জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সংবিধান পুনর্লিখন করতে হবে
জাতির সামনে এখন বড় প্রশ্ন, আবারও স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে কি না, তা মীমাংসা করা। কীভাবে এর সমাধান হবে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ প্রশ্ন দিয়েই তাঁর একক জনবক্তৃতা শুরু করে দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। একই সঙ্গে করণীয় সম্পর্কে নিজের অভিমত তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধানের পুনর্লিখন করতে হবে।
আজ শনিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার সেমিনার কক্ষে তিনি ‘গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশ সংবিধান: সংশোধন না পুনর্লিখন’ শীর্ষক এই একক জনবক্তৃতা দেন। ‘স্পিক বাংলাদেশ’ নামের একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে এই বক্তৃতার আয়োজন করা হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হতাহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আলী রীয়াজ বলেন, এই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষা হলো, দেশকে স্বৈরশাসনমুক্ত করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধানের পুনর্লিখন করতে হবে। কারণ এই সংবিধানের মধ্যেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার শক্তি অন্তর্নিহিত রয়েছে। সংবিধানের ছোটখাটো সংস্কার করে এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরশাসনের পথ রোধ করা যাবে না। তিনি বলেন, একবার সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতিকে পর্বতপ্রমাণ বিপুল ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। আরেক সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে সেই ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলের প্রধান, সংসদীয় দলের প্রধান ও সংসদনেতা হিসেবে চার রকমের ক্ষমতাবান হতে পারবেন। এই বিপুল ক্ষমতার কোনো জবাবদিহি নেই। এই প্রক্রিয়াতেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্রের পথ সুগম হয়েছে। এই প্রক্রিয়া রোধ করতে হলে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতে সংবিধানের পুনর্লিখন করতে হবে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বিদ্যমান সংবিধানের মধ্যে যে ভালো বিষয়গুলো রয়েছে তা রেখেই গণ-অভ্যুত্থানের জন–আকাঙক্ষা বাস্তবায়নের জন্য পুনর্লিখন করা যাবে। এখন রাষ্ট্র পুনর্গঠনের একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। সে জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনো সময়সীমা বেঁধে দিলে চলবে না। তবে তাঁরা পুনর্গঠনের কাজটি যথাযথ করছেন কি না, তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ তাঁরা নির্বাচিত হননি। দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁদের এই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত করার নিশ্চয়তার বিধান করতে হবে উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করাও অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, মাত্র ৩২ শতাংশ জনমত নিয়ে নির্বাচিত সরকারের সংবিধান সংশোধন করার ক্ষমতা পাওয়া যুক্তিসংগত নয়। এই প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হলে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, শ্রেণিভিত্তিক আসন—এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এ ছাড়া তিনি সংসদের মেয়াদ চার বছর করা এবং প্রতি দুই বছর অন্তর পর্যায়ক্রমে দুই কক্ষের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেন। একই সঙ্গে তিনি নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনব্যবস্থার অবসান করে আসন ভিত্তিতে নারীদের সরাসরি নির্বাচনব্যবস্থার কথা বলেন। তবে যে ধরনের পুনর্গঠন ও পুনর্লিখন প্রক্রিয়াই শুরু করা হোক না কেন, তাতে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণের মতামত গ্রহণ ও তাদের অংশীদারত্ব নিশ্চিত করার ওপরে জোর দেন। তিনি আরও বলেন, ‘গণতন্ত্র’ একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর সুবিধা হলো, ভুল হলে সংশোধন করা যায় এবং সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করে তোলা যায়।
একক বক্তৃতার আগে লেখক মুহাম্মদ সজলের সভাপতিত্বে আয়োজনে ‘স্পিক বাংলাদেশ’–এর আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন লেখক রেজাউল করিম, বিশেষ বক্তা ছিলেন মিয়াজ মেহরাব তালুকদার ও ডেল এইচ খান। সঞ্চালনা করেন আলী নাছের খান। আয়োজকেরা জানান, গণ-অভ্যুত্থানের পরে ইনসাফ, সুশাসন ও জবাবদিহির সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখতে স্পিক বাংলাদেশ কাজ করবে।
News Courtesy: