরা দ্বিধাহীনভাবে গভীর রাতে রাস্তায় নেমে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সাময়িকভাবে হলেও বিজয় অর্জন করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে ঘটনাপ্রবাহ দেখাচ্ছে যে রাজনীতিতে গভীর মেরুকরণের ফল গণতন্ত্রের জন্যই হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
ঘটনার সূত্রপাত হয় মঙ্গলবার যখন প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল টেলিভিশনে দেওয়া এক বক্তৃতায় বলেন যে দেশকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি’ এবং ‘উত্তর কোরিয়ার হুমকি’ থেকে রক্ষার জন্য তিনি সামরিক আইন জারি করছেন। প্রেসিডেন্ট তাঁর বক্তৃতায় এই দুইয়ের কোনোটারই বিস্তারিত কিছু বলেননি এবং উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে কোনো ধরনের হুমকির কথা আর কোনো সূত্র থেকে জানা যায়নি। কিন্তু কোরিয়ার রাজনীতিতে যাঁরা নজর রাখেন, তাঁরা জানেন যে অতীতে প্রেসিডেন্ট বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে ‘উত্তর কোরিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। সামরিক আইন জারির ঘোষণার সময় তিনি বলেন তিনি উত্তর কোরিয়াপন্থী উচ্ছেদ করবেন।
দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০ বছর পর সামরিক আইন জারির ঘটনা ঘটল এবং ১৯৮৭ সাল থেকে কোরিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ ছিল অকল্পনীয়। সামরিক আইন জারির এ ঘোষণার পরপরই রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু হয় এবং বিরোধী দলের একজন নেতা ইউটিউবে পার্লামেন্ট সদস্যদের পার্লামেন্ট ভবনে আসার আহ্বান জানান।
এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেনাবাহিনীর বাধা উপেক্ষা করে সংসদ সদস্যরা এক অধিবেশনে মিলিত হয়ে সামরিক আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস করেন। এ প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সামরিক আইন প্রত্যাহারে বাধ্য হন।
ইতিমধ্যে প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিম ইয়ং-হিউন পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু তা যে যথেষ্ট নয় তা বোঝা যায় পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্টের বিরোধী ছয়টি দল ইউন সুক-ইওলের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট বা অনাস্থা জ্ঞাপনের (সংসদীয় পদ্ধতিতে বিচার) প্রস্তাব এনেছে।
৩০০ আসনের পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্টের দল পিপল পাওয়ার পার্টির ১০৮টি আসন আছে এবং ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব পাস হতে লাগবে ২০০ ভোট; তার অর্থ হচ্ছে ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব পাস হতে কমপক্ষে আটজন সরকারপক্ষের সদস্যকে বিরোধীদের সঙ্গে যোগ দিতে হবে।
ইতিমধ্যে পিপল পাওয়ার পার্টির নেতা চু কিয়ং-হো বলেছেন যে তাঁর দলের সদস্যরা ইমপিচমেন্ট প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেবে। কিন্তু তাঁর এই দাবি শেষ পর্যন্ত টিকবে কি না, সেটা দেখার বিষয়। কেননা সামরিক আইন জারির পর সেনাবাহিনীর বাধা পেরিয়ে পার্লামেন্ট সদস্যরা যখন বৈঠক করেন, সেখানে উপস্থিত ছিলেন ১৯০ জন এবং তাঁরা সবাই প্রেসিডেন্টের সামরিক আইন জারির বিরুদ্ধেই ভোট দিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট যদি পদত্যাগ না করেন, তবে তাঁর বিরুদ্ধে রোববারের মধ্যেই ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব উত্থাপিত হবে। যদিও সামরিক আইন জারির বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাসে সরকার সমর্থক কিছু সদস্য ভোট দিয়েছেন কিন্তু তাঁরা ইমপিচমেন্ট প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেবেন কি না, সেটা এখন প্রশ্নের মুখে। পার্লামেন্টে ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব পাস হলে প্রেসিডেন্ট সাময়িকভাবে দায়িত্ব হারাবেন, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য তা যাবে সাংবিধানিক আদালতে, ৯ সদস্যের আদালতে ৬ জনের ভোট নির্ধারণ করবে ইউন সুক-ইওলের ভাগ্য। কিন্তু এই আদালতে এখন সদস্য সংখ্যা ছয়জন। তিনজন সদস্যের অনুপস্থিতি এই প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব পড়বে কি না, সেটা অস্পষ্ট।
সাংবিধানিক আদালতের এই নয়জন সদস্য হন এমন ব্যক্তিরা, যাঁরা বিচারক হওয়ার যোগ্য। এর তিনজনকে মনোনয়ন দেন প্রেসিডেন্ট, তিনজনকে মনোনয়ন দেন প্রধান বিচারপতি এবং তিনজন মনোনীত হন পার্লামেন্ট দ্বারা। এই আদালতের ব্যবস্থা ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়াকে অনেকাংশে রাজনীতির বাইরে নিয়ে যায় এবং কেবল পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের বিচারের ওপর নির্ভরশীল করে না।
প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ধরনের তদন্ত শুরু হয়েছে। যা একধরনের ভাগ্যের পরিহাস বলেই মনে হয়। কেননা প্রসিকিউটর জেনারেল হিসেবে ইউন সুক-ইওল আগে সাবেক দুজন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এবং তাঁদের দণ্ডিত করতে সক্ষম হয়েছেন। এর মধ্যে তাঁর নিজের দলের সাবেক প্রেসিডেন্ট পার্ক গুয়েন হুও ছিলেন, পার্ক ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
গত কয়েক দিনের ঘটনার উৎস প্রকৃতপক্ষে ২০২২ সালে যখন ইউন সুক-ইওল মাত্র শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী লি জেই-মুয়িংকে পরাজিত করেন। রক্ষণশীল ইউন সুক-ইওল এই সামান্য ব্যবধানে বিজয় সত্ত্বেও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে কোনো ধরনের আপসের ব্যাপারে উৎসাহ দেখাননি, যদিও পার্লামেন্টে ডেমোক্রেটিক পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল।
২০২৪ সালের এপ্রিলের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টি তাঁদের আসন বাড়াতে সক্ষম হয়। লক্ষণীয়ভাবে দুই পক্ষ পরস্পরের প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষ ছড়িয়েছে এবং সমাজে বিভক্তি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। পরস্পর পরস্পরকে যেভাবে আক্রমণ করেছে এবং প্রেসিডেন্ট যেভাবে বিরোধীদের বিরুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ তুলেছেন, তা ক্ষতিকারক হয়েছে। বিরোধীরাও তাঁর বিরুদ্ধে অতিরঞ্জিত অভিযোগ এনেছে বলে বলা হয়।
প্রেসিডেন্ট ইউন যে ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি অনুসরণ করেছেন, সেগুলোর কারণে তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে। ফলে আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগের ভেতরে টানাপোড়েন কমার বদলে বেড়েছে। এগুলোই ক্রমান্বয়ে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে, যার প্রকাশ ঘটেছে প্রেসিডেন্টের সামরিক আইন জারির ঘোষণায়। আপসহীন মনোভাব নিয়ে এবং বিরোধীদের দেশপ্রেম বিষয়ে প্রশ্ন তুলে দেশ শাসনের চেষ্টা শেষ বিচারে দেশের জন্য ক্ষতি হয়েছে। আগামী কয়েক দিনে তা কোন দিকে মোড় নেয়, সেটা দেখার বিষয়।
এ ঘটনার কিছু ইতিবাচক দিক আছে, যেগুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার, যেগুলো গণতন্ত্রের জন্য শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। প্রেসিডেন্ট চাওয়া সত্ত্বেও তিনি দেশে সামরিক আইন জারি করতে পারেননি, তাঁর অন্যতম কারণ হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ এবং আইনসভার ভেতরে ক্ষমতার ভারসাম্য।
এটা দেখায় যে ক্ষমতার চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উপস্থিত থাকলে ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তির ইচ্ছেকে জনগণের প্রতিনিধিরা মোকাবিলা এবং পরাজিত করতে পারেন। নির্বাচনকে যদি আমরা ভার্টিক্যাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি বা খাড়াখাড়ি জবাবদিহি প্রদর্শন বলি, তবে পার্লামেন্টের এ ক্ষমতা হচ্ছে আড়াআড়ি জবাবদিহি প্রদর্শন। এ ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের সংবিধান পরিপন্থী পদক্ষেপকে আইনসভা মোকাবিলা করেছে, এর উল্টোও হওয়া সম্ভব।
দলের ওপর সরকারপ্রধানের একচ্ছত্র আধিপত্য না থাকায় পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্টের পার্টির কেউ কেউ সামরিক আইন জারির বিরুদ্ধে ভোট দিতে পেরেছেন। পার্লামেন্টে সদস্যরা এই ভূমিকা অব্যাহত রাখবেন কি না, সেটা আমার আগামী কয়েক দিনেই দেখব। নিজ দল/নেতার প্রতি আনুগত্য এবং গণতন্ত্র রক্ষার প্রশ্ন মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা একেবারে তিরোহিত হয়ে যায়নি।
দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকেরা ১৯৮০-এর দশকে সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে অব্যাহত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র অর্জন করেছিল এবং তার চর্চা করে আসছিল, কিন্তু এ ঘটনা আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে গণতন্ত্র কেবল অর্জনের বিষয় নয়, একে রক্ষা করার জন্য দরকার প্রতিদিনের নজরদারি এবং সংগ্রামের প্রস্তুতি। গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের শুরু থাকলেও তার কোনো শেষ নেই।
আলী রীয়াজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক।
News Courtesy:
Prothom Alo | December 6, 2024